মা কালীর রূপের বর্ণনা:– শক্তির দেবী হিসেবে দেবী কালীর পূজা করে বাঙালিরা। শাস্ত্র অনুযায়ী,তন্ত্রমতে পূজিত দেবদেবীদের মধ্যে কালীপূজা অন্যতম। দশমহাবিদ্যার এক আদি রূপ কালী। দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায় বেদ, উপনিষদ,পুরাণ, শ্রী চন্ডী ইত্যাদি গ্রন্থে। দেবী কালীর বিভিন্ন রূপ যথা- শ্মশান কালী, সিদ্ধকালী, ভদ্রকালী,রক্ষাকালী,গুহ্যকালী, দক্ষিণাকালী, বামাকালী ইত্যাদি। তবে দেবী দক্ষিণাকালীই বেশি প্রসিদ্ধ এবং পূজিতা। দেবী করালবদনা, মুক্তকেশী, চতুর্ভূজা, নরমুন্ডমালা বিভূষিতা। দেবীর রূপ দিগম্বরী। তিনি ত্রিনয়নী এবং শবরূপী শিবের হৃদয়ের উপর অধিষ্ঠাত্রী। দেবীর দক্ষিণ বা ডান পা শিবের বুকের উপর অধিষ্ঠিত। কালী শব্দটির উৎপত্তি ‘কাল’ থেকে,যার অর্থ মৃত্যু, মহাকাল। শিবের অপর নাম ‘কাল’,তাই তাঁর পত্নী হিসেবে হয়ে উঠেছেন কালী। মা কালীর গলায় ঝুলছে পঞ্চাশটি নরমুন্ডমালা এবং বাঁহাতে আছে নরমুন্ড। নরমুন্ড হল চেতনশক্তির আধার। দেবীর দেহের বর্ণ মহামেঘের ন্যায় এবং স্তনযুগল উন্নত। মায়ের কেশ তাঁর প্রচন্ড তেজ ও শক্তির প্রতীক। মায়ের জিহ্বা বিশ্বব্রহ্মান্ডের ভারসাম্য রক্ষা করে।
মা কালীর জন্ম বৃত্তান্ত:– মা কালীর রূপ এবং জন্ম নিয়ে আছে এক পৌরাণিক কাহিনী। কথিত আছে যখন স্বর্গে অসুরেরা তান্ডব চালাচ্ছে দেবতাদের স্বর্গ দখলের উদ্দেশে। তখন নিরূপায় হয়ে দেবতারা মিলে সৃষ্টি করেন দেবী দুর্গার। আর সেই অসুরদের প্রধান ছিল রক্তবীজ। সে ছিল ব্রহ্মার বর প্রাপ্ত। বর অনুসারে তাঁর এক ফোঁটা রক্ত ভূমিতে পড়লেই তা থেকে জন্ম হচ্ছিল একাধিক অসুরের। সেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতেই মা দুর্গার ভ্রুযুগলের মাঝখান থেকে জন্ম হয় কালীর। সেই কালীর ভয়াবহ রুদ্ররূপ দেখে বহু অসুর পালাতে থাকে আর তাঁর হাতেই একের পর এক অসুর বধ হতে থাকে। অসুরের দেহ থেকে এক ফোঁটা ক্ষরণ হলেও তা জিভ বের করে পান করতে থাকেন কালী। এই ভাবেই একের পর এক অসুরকে বধ করেন কালী। তার পরে রক্তবীজকে মেরে তাঁর শরীরের সমস্ত রক্ত পান করেন কালী।অসুরের সব রক্ত শুষে নিয়ে তাঁর দেহ রক্ত শূন্য করে ছুঁড়ে ফেলে দেন তিনি। আর এই ভাবেই তিনি ধ্বংস করেন অসুরদের। মা কালীর পায়ের নীচে শায়িত থাকেন শিব। আসলে অসুরদের হারিয়ে প্রবল বিজয় নৃত্য শুরু করেছিলেন কালী। অসুরদের মুন্ড দিয়ে তিনি বানিয়ে ছিলেন গলার মালা এবং তাঁদের হাত কেটে বানিয়েছিলেন কোমরবন্ধ। কালীর নাচে তখন সব কিছু প্রায় ধ্বংস হতে শুরু হয়ে যায়। এই অবস্থায় কালীর সেই নৃত্য বন্ধ করতে কালীর সামনে গিয়ে শুয়ে পড়েন শিব। তার পরে নিজের পায়ের নীচে স্বামীকে শুয়ে থাকতে দেখে দুঃখে এবং লজ্জায় জিভ কাটেন তিনি। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী, কালীর এই রূপ পূজিত হয়ে আসছে আজও। কালীপূজায় গ্রহদোষ উপশম,অগ্নি-চোর ভয়, দুঃখ-দারিদ্রনাশ, রোগ-শোক, সম্পদ লাভ এবং জয় লাভ হয়ে থাকে।
কালীপূজার মাহাত্ম্য:– দেবী কালীর তপস্যা এবং সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছেন বহু সাধক। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ, বামাক্ষ্যাপা, রামপ্রসাদ,স্বামী বিবেকানন্দ ইত্যাদি। কথিত আছে,পূর্বে গ্রামে ডাকাতেরা ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে মা কালীর পূজা করতেন এবং নরবলি দিতেন সাফল্যের জন্য। শাস্ত্রে ছাগবলি বা ষড়রিপু যথা-কাম,ক্রোধ,লোভ,মদ,মোহ,মাৎসর্য্য বলির উল্লেখ আছে। কালীপূজার সময় রাতের অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে মানুষ সর্বত্র প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোকিত করে রাখে। বিশ্বাস করা হয়, অন্ধকারেই অশুভ আত্মা ও অশুভ শক্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাই এই অশুভ শক্তিকে বিনাশ করতে প্রদীপ জ্বালানো হয়ে থাকে। তাই এই আলোর উৎসব দীপাবলি নামে পরিচিত।
বাংলায় কালীপূজার প্রচলন:– কালীপূজার উৎপত্তি ও প্রচলন সম্পর্কে বহু তথ্য আছে। প্রাচীন গ্রন্থ অনুযায়ী জানা যায়, অতীতে তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ বাংলায় প্রথম কালীমূর্তিতে দেবীর পুজো করেছিলেন। তার আগে দেবী কালীর আরাধনা করা হতো তামার পাত্রে খোদাই করে কালীর মূর্তি এঁকে। এভাবে মা কালীর মূর্তি পুজোর প্রচলন শুরু হয় বাংলায়।
কালীর একাধিক রূপের পূজা:– দুর্গাপুজোর পরে কার্তিক মাসের দীপান্বিতা কালীপুজো প্রধান পুজো এবং এই পুজোর প্রচলন বেশি। এছাড়াও মাঘ মাসে রটন্তী কালীপূজা, জৈষ্ঠ্য মাসে ফলহারিণী কালীপূজা,ভাদ্র মাসে কৌশিকী অমাবস্যার কালীপূজা এবং প্রত্যেক অমাবস্যায় কালীপূজাও ভক্তি সহকারে অনুষ্ঠিত হয়।
দেবী কালীর পৌরাণিক কাহিনী:– পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, একবার শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামের দুই অসুর সারা বিশ্বে ব্যাপক আক্রমণ করেছিল। দেবতারা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে পরাজিত হয়। দেবতারা দেবলোকে থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর, দেবরাজ ইন্দ্র আদ্যাশক্তি মা মহামায়ার আরাধনা দেবলোক ফিরে পাওয়ার আশায়। তখন দেবী আর্বিভূতা হন এবং তাঁর শরীরের কোষ থেকে দেবী কৌশিকীর সৃষ্টি হয়,যার গাত্রবর্ণ কালো। এরপর দেবী শুম্ভ ও নিশুম্ভকে বধ করে দেবতাদের দেবলোক ফিরিয়ে দেন।
উপসংহার:– মা কালীর লীলাভূমি ও মাহাত্ম্যের স্বরূপ বহু তীর্থস্থানে আছে । যেমন- বীরভূমের তারাপীঠ, কলকাতার দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাট ইত্যাদি। কালক্রমে এই পুজো ভিনরাজ্যে, বিদেশেও ধুমধামের সহিত অনুষ্ঠিত হয়। মন্দির প্রাঙ্গণ সর্বদা “জয় মা কালী” ধ্বনিতে মুখরিত থাকে। বিভিন্ন পৌরাণিক ও অলৌকিক রহস্যের মিশ্রণে এই তীর্থস্থান গুলি নির্মিত হয়েছে।
কলমে হিরন্ময় চক্রবর্তী
Write and Win: Participate in Creative writing Contest & International Essay Contest and win fabulous prizes.