"আনো শক্তি, আনো দীপ্তি, আনো শান্তি, আনো তৃপ্তি আনো স্নিগ্ধ ভালোবাসা ,আনো নিত্য ভালো।।" - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'গান' গীতমালিকা (১)
২৫শে বৈশাখ উপলক্ষে কবিগুরুর পরিবারের দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ পুত্র সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুররের স্ত্রী শ্রীমতী চারুবালার দেবীর ডায়ারীর কিছু লেখনী দিয়ে পারিবারিক আঙ্গিকে ফিরে দেখা।
চারুবালার পিতা ব্রাহ্ম ছিলেন এবং ঢাকা শহরে কেশবচন্দ্র সেন এর বক্তৃতায় যে চল্লিশ জন যুবক একসাথে ব্রাহ্ম ধৰ্ম গ্রহণ করেছিলেন, চারুবালার পিতা নবোকান্ত তাদেরই অন্যতম ।সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে যখন চারুবালার বিয়ে ঠিক হয় তখন সে কলকাতার বিখ্যাত বেথুন স্কুলের ছাত্রী ও ইস্কুল বোর্ডিং ই থাকতন । বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এদেশের প্রথম মহিলা এম এ চন্দ্রমুখী বসু ,দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখ, যদিও কনের বয়স ১৬ পূর্ণ হয় নি তাই নিমতন্ন রক্ষা করেন নি বাল্য বিবাহ বিরোধী শিবনাথ শাস্ত্রী।
এই বিবাহ উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ “বাজিল কাহার বীণা” গানটি উপহার দেন। গানের পাণ্ডুলিপি তে ‘সুধীর বিবাহ দিনে’ লেখাটি রয়েছে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের হস্তাক্ষর ।
পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠপুত্রী মাধুরীলতার সাথে তিনি বেথুনে যেতেন মাঝে মাঝে।
ডায়েরি থেকে জানা যায় কিছু মজার কথা , যেমন মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর থাকতেন জোড়া সাঁকোর তিনতলাতে এবং তিনি তার জন্মদিন উপলক্ষে তার ঘরে আগত সবাই কে একটি করে কমলালেবু উপহার দিতেন ।
"কিসের তরে অশ্রু ঝরে কিসের লাগি দীর্ঘ শ্বাস হাস্যমুখে অদৃষ্টরে করবো মোরা পরিহাস" ...
কবির কনিষ্ঠ পুত্র অকাল প্রয়াত শমীন্দ্র নাথ ঠাকুরের এর দূর্বল স্বাস্থ্যর সাথে সাথে ছোটোবেলায় যে তিনি যথেষ্ট মোটাসোটা ছিলেন এবং দেখতে প্রায় রবি কাকার মতোই ছিলন তার উল্লেখ পাওয়া যায়। গ্রীষ্ম কালের দুপুরে প্রচন্ড দাবদাহে শিশু শমীম কে নিয়ে মৃণালিনী দেবী এক তালার ঘরে আশ্রয় নিতেন ।
"দাও ফিরে সে অরন্য লও এ নগর , লও যত লৌহ লৌষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর হে নব সভ্যতা" - রবীন্দ্রনাথ ' সভ্যতার প্রতি' চৈতালি
মৃণালিনী দেবীর সাথে শান্তিনিকেতনে অতিবাহিত দিনগুলির কথা পত্রে জানা যায় , পুরোপুরি কবিকে পান উনি , বীরভূমের ওই লাল মাটির সংসারে ছোট্ট বাড়িটি তে কবির সাথে সংসারযাপন , যদি ও আশ্রমের কিছু দায়িত্বভার কবিপত্নীর ওপর ছিল।
"অপূর্ব এক স্বপ্ন সম লাগিতেছে চোখে মম " - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'কৃপণ' খেয়া
রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর রচিত অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন ও গান গেয়েছেন , জানা যায় শান্তিনিকেতন কবির একজন ছাত্রীকে কবি নতুন গানের সুরগুলি মনে রাখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন, এছাড়া অন্যান্য ছাত্রীরা সমবেতও এই দায়িত্ব পালন করতো।
তবে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীর অভিনয় সমন্ধেও জানা যায় ।’ রাজরানী’ নাটকটি ছাড়াও বেথুন স্কুলের ‘ গোড়ায় গলদ ‘ বলে একটি নাটকে উনি ‘ক্ষান্ত মনি’র অভিনয় করিয়াছিলন ।
রবি ঠাকুরকে সদা সর্বদা হাস্যমুখ ও অনুভূতিপ্রবন মানুষ হিসেবেই আমরা পায়, শান্তিনিকেতনের আগে তিনি দোলের সময় জোড়া সাঁকোতে থাকতেন , আজ যে বাড়িটি বিশ্বভারতী বিশ্ব বিদ্যালয়ের বিল্ডিং তথা ৫নম্বর বাড়ি সেখানে আয়োজিত হত দোল , তখন বারান্দা থেকেও কোনো কোনো সময় কবির উপর রং ফেলা হতো ও দোল উৎসব ও যথেষ্ট মজায়, নাটক ,গানে পালিত হতো। রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চ্চা জোড়াসাঁকোতে ও চলতো নিয়মিত ।
কোপাই নদী , ভুবনডাঙ্গার মাঠ ,পলাশের রঙের খেলায় আচ্ছাদিত মুগ্ধ কবি একের পর এক সৃষ্টি করে চলেছেন কালজয়ী সব রচনা । আশ্রমের গাছের তলায় চিরাচরিত রীতি ভেঙে শিক্ষা ,অনন্য আশ্রমরীতিতে পরিপূর্ণ শান্তিনিকেতন।
"নদী তীরে অন্ধকার নামিত প্রেমনত নয়নে স্নিগ্ধ ছায়াময় দীর্ঘ পল্লভর মতো".. -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ' বিদায় অভিশাপ'
এছাড়া কিছু করুন ঘটনাও সামনে আসে । কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী যে রাত্রে গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান ,তার খবর স্বয়ং কবিপুত্র জ্যেষ্ঠ রথীন্দ্রনাথও পরদিন সকালে পান ,ততক্ষণে শ্বশানে দাহকার্য সমাপ্ত ,আশ্চর্য লাগে ১৪ বছরের পুত্র কেনো সে রাতে নিজের মায়ের মৃত্যুর সংবাদ পান নি। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় তার উল্লেখ মেলে।পরবর্তীকালে এ শান্তিনিকেতনেই প্রায় স্থায়ী ভাবে অবস্থান করতেন কবি। শান্তিনিকেতনের জন্যই পুরোপুরি নিজেকে নিয়োজিত করেন, তার প্রমাণও বিভিন্ন লেখনীতে ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লিখিত বিভিন্ন পত্রে মেলে।
"সেই অন্ধকারে সাধনা করি যার মধ্যে স্তব্ধ বসে আছেন বিশ্বচিত্র রূপকার,যিনি নামের অতীত প্রকাশিত যিনি আনন্দে।" - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'শেষ সপ্তক' (৮)
লেখিকা পরিচিতি : সংহিতা সরকার , মুম্বাই
খুব সুন্দর উপস্থাপনা।
অনেক ধন্যবাদ 😊।