অঙ্কন : অনন্যা আলোক

১৪’ই,জুন ২০২০’র দুপুরে হঠাৎ টিভি’তে করোনার খবরের সাথে এক অতি প্রিয়, উজ্জ্বল, প্রাণে ভরা নক্ষত্রের পতনের খবর শুনে আমার সাথে প্রায় গোটা দেশ স্তব্ধ হয়ে যায়।
সুশান্ত সিংহ রাজপুত আত্মহত্যা করেন।
বিশ্বাসই হয়েনি এবং এখনো হয় না।
সেদিনের পর থেকে টিভি আর ফেসবুক দেখাই প্রায় কমিয়ে দিয়েছি।
সুশান্তের সব কটি অভিনীত ছবি, সিরিয়াল, ড্যান্স শো আমার দেখা…. কিছুই বাদ দিতাম না। তাই ও’মন খবরে কষ্ট পাওয়াটা খুব স্বাভাবিক।
সিনেমা আমি ভীষণ দেখি। কিন্তু তাই বলে কোনোদিন খাতা পেন নিয়ে লিখতে বসিনি। এমনকি সুশান্তের অভিনীত কোনো সিনেমা নিয়ে’ও লিখিনি। কিন্তু আজ পত্রিকার জন্য এই সিনেমা আলোচনা-বিভাগটিকেই বেছে নিলাম। তবে এমন একটি সিনেমার কথা লিখতে বসলাম যাকে শুধু অনুভব করেছি তার গানের মাধ্যমে আর ছবিটি দেখার পর উত্তেজিত বন্ধুদের সাথে ফোনালাপ।

সিনেমাটির নাম ‘দিল বেচারা‘।
এটি একটি হিন্দি সিনেমা।
সর্বোপরি সুশান্ত সিংহ রাজপুতের শেষ অভিনীত ছবি।
ছবিটির গান যেদিন থেকে মুক্তি পায় সেদিন থেকেই খুব আগ্রহের সাথে শুনি। এখন প্রায় রোজ শুনি।
‘দিল বেচারা’ একটি ইংরেজি উপন্যাসের অনুকরণে নির্মিত। সেই উপন্যাসও আমার পড়া।

যাইহোক আজ, আমার এক অতি প্রিয় নায়কের জীবনের শেষ অভিনীত ছবি দিয়ে, আমি আমার জীবনের প্রথম সিনেমা-আলোচনা লেখা শুরু করি।
ছবিটির পরিচালক মুকেশ ছাবরার এটি প্রথম ছবি এবং এটি, খ্যাতিমান আমেরিকান লেখক জন গ্রীনের বিখ্যাত ইংরেজি নোভেল ‘The Fault in Our Stars’ থেকে নেওয়া হয়েছে।

যদিও এই নামে এই উপন্যাসের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে হললিউডের পরিচালক জোশ বুন ‘The fault in our stars’ পরিচালনা করেন এবং সেটি ২০১৪ সালে মুক্তিও পায় এবং জনপ্রিয়তাও লাভ করে।

পরিচালক মুকেশ ছাবরা মূল গল্পটির অনুকরণে এই সিনেমাটি তৈরি করেন। যাঁর প্রথমে নাম ঠিক করা হয়েছিল– সিনেমার প্রধান দুটি চরিত্রের নাম দিয়ে— ‘কিজি অর ম্যানি’ কিন্তু পরে সেটি পাল্টে ‘”দিল বেচারা'” নামকরণ হয়।

ছবিটি প্রথমে ২৯সে নভেম্বর ২০১৯’এ মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল, পরে সেটি বাতিল হয়ে ৮’ই মে ২০২০’সালে মুক্তির দিন স্থির হলেও মহামারী করোনার দাপটে সেটির মুক্তির দিন পিছিয়ে যায়।
কেন জানিনা আমার ব্যক্তিগত ধারনা এই যে—- ছবিটি তার নির্দিষ্ট সময় মুক্তি পেলে হয়তো সুশান্তের সাথে এমন অঘটন ঘটতোই না।

অবশেষে ছবিটি ২৪’এ জুলাই ২০২০’ তে সন্ধ্যা ৭.৩০’এ ‘Disney+ Hotstar’ এ মুক্তি পায়।
ছবিটি মুক্তি পাওয়ার দুই ঘণ্টার মধ্যেই ‘হটস্টার’ ক্রাশ করে।

সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার আগের থেকেই সুশান্তের ফ্যানেরা সোশ্যাল মিডিয়ায়তে বিভিন্ন রকম ভাবে প্রমোট করে।
কি আশ্চর্য একটি ছবির প্রমোশান করতে কোটি কোটি টাকা খরচ করতে হয়, সেই প্রমোশানের কাজ সুশান্তের ফ্যানেরা লক-ডাউনে ঘরে বসেই করে দিল।
একমাত্ৰ ভালোবাসা না থাকলে এই বিশাল কর্মকাণ্ড অসম্ভব।

ছবিটিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সুশান্ত সিংহ রাজপুত , আজ অবধি তাঁর কোনো অভিনয়কে অভিনয় বলে মনে হয়নি। তিনি যেন চরিত্রগুলির মধ্যে ঢুকে যান। আর যা শুনেছি এই ছবিটির মাধ্যমে সুশান্ত তাঁর না বলা কথাগুলি বলে গেছেন আশ্চর্য ভাবে।

নবাগতা নায়িকা সঞ্জনা সাঙহী শুনলাম চমৎকার অভিনয় করেছেন।
তাঁর মা ও বাবা’র ভূমিকায় ছিলেন অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখার্জী,ও অভিনেতা শাশ্বত চ্যাটার্জী। আর ছিলেন জাভেদ জাফরী ও সইয়াফ আলী খান।
প্রত্যেকেই শুনলাম ভালো করেছেন।

সংগীত নির্দেশনায় এ.আর রহমান।
গীতিকার অমিতাভ ভট্টাচার্য।
মূল উপন্যাসটি, ক্যানসারে আক্রান্ত দুটি টিনএজার ছেলে, মেয়ে- অগাস্টাস ও হ্যাজেলের —- একটি প্রেম কাহিনীকে কেন্দ্র করে।

আমাদের ‘দিল বেচারা’টিও নাকি দুই তরুণ ও সবুজ প্রেম দিয়েই সাজানো হয়েছে যেখানে নায়ক নায়িকা দুজনেরই ক্যান্সার, দুজনেই জানে মৃত্য এখন তাঁদের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে।
ছবিতে নায়কের অনেক স্বপ্ন কিন্তু সে জানে তাঁর কোনো স্বপ্নই আর পূরণ হবার না, তাই সে তাঁর প্রেমিকার স্বপ্ন পূরণ করতে চায় । এবং তাতেই সে খুশি।

আমি শুধু গান শুনেছি অনেকবার।
গানের মধ্যেই পুরো গল্পটাই যেন দেখতে পাওয়া যায়। গীতিকার অমিত ভট্টাচার্য যেন প্রতিটি কথায় প্রাণ ঢেলে দিয়েছেন সুশান্তের শরীরে।
সুরকার এ.আর. রহমান যেন সুশান্তের ছন্দোময় শরীরে নিয়ে এসেছেন সঞ্জনার সঙ্গে তাঁর স্বল্প জীবনের আবছায়া সুর।
আর, ফিরেছেন সুশান্ত সিংহ রাজপুত নিজে—- জীবন আর মৃত্যুর সবটা নিয়ে।

সুশান্তের এই আকস্মিক মৃত্যুকে কেউ আত্মহত্যা বলে, কেউ হত্যা বলে।
সে যে যাই বলুক সুশান্ত আর নেই। সে আর ফিরবে না। সে দেখলো না গত ২৪’এ জুলাই এর সন্ধ্যাটা।
সে দেখলো না তাঁর জন্য কত শত শত মানুষ এই মহামারীকে উপেক্ষা করে, তাঁকে দু-নয়ন ভরে দেখলো, আর চোখের জল ফেললো।

ছবির প্রতিটি গান যেন আরোও বেশি করে বাঁচতে বলে, আরও নতুন করে ভাবতে বলে, আরোও নতুন করে ভালোবাসতে বলে।

বন্ধুর কাছে ছবিটি নিয়ে দশ মিনিটের মতন শোনার পর, তাকে থামতে বলি।
খুব কান্না পায়ে।

মনে হয় কোথায় পাবো সেই ‘Friend Zone’!!
সুশান্ত কি নিজের জন্যই গানের মাধ্যমে আমাদের ‘তারা গুনতে বলে গেলেন?’
যাওয়ার আগে বলে গেলেন ‘খুলকে জিনে কা তরিকা’ গুলি কি কি হতে পারে এক জনের জীবনে।

‘দিল বেচারা’ শুধু সিনেমায় নয়। এ যেন সুশান্তের হঠাৎ ফুরিয়ে যাওয়া জীবনের কথা।
ছবিটির একটি সংলাপ আজকাল খুব ফেসবুকে চোখে পড়ে — নায়ক বলে “জানাম কাব লেনা হে ওর মরনা কাব হে, হাম ডিসাইড নেহি কার সকে, পর জিনা ক্যেসা হে ও হাম ডিসাইড কার সকতে হে..’’।
পড়লেই কেমন যেন একটা লাগে, এটি কি সুশান্ত নিজের কথাই বলতে চেয়েছিলেন।
ছবিতে নিজে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়েও তাঁর ক্যানসারে আক্রান্ত নায়িকার জীবনে রং ভরিয়ে দেন।

এত যাঁর মধ্যে প্রাণ সে কি করে নিজেকে হত্যা করতে পারে!

গল্প বা গান কোনটা শুনলেই মনে হয় না যে সুশান্ত আর নেই। মনে হয় তিনি আছেন এবং আবার কোনো নতুন চরিত্র নিয়ে রুপোলি পর্দায় ভেসে উঠবেন!

‘দিল বেচারা’- তাই ক্ষোভ নয়, কোনো দুঃখও নয় শুধু মৃত্যুকে ছাপিয়ে এই করোনা কালের আতঙ্কের মুহূর্তকে খুশির মুঠোয় ভরে দিতে চায় এই ছবি।

ঠিক যেমন সুশান্ত, তাঁর প্রিয় দর্শকদের ‘বেচারা’ দেখতে একদমই চায়না।

ফেসবুকে এই ছবির আরোও একটি নায়কের সংলাপ বাংলায় অনুবাদ করা, প্রায় অবাক করিয়ে দেয়—-“একযে ছিল রাজা এক যে ছিল রানি, রাজা চলে গেছে, রয়ে গেছে রানি।”
কি অদ্ভুত, বাস্তবেও ঠিক এমনটি ঘটলো কি করে??

আজ তিনি যেন তারা হয়ে নিজেই তারা খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

সেদিন দর্শকরা তাঁকে এবং তাঁর নতুন ভাবে নতুন চরিত্রে শেষবারের মতন এক বিষাদময় আনন্দ নিয়ে দেখলো, শুধু আমি বোধহয় নিজেকে এই রকম এক অদ্ভুত আনন্দের মধ্যে আনতে ব্যর্থ হলাম।

 

 কলমে মধুমিতা রায় চৌধুরী মিত্র,বরাহনগর, উত্তর কলকাতা

বিভিন্ন ধরনের লেখা লেখি করি, বই পড়ি, গান শুনি, আঁকি, নতুন নতুন রান্না করি।
খুব বেশি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা না থাকলেও ভীষন ভাবে ভ্রমণের পিপাসু।
প্রিয় শব্দ তাই “Wanderlust”.


1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here