বরাবরের মতই মাসজিদে ফজর এর সালাত আদায় করে বাসায় এসে কড়া লিকারের এক কাপ গরম চা নিয়ে ব্যালকনিতে এসে বসলো রাহাত। চায়ে চুমুক দিতে দিতে সমান্তরালে চোখ বুলাতে থাকে দৈনিক পত্রিকার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি সমূহে। যেহেতু মাস্টার্স কমপ্লিট হচ্ছে প্রায় ১ বছর হতে চলল…
এবার তো একটা চাকুরী খুব দরকার তার কিন্তু তার কোন ব্যাক-আপও নেই, অভিজ্ঞতাও নেই তবে ইন্টার্ভিউ ফেস করার প্রচুর অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে যদিও লাভের লাভ কিছুই হয়নি । যাইহোক, হঠাৎ একটি চাকুরীর বিজ্ঞপ্তিতে চোখ আটকে গেল।
একটি প্রতিষ্ঠানে ২বছর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অফিসার নিয়োগ দেয়া হবে। যদিও রাহাতের কোন পূর্ব-অভিজ্ঞতা নেই তবুও সে মনস্থির করলো যে আবেদন করবে কারণ এছাড়া তেমন উপায়ও নেই। তাই যেই ভাবা সেই কাজ!
এখন শুধুই অপেক্ষা। অবশেষে ৪ দিন পর কল এলো। রাহাত আড়মোড়া ভেঙে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে…
— আসসালামু আলাইকুম
— ওয়ালাইকুম আসসালাম।
— জি, সৈয়দ রাহাত বলছেন?
— হ্যাঁ, রাহাত বলছি আমি।
— আমি রিবুট শিপিং লাইনস থেকে বলছি। আপনি আমাদের প্রতিষ্ঠানে অফিসার পদে আবেদন করেছিলেন। তো আগামী পরশু ১০টায় আপনার ইন্টার্ভিউ। প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্টস নিয়ে যথাসময়ে চলে আসবেন।
ওকে,ঠিক আছে। আচ্ছা! ইন্টারভিউ কি শুধু মৌখিক হবে, না-কি লিখিতও হবে।
— সরি! বলতে পারছি না।
— আর ইয়ে, মানে! বেতন কত হতে পারে?
— সরি, ভাই! একচুয়ালি এসব বিষয়ে আমরা আপনাকে কিছুই বলতে পারছি না, এ ব্যাপারে সিনিয়ররাই ভালো বলতে পারেন যে ইন্টার্ভিউ কিভাবে নেয়া হবে !
— আচ্ছা,, ঠিক আছে
— ওকে, থ্যাংকস …।
যথারীতি সেই দিনেই সেই অফিসে উপস্থিত হলো ইন্টার্ভিউ দিতে। রিসিপ্সনিস্টকে বলতেই ওয়েটিং রুম দেখিয়ে দিল।
ওয়েটিং রুম গিয়ে তো চোখ ছানাবড়া। তার মত আরও অনেক চাকুরী প্রার্থী ওখানে গিজগিজ করছে, পুরুষের তুলনায় নারীরাও কম নয়।
দেখেই তো রাহাতের গলা শুকিয়ে যাওয়ার অবস্থা। চুপচাপ কুকড়ে গিয়ে একপাশে থাকা একটি চেয়ারে গিয়ে বসলো। কুশলাদি বিনিময় করে ভাব জমাতে চেষ্টা করলো পাশের জনের সাথে।
— আচ্ছা, ইন্টার্ভিউ কি শুরু হয়েছে?
— না, এখনো শুরু হয়নি।
— কি বলেন! এখনো শুরু হয়নি !!
রাহাত মনে মনে রাগে ফুঁসতে লাগলো। কিন্তু পরক্ষণেই সে ভাবলো যে, ইন্টাভিউয়ারদের এটা একটা ইচ্ছাকৃত কৌশলগত পলিসিও হতে পারে যাতে চাকুরী প্রার্থীদের সহ্যশক্তিও তারা এই সুযোগে পরখ করে নিতে পারে । হয়তো চাকরীদাতারা সিসিটিভিতে তাদের সবকিছু অবলোকন করছে।
যাইহোক, অবশেষে ইন্টার্ভিউ শুরু হলো। সিরিয়াল হিসেবে অনেক পরে ডাক পড়লো রাহাতের। ইন্টার্ভিউ বোর্ডে গিয়ে দেখল ৩ জন যেন বসে আছে তার প্রতীক্ষায় । সম্ভবত মাঝের জন চেয়ারম্যান হবেন।
সালাম বিনিময়ের পর রাহাতকে বসতে বলা হলো।
চেয়ারম্যান সাহেবের ডানপাশের জন জিজ্ঞেস করলেন
— আপনি আপনার নিজের সম্পর্কে বলুন?
— এর আগে আপনার কোথাও কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে ?
— নাহ, আমার কোন অভিজ্ঞতা নেই।
–ওহ, তার মানে ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েট।
— জি
–দেখুন, আমাদের মোটামুটি অভিজ্ঞ লোক প্রয়োজন। এখন আপাতত কি করছেন আপনি?
— কয়েকটা টিউশনি করি এবং লেখালেখি করি।
— কি বিষয়ে লেখালিখি করেন?
— কবিতা /ছড়া লিখি।
হঠাৎ এ কথা শুনে প্রতিষ্ঠান প্রধান একটু নড়েচড়ে জিজ্ঞাসা করলো –
— আচ্ছা, তার মানে আপনি একজন কবি! দেখি একটি কবিতা শুনান তো!
এ কথা শুনে লজ্জায় কিছুটা ইতস্তত হল রাহাত। একটু ভেবেই তার রচিত ‘শিহরণ’ কবিতার কিয়দংশ পাঠ করে শুনালো।
— চমৎকার! কবিতার কি কোন বই বের হয়েছে ?
— নাহ!
— ইচ্ছে আছে না- কি?
— জি,ইচ্ছে আছে তবে… আর্থিক সংগতি থাকলে তখন হয়তো ….!
— হুম! বই বের করতে খরচ কত পড়ে?
— এটি বইয়ের ফর্মা, সংখ্যার উপর ডিপেন্ড করে।
— ফর্মা কি !
এ প্রশ্নটিতে রাহাত মোটেও অবাক হয়নি কারণ সাধারণ মানুষ তো বটেই এমনকি অনেক লেখক আছেন, যারা এখনো একটা বই বের করেনি, তাদের অনেকেরই ফর্মা সম্পর্কে কোন আইডিয়াই নেই।
— ফর্মা বলতে ১৬ পৃষ্টায় ১ ফর্মা বুঝায় ।
— আচ্ছা,ওকে! আপনার সেল নং তো সিভি’তে আছে। আপনাকে সিলেক্ট করলে কল দেয়া হবে ।
অতপর ইন্টার্ভিউ শেষ করে শ্রান্ত হয়ে বাসার দিকেই গমন এবং যথারীতিই তীর্থের কাকের মতই চেয়ে থাকা…
কল আসছে কি-না ! যদিও তার এ জবটিও হবে বলে মনে হয় না।
হঠাৎ মোবাইলে রিং বেজে উঠলো।
— আসসালামু আলাইকুম
— ওয়ালাইকুমুসসালাম
— আপনি রাহাত সাহেব বলছেন?
— হুম, আমি রাহাত বলছি।
— আমি রিবুট শিপিং লাইনস থেকে বলছি। আপনি কি একটু কষ্ট করে আজ সন্ধ্যায় অফিসে আসতে পারবেন?
— আসতে পারি, কিন্তু কেন?
— দু:খিত, ফোনে বলা সম্ভব নয়। আপনি যদি আসতে ইচ্ছুক হন, তবে সন্ধ্যা ৬ টায় চলে আসবেন, তখন বিস্তারিত কথা হবে।
— আচ্ছা, ঠিক আছে।
— ওকে, আল্লাহ হাফিয।
কল কাট করার পর একরাশ চিন্তা নিয়ে আবারো পরিপাটি হয়ে যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে রিসিপসন রুমে বসে মহান আল্লাহপাককে স্মরণ করতে লাগলো রাহাত। বলতে গেলে অফিস প্রায় ফাঁকা, হঠাৎ এ সময় সন্ধ্যা ৬ টায় তাকে তলব করার মানেটা সে বুঝে উঠতে পারছে না, কারণ তাকে জবে রিক্রুট করলে তো সেটি অনায়াসে ফোনে বলতে পারতো।
এমন সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই পিয়ন এসে তার সামনে দাঁড়াল এবং তাকে জি.এম এর কেবিন অব্দি পৌঁছে দিলো।
— আসসালামু আলাইকুম
— ওয়ালাইকুম আসসালাম, বসুন।
— ধন্যবাদ
— কেমন আছেন আপনি?
— আলহামদুলিল্লাহ।
— আসলে আপনাকে আসতে বলেছি একটা বিষয়ে কথা বলতে।
আসলে.. আপনি যেহেতু একজন সংস্কৃতিবান ব্যক্তি তথা কবিতা লেখালেখি করেন তাই আমাদেরও উচিৎ আপনাদের মত প্রতিভাবানদের এপ্রেসিয়েট করা। যদিও আমাদের প্রতিষ্ঠানে আমরা আপনাকে জবটি দিতে পারেনি বলে দু: খিত। কিন্তু তবুও আপনার পাশে থেকে সেই আকাঙ্ক্ষিত লালিত স্বপ্ন পূরণ করতে চাই মানে আপনার নিজের একটি কবিতার বই আমাদের প্রতিষ্ঠানের আর্থিক পৃষ্টপোষকতায় বের করতে চাই।
বাকরুদ্ধ রাহাত বুঝতেই পারছে না সে কী বলবে। তার কাছে এসব স্বপ্নের মত লাগছে, আবেগ সংবরণ করে শুধু বললো –
— এটা তো আমার জন্য পরম সৌভাগ্য যে আমার নিজের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বই প্রকাশিত হবে। সত্যিই, এজন্য আমি আপনাদের কাছে পরম কৃতজ্ঞ থাকবো।
— অভিনন্দন আপনাকে। তবে ইয়ে.. মানে.. একটা শর্ত রয়েছে আমাদের। জানি না আপনি কিভাবে তা গ্রহণ করবেন!
— কি শর্ত, স্যার?
— শর্ত হলো যে কবিতার বইটিতে কবিতার রচয়িতা হিসেবে আপনার নামটা থাকবে না তবে আপনার পছন্দসই কবিতাসমূহ আপনি আপনার মত করে সাজিয়ে দিতে পারেন …
— মানে! বইয়ে নাম থাকবে না আমার…. বুঝতে পারলাম না স্যার ..!
— দেখুন, খোলাসা করে বলছি… আপনার কবিতার বই অর্থ দিয়ে প্রকাশ করার ঝুঁকিও নিব আমরা, সেই বই বিক্রির দায়ভারও আমাদের,কারণ আমাদের অনেক হাই সোসাইটি ও কর্পোরেট লেভেলের ব্যক্তিবর্গ আছেন যারা সৌজন্যতা দেখিয়ে অনায়াসে কিনেও নিতে পারেন ..সেটা নিয়ে আপনাকে টেনশন করতে হবে না উপরন্তু তারচে বড় কথা আপনাকে একটা মোটা অংকের সম্মানী দিয়ে ‘অনার’ করা হবে।
এতক্ষণ আকাশে ভেসে স্বপ্নের ঘোরে থাকা রাহাত যেন ধপাস করে মাটিতে আঁচড়ে পড়লো। এখন তার কাছে বিষয়টি খোলাসা হল যে তাকে অযাচিতভাবে এত খাতির করার মানেটা কী!
এখনও সে আগের মতই বাকরুদ্ধ তবে আনন্দে নয়- রাগে-ক্ষোভে, হতাশায়,হীনমন্যতায় । তবুও নিজেকে সংবরণ করে নির্লিপ্তভঙ্গিতে জানতে চাইলো –
— আচ্ছা, আমার কবিতার বইয়ে আমার নাম এর জায়গায় কার নামটি অলংকৃত করা হবে?
— সেটি এখন বলতে পারছি না, যদি আপনি আমাদের এই offer এ রাজী হন তবে আপনার সাথে একটি সম্মতিসূচক চুক্তিপত্র করা হবে। তখন আপনি অটোমেটিক্যালি জানতে পারবেন।
— আসলে এভাবে আত্নপ্রবঞ্চনায় পরে বই বের করার কোন পরিকল্পনাই নেই আমার। কারণ আমার লেখা,আমার কবিতাগুলো আমার সন্তানের মতই।
— আমি বুঝতে পারছি, রাহাত সাহেব। ইটস এ নাথিং জাস্ট এ ডিল। নট এ প্রেসার অর ইমপোজ আপন ইউ।
— ঠিক আছে আমি এখন তাহলে উঠি।
— তো আপনার সিদ্ধান্তটা যদি আমাদের জানিয়ে দিতেন।
— দেখুন, রাজী থাকলে তো সিদ্ধান্ত আগেই জানিয়েই দিতাম।
ঠিক আছে, আমি এখন বরং উঠি।
এই বলে রাহাত বিদায় নিয়ে মনমরা হয়ে কেবিন থেকে বের হওয়ার মূহুর্তে…
— আচ্ছা,শুনুন রাহাত সাহেব…
— জি,বলুন
— যদি আপনি চান তবে বইতে কিন্তু আপনার নামটি “সম্পাদক” হিসেবেও রাখা যেতে পারে।
হতভম্ব,কিংকর্তব্যবিমূঢ়, বোকা বনে যাওয়া রাহাত মনে মনে অগ্নিশর্মা হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে কমার্শিয়াল এই স্যুটেড-বুটেড রোবটটার দিকে !
ভালো লাগলে পড়ুন_পড়ান_অভিমত জানান।
লেখক পরিচিতি :কাজী মুহাম্মাদ রাকিবুল হাসান, ২৯ পৌষ,১৪২৬ চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ …
বিঃ দ্রঃ লেখাটি জানুয়ারি,২০২০, “মাসিক জনপ্রিয় লেখনী” প্রতিযোগিতার অন্তর্ভুক্ত।