ক্লাস ইলেভেনের প্রথম দিনেই সপ্তকের চোখ বারবার চলে যাচ্ছিল পাশের বেঞ্চের দিকে।বরাবরের মেধাবী সপ্তক কোনোদিন ফার্স্ট বেঞ্চ ছাড়া বসেনি।ক্লাসে পড়া চলাকালীন অন্য কোনদিকে মন দেয়নি কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম ঘটলো।কারণ টা হলো পাশের বেঞ্চে জড়সর হয়ে চুপ করে বসে থাকা শান্ত মেয়েটা।নাম তার সাগরিকা।সে এই স্কুলে নতুন ভর্তি হয়েছে।এই স্কুলে আজই তার প্রথম দিন।ক্লাস নাইন টেনে ওঠার সময় থেকেই বন্ধুদের প্রেম কাহিনীর কথা শুনে আসছে সপ্তক।কিন্তু তার নিজের কোনোদিন এসব ব্যাপারে আগ্রহ ছিলনা।সে তার নিজের দুনিয়ায় থাকতো পড়াশোনা আর ছবি আঁকা নিয়ে।অসাধারণ ছবি আঁকার হাত ছিল সপ্তকের। কিন্তু আজ যেন সাগরিকার টানা টানা চোখ,মেঘের মতো ঘন চুল আর মায়ায় ভরা মুখশ্রীটা কিছুতেই যেন চোখের আড়াল হতে দিতে পারছেনা সপ্তক।এই মেয়েটাই যেন তার জীবনের রাজকন্যা। প্রথম দেখাতেই যেন সাগরিকাকে ভালো লাগতে শুরু করে সপ্তকের।
দিন এগোতে থাকে আর নানা বাহানায় সপ্তক শুধু সাগরিকার সাথে কথা বলার বাহানা খুঁজতে থাকে।সাগরিকা কিছু বুঝতে না পারলে সপ্তক পড়াশোনাতেও সাহায্য করে তাকে।
এইভাবে তারা ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে।
দেখতে দেখতে ক্লাস ইলেভেনের রেজাল্ট বেড়িয়ে যায়। সপ্তক ক্লাসে প্রথম হয়েছে। সাগরিকার রেজাল্ট ও ভালো হয়েছে।সে খুশি হয়ে সপ্তককে শুভেচ্ছা জানাতে গেলে সপ্তক ওর হাত দুটো ধরে বলে,
সাগরিকা,সেই ইলেভেনের প্রথম দিনেই আমি তোকে ভালোবেসে ফেলেছি রে।আই লাভ ইউ।
সাগরিকার গাল দুটো লজ্জায় রাঙা হয়ে আসে।সে মুখ নিচু করে মৃদু স্বরে বলে,
আই লাভ ইউ টু।
বলেই ছুটে চলে যায় সেখান দিয়ে। সপ্তকের মনে আনন্দের শেষ থাকেনা আর। আনন্দে প্রায় দিশেহারা হয়ে যায় সে।
এরপর শুরু হয় সপ্তক আর সাগরিকার প্রেম কাহিনী। প্রতিটা মুহূর্ত যেন স্বপ্নের মতো কাটছিল ওদের দুজনের। সাগরিকার খুব খেয়াল রাখতো সপ্তক। কখনো ক্লিপের বাঁধন ছাড়িয়ে অবাধ্য চুল গুলো যখন সাগরিকার কপালে এসে পড়তো তখন সপ্তক যত্ন করে সড়িয়ে দিত সেগুলো সাগরিকার কপালের ওপর থেকে।কখনো টিপটা বেঁকে গেলে সপ্তক আবার ও সেটাকে যথাস্থানে পড়িয়ে দিত। নিজের জমানো টাকায় জুঁই ফুলের মালা কিনে সেটাকে বেঁধে দিত সাগরিকার ঘন কালো চুলে।
সাগরিকা তখন মনে মনে নিজেকে জগতের সবচেয়ে ভাগ্যবতী প্রেমিকা বলে মনে হতো।সে যে এইটুকুই চায় সপ্তকের থেকে। সাগরিকা দেখতো যে অন্য বান্ধবীদের তাদের প্রেমিকরা কত দামি দামি উপহার দিত কিন্তু সে কখনো সেসব কিছু চায়নি সপ্তকের থেকে।সে শুধু সপ্তককে ভালোবেসেছিল তার কাছ থেকে শুধু একটু সময়,সম্মান আর ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই চায়না সে। তার প্রতি সপ্তকের ছোট ছোট যত্ন গুলোই সাগরিকার মন খুশিতে ভরিয়ে তুলতো। সাগরিকা ও সপ্তকের পছন্দের খাবারগুলো নিজে হাতে বানিয়ে নিয়ে এসে খাইয়ে দিত সপ্তককে। সপ্তকের জন্মদিনে নিজে হাতে পায়েস বানিয়ে এনেছিল। সপ্তক সেদিন খুব খুশি হয়েছিল। সপ্তকের ও নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে হয়েছিল।
এইভাবে একে অপরের সঙ্গে সুখের স্বর্গে ভেসে ভেসে যে কখন তারা আরো একটা বছর পার করে দেয় নিজেরাই টের পায়না। এতদিন সবকিছু স্বপ্নের মতো কাটলেও এবার যে তাদের সম্পর্কে আসে সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত। এবার যে তাদের ছোট্ট মফঃস্বল ছেড়ে সপ্তককে পাড়ি দিতে হবে শহর কলকাতায় উচ্চ শিক্ষা লাভের আশায়। সাগরিকার মনে উথালপাথাল শুরু হয়।কি করে যে সে থাকবে সপ্তক কে ছেড়ে তা বুঝে পায়না। সপ্তক ও আশ্বাস দেয় যে তার এই চলে যাওয়া যে শুধু যেন তাদের জীবন ভবিষ্যতে সুরক্ষিত হয় সেজন্যই। একবার পড়াশোনা শেষ করে তো তারা একসাথেই থাকবে। তবু সাগরিকার চোখের জল যেন থামেনা কিন্তু সপ্তকের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে হাসিমুখে বিদায় জানায় তারা ভালোবাসাকে।
সপ্তক কলকাতা চলে যাওয়ার পর শুধুই ফোনে কথা হতো তাদের আর ছুটিতে বাড়ি এলে দেখা হতো।প্রথম খুব কষ্ট হলেও সাগরিকা হাসিমুখে মেনে নিয়েছিল সবকিছু। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই যেন সপ্তকের আচরণ বদলাতে শুরু করে।সে আর আগের মত প্রতিদিন ফোন করেনা সাগরিকাকে। করলেও কিছুক্ষনের মধ্যেই কেটে দেয়। সাগরিকার প্রতি আর যেন কোনো আন্তরিকতাই নেই সপ্তকের।সে যেন তার কাছে একটা বোঝা। সাগরিকা খুব কাঁদে।সে সপ্তককে জিজ্ঞেস করলে সে বলে,
অনেক পড়ার চাপ তাই আর সময় দেওয়া যাচ্ছে না।
সাগরিকা উত্তর দেয়,
কাজ তো সবার জীবনে সারাজীবনই থাকবে কিন্তু তাই বলে কি এটা যে নিজের প্রিয়জনকে কোনো সময় না দেওয়া বা তাদের সাথে ঠিক করে কথা পর্যন্ত না বলা। পড়াশোনা বা যেই কাজই করোনা কেন সেইসব কিছু তো এইজন্যই করা যাতে আমরা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আমাদের প্রিয়জনদের একটা সুন্দর সুরক্ষিত জীবন দিতে পারি। কিন্তু সেই প্রিয়জনকেই যদি আমরা অবহেলা করি তবে যে ভবিষ্যতে গাড়ি, বাড়ি সব হলেও মানুষ একা হয়ে পড়ে গো।
সপ্তক বিরক্ত হয়ে বলে,
উফফ, তোমার জ্ঞানের কথা রাখো তো।আমি রাখলাম।
বলেই ফোন কেটে দেয় সপ্তক। অপরদিকে কাঁন্নায় ভেঙে পড়ে সাগরিকা। ক্রমাগত চলতে থাকা ইঁদুর দৌড়ে যে সপ্তক মানুষ থেকে যন্ত্র মানব হয়ে গেছে।আর শুধু ব্যস্ততাই একমাত্র কারণ নয়, আসলে শহরে সপ্তকের অত্যাধুনিক মেয়ে বন্ধুদের পাশে কোথাও যেন সাগরিকাকে খুব ফিকে লাগে সপ্তকের।
সপ্তকের অবহেলাকে মেনে নিয়েই সাগরিকা চলতে থাকে। সাগরিকা অনেকবার দিনে সপ্তককে ফোন করে এই আশায় যে একবার অন্তত সে ধরবে কিন্তু সেই আশা আশাই থেকে যায়।সপ্তক কখনো তার ফোন ধরেনা। শুধু নিজের ইচ্ছে হলে কখনো একটু ফোন করে কিছুক্ষন কথা বলেই ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে ফোন কেটে দেয়। সাগরিকা সব মেনে নেয়।কোনো অভিযোগ সে করেনা কারন সে ভয় পেত সপ্তককে হারিয়ে ফেলার।সপ্তক যখন ছুটিতে আসতো তখন সাগরিকার জন্য নিয়ে আসতো অনেক ভালো ভালো উপহার। সাগরিকা সেগুলো হাসিমুখে গ্রহণ করলেও আসলে যে সে এসব কিছুই চায়না।সে যে শুধু চায় সপ্তকের একটু সময় আর ভালোবাসা। কিন্তু কোথাও যেন সেই ভালোবাসাটাই আর নেই।এখন আর সপ্তকের সময় নেই তার চুলে জুঁই ফুলের মালা বেঁধে দেওয়ার।
দেখতে দেখতে সময় এগোয়।সপ্তক এখন কলেজের ফাইনাল ইয়ারে এখন আরো কোনো সময় দেয়না সাগরিকাকে। তার কাছে এখন সে যেন শুধু এক বোঝা।
একদিন সাগরিকার মন খুব খারাপ ছিল। তার কলেজে একজনের সাথে কিছু ঝগড়া হয়েছিল তাই। খুব ইচ্ছা করছিল সপ্তকের সাথে একবার কথা বলে হালকা হতে। বারবার সে সপ্তককে ফোন করতে থাকে কিন্তু একটা প্রোজেক্টের কাজে ব্যস্ত থাকায় সপ্তক ফোন তোলেনা। কিন্তু সাগরিকা বারবার করতেই থাকে। অবশেষে একসময় সপ্তক বিরক্ত হয়ে ফোন তুলে বলে ওঠে,
তুমি আমাকে জ্বালিয়ে খাচ্ছো দেখছি।বোঝোনা যে আমি ব্যস্ত আছি। তোমাকে সেদিন প্রোপোজ করাটাই ভুল হয়েছিল। তুমি না থাকলে জীবনে আর কোনো ঝামেলাই থাকতো না।
সপ্তকের বলা শেষের কথাটায় সাগরিকার পায়ের তলার মাটি কেঁপে ওঠে।সপ্তক যেদিন ওকে নিজের মনের কথা জানায় সেই দিনটা সাগরিকার জীবনের সবচেয়ে স্মরনীয় দিন আর সপ্তক কিনা বলছে ওই দিনটা ওর জীবনের ভুল ছিল।আর এখন সাগরিকাকে ঝামেলা মনে হচ্ছে।
সাগরিকা কাঁন্না ভেজা গলায় বলে ওঠে,
ঠিকাছে।এত যখন তোমার আমাকে ঝামেলা বলে মনে হচ্ছে তবে আর জ্বালাবো না তোমাকে।ভালো থেকো।
হ্যাঁ,আমি বাঁচবো তাহলে।আর পারছিনা এই সম্পর্কের বোঝা বইতে।
বলে ফোনটা কেটে দেয় সপ্তক।
দুচোখ বেয়ে নোনতা জলের ধারা নামতে থাকে সাগরিকার। মানুষ যে শুধু নিজের কেরিয়ার আর ভবিষ্যতে ভালো বাড়ি, গাড়ির আশায় নিজের প্রিয়জনকে এভাবে ছেড়ে দিতে পারে তা সাগরিকার স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।
এরপর থেকে আর কথা হয়নি সাগরিকা আর সপ্তকের। স্বপ্নের মতো সুন্দর প্রেম কাহিনীটা এক লহমায় ভেঙে যায়। সাগরিকা শক্ত রাখে নিজেকে। যাইহোক জীবনের সংগ্রামে সে হেরে যাবেনা। আরো ভালো করে নিজের পড়াশোনায় মন বসায় সাগরিকা। সপ্তককে ভুলতে বইয়ের সাগরে ডুব দেয় সে।
“ম্যাম, আমার হোমওয়ার্ক কমপ্লিট হয়ে গেছে। একবার চেক করে নিন”।
“বাহ্! তুমি তো একদম গুড গার্ল হয়ে গেছো।দেখি দাও আমায়”।
ক্লাস টু এর শ্রীয়ার হাত দিয়ে বাংলা হোমওয়ার্ক এর খাতাটা নেয় সাগরিকা চেক করার জন্য তারপর এক গাল হেসে সেটা ফেরত দেয়।
সাগরিকা এখন কলকাতা শহরের সানফ্লাওয়ার নামের এই প্রাইমারি স্কুলের বাংলার শিক্ষিকা।
সপ্তকের থেকে আলাদা হওয়ার প্রায় ১২ বছর কেটে গেছে।সে এখন চাকরি নিয়ে চলে এসেছে কলকাতা।এখন সাগরিকা জানেনা সপ্তক কোথায় আছে বা কেমন আছে।আর কখনো কোনো সম্পর্কে জড়ায়নি সাগরিকা।বাড়ি থেকে বারবার বিয়ের কথা বললেও সে রাজি হয়নি।আসলে আজো ভেতরে ভেতরে সপ্তককে সে ভুলতে পারেননি কিন্তু সেই কষ্ট ভুলিয়ে দেয় তার এই ছোট্ট ছোট্ট পড়ুয়ারা।সারাদিন ওদের নিয়েই ভালো ভাবে কেটে যায় সাগরিকার। সানফ্লাওয়ার স্কুলটাকেই সে ভালোবাসে সমগ্র হৃদয় দিয়ে।
আজকের এই ইংলিশ আর হিন্দির যুগে তার পড়ুয়াদের যেন বাংলার ভীত ভালো করে তৈরি হয় সেই বিষয় খুব খেয়াল রাখে সাগরিকা। কিন্তু তার খুব চিন্তা হয় পাঁচ কি ছয় বছরের ক্লাস ওয়ানের পিহুকে নিয়ে।মেয়েটা একেবারেই পড়াশোনা করতে চায়না। ক্লাসে চুপ হয়ে বসে থাকে। মনে হয় যেন সে খুব দুঃখি। সাগরিকা একদিন মাথায় হাত বুলিয়ে পিহুকে জিজ্ঞেস করে,
তোমার কি সমস্যা? তুমি কেন এরকম থাকো?কেন তুমি সবার সাথে খেলোনা?
পিহু প্রথমে চুপ করে থাকে তারপর ডুকরে কেঁদে উঠে বলে,
“আমার মা আর পাপা আমার সাথে একটুও টাইম স্পেন্ট করেনা।সবাই নিজের মতো বিসি তাই আমার ভালো লাগেনা কিছু”।
সাগরিকা পিহুর চোখের জল মুছিয়ে তাকে আদর করে দেয় অনেক তারপর ঠিক করে পিহুর গার্জিয়ান এর সাথে দেখা করবে।
পরদিন পিহুর মায়ের গাড়িটা ওদের স্কুলের সামনে এসে থামে। দামি সিল্ক এর শাড়ি, ঠোঁটে লিপস্টিক আর গলায় মোটা সোনার হার পরে পিহুর মা দেবিকা যখন স্কুলে ঢোকে তখন সাগরিকা তাকে দেখে অবাক হয়ে যায়।এর আগে কোনদিন কারোর গার্জিয়ানকে এত সেজে অন্তত স্কুলে আসতে দেখেনি।কোনো প্রোগ্রাম থাকলে তখন আলাদা ব্যাপার।
দেবিকা এসেই পিহুকে জিজ্ঞেস করে,
ম্যাম, আপনি আমাকে ডেকেছিলেন?
হ্যাঁ,বসুন।
দেবিকা চেয়ারে বসার পরে সাগরিকা জিজ্ঞেস করে,
আপনি কোথায় জব করেন?
আমি জব করিনা।আমি হাউস ওয়াইফ।
এবার সাগরিকা খানিকটা অবাক হয়ে যায়।যদিও হাউস ওয়াইফ রাও সারাদিন ঘরের যাবতীয় কাজ করে অনেক সময় সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেননা। কিন্তু দেবিকাকে দেখে মনে হচ্ছেনা ইনি সেই অর্থে ঘরের কোনো কাজ করে বলে।
এরপর সাগরিকা বলে,
আপনি কেন আপনার মেয়েকে সময় দেননা?আর শুধু আপনি কেন ওর বাবাও ওকে সময় দেয়না।আর পিহু এই নিয়ে খুবই ডিপ্রেশনে ভোগে যে আপনারা ওকে সময় দেননা আর সেই কারনে ও পড়াশোনাও ঠিক করে করতে পারছেনা।আর বিশেষ করে বাংলায় ও খুবই দূর্বল।
দেবিকা এবার খানিকক্ষণ চুপ থেকে আস্তে আস্তে বলে,
আসলে আমি খুবই এক্সট্রোভার্ট প্রকৃতির তাই বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে ভালোবাসি।আর তাই মাঝেমাঝে ওদের সাথে যখন ঘুড়তে যাই তখন ওকে টাইম দিতে পারিনা। তবে আমরা ওর কোনো অভাব রাখিনি। ব্র্যান্ডেড জুতো থেকে জামা বা ভালো ভালো নতুন মডেলের খেলনা সব আমরা কিনে দিয়েছি ওকে।ওর কোনো কষ্ট নেই।
এবার সাগরিকা বেশ রাগত স্বরে বলে ওঠে,
দেখুন বাচ্চাদের শুধু ভালো ভালো খেলনা বা জামা জুতো দেওয়া মানেই তাকে ভালো রাখা নয়। আপনাদের মেয়ে আপনাদের সঙ্গ চায় আর সেই অভাব দুনিয়ার সমস্ত দামি দামি জিনিসপত্র একজায়গায় মিলালেও পূর্ণ হবেনা। আপনারা কি করে ভেবে নিতে পারেন যে একটা মানুষকে ভালো রাখতে হলে তাকে শুধু ভালো ভালো জিনিসপত্র দিলেই সে খুশি হয়ে যাবে।
এবার দেবিকার মাথা নিচু হয়ে যায়। তারপর আমতা আমতা করে বলে,
আচ্ছা আমি চেষ্টা করবো ওকে সময় দেওয়ার। তবে একটা কথা বলার আছে।
হ্যাঁ,বলুন।
আসলে পিহু যে পড়াশোনায় খুব দূর্বল সেটা আমিও দেখেছি।এরম চলতে থাকলে হয়তো ফাইনালে পাশ করবেনা। আপনি যদি কাইন্ডলি ওকে টিউশন পড়ান বাড়ি এসে তো খুব ভালো হয়।
সাগরিকা কিছুক্ষন ভেবে তারপর বলে,
আমি টিউশন পড়াইনা তবে পিহুর জন্য আমি পড়াতে রাজি আছি।
দেবিকা হেসে উঠে বলে,
তবে সামনের মনডে আসবেন।আমি এ্যাড্রেসটা দিয়ে দিচ্ছি।
হ্যাঁ,ঠিকাছে। আমি পৌঁছে যাবো।
সামনের সোমবার পিহুদের বিশাল অ্যাপার্টমেন্টটার সামনে আসে সাগরিকা।দশতলায় পিহুদের ফ্ল্যাটটায় গিয়ে কলিং বেল বাজায় সাগরিকা। দেবিকা হাসিমুখে দরজা খুলে দেয় তারপর বলে,
ওইযে পিহু ওই পাশের রুমে আছে আর ওর বাবা এক মাসের জন্য অফিস ট্রিপে গেছে নইলে ওর সাথে আজই দেখা করিয়ে দিতাম আপনার।
সাগরিকা হেসে বলে,
সে পরে দেখা হয়ে যাবে কোনোদিন।
তারপর পিহুর রুমে ঢোকে সাগরিকা।মেয়েটা কেমন যেন চুপচাপ।ওর সমবয়সীদের চেয়ে অনেকটা আলাদা। সাগরিকা মনে মনে ভাবে যে আগে পিহুর জড়তাটা কাটাতে হবে।সে তাই পড়ানোর সাথে সাথে পিহুকে নানান গল্প শোনায়।তার সাথে খেলে।
সাগরিকা রোজ পড়াতে আসতে থাকে পিহুকে।বেশ সময় দেয় সে পিহুকে।তার সাথে অনেক গল্প করে। সাগরিকাকে পেয়ে যেন পিহু অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে অল্প সময়তেই।আর পড়াশোনাতেও মন বসেছে। কিন্তু এই কদিনে সাগরিকা দেখেছে যে দেবিকা মোটেই পিহুকে সময় দেয়না।সে সারাদিন নিজের বন্ধুবান্ধবের সাথে ফোনে কথা বলতে আর তাদের সাথে পার্টি, সিনেমা, রেস্টুরেন্ট এসবে ঘুরে ঘুরেই কাটায়। পিহুর কথা শোনার ও দেবিকার সময় নেই।
দেবিকার থেকে সাগরিকা জানতে পেরেছে যে পিহুর বাবা এক নামি এম এন সি তে কাজ করে।আর দেবিকাকে আইফোন,গয়না, শাড়ি কত ভালো ভালো গিফ্ট দেয়।আর দেবিকাও যেন শুধু সেইসব দামি দামি উপহার পেয়েই খুশি। ভালোবাসার মানুষটার যত্ন বা সময়ের কোনো চাহিদা বা মূল্য নেই তার কাছে।
দেখতে দেখতে এক মাস কেটে যায়। সাগরিকা সেদিন পিহুকে পড়াচ্ছিল ঘরে হঠাৎ দরজায় কলিং বেলের শব্দ হয়।দেবিকা ওয়াশরুমে ছিল তাই সাগরিকা দরজা খুলতে যায়। দরজাটা খুলে তার সমগ্র পৃথিবী কেঁপে ওঠে।যাকে সে প্রতিদিন ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে নিয়তি আজ আবার তাকে তার সামনেই এনে দাঁড় করিয়েছে। দরজার ওপারে যে দাঁড়িয়ে আছে সে সপ্তক।তার জীবনের একমাত্র প্রেম। সপ্তক ও স্তম্ভিত হয়ে গেছে সাগরিকাকে দেখে।সে ও যেন বাক্ শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।এর মধ্যেই দেবিকা ও এসে গেছে।দেবিকা এসেই বলে,
আরে তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এসো।
সপ্তক কোনোমতে একটা ঘোরের মধ্যে ভেতরে আসে। তারপর দেবিকা বলে,
ও আমার হাসব্যান্ড সপ্তক বোস আর সপ্তক উনি হলো পিহুর টিচার সাগরিকা সেন। উনি এখন পিহুকে টিউশন পড়াচ্ছেন।
সাগরিকার চোখ দিয়ে বিন্দু বিন্দু জল গড়িয়ে পড়েছে। ঈশ্বর যে তাকে এমন পরিস্থিতিতে ফেলবে সে আশা করেনি কখনো। ইচ্ছে করছিল এক্ষুনি বেরিয়ে চলে যাক কিন্তু ততক্ষণে ছোট্ট পিহু এসে তার হাত ধরে বলছে,
ম্যাম ঘরে চলো।এখনো তো পড়া বাকি অনেক।
পিহুর মায়ায় ভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে সাগরিকা আর যেতে পারেনা।সে ভাবে যাই হয়ে যাক না কেন পিহুকে ও পড়াবেই।
এরপর থেকে সপ্তকের উপস্থিতিতেই পিহুকে পড়াতে আসে সাগরিকা। কিন্তু কোনোদিন কোনো কথা বলেনি সপ্তকের সাথে।আজ সপ্তকের ও নিজেকে অভাগা বলে মনে হয় সাগরিকাকে হারিয়ে ফেলার জন্য।দেবিকা শুধুই তার টাকাকে ভালোবাসে তাকে নয় সেটা সপ্তক বোঝে। সাগরিকা একসময় সপ্তকের একটু সময় আর সঙ্গ পাওয়ার জন্য যতটা কষ্ট পেয়েছিল আজ সপ্তক ও ঠিক তেমনই বেদনা অনুভব করে।কারন আজ তার স্ত্রী তার জীবন সঙ্গীনির তার জন্য কোনো সময় নেই।সে সারাদিন ব্যস্ত তার বন্ধুদের সাথে। শুধু যখন কোনো নতুন গয়না বা দামি কোনো জিনিসের দরকার পরে তখনই তার দরকার পরে সপ্তককে।আর কখনো সপ্তক না করলেই শুরু হয় ঝগড়া অশান্তি। সারাদিন কাজের পর রাতে শোবার সময় সপ্তকের খুব ইচ্ছে করে যে কেউ ভালোবেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিক কিন্তু দেবিকার মধ্যে সেই আন্তরিকতাই নেই। প্রতিবার সপ্তকের জন্মদিনে বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করে দেবিকা আর তখন খুব মনে পড়ে সাগরিকার হাতের সেই পায়েসের কথা।
আজকের এই বাড়ি, গাড়ি পাওয়ার আশায় সপ্তক যে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদটাই হারিয়েছে সেটা আজ বুঝেছে সপ্তক।একসময় নিজের আধুনিক বান্ধবীদের ভিড়ে ফিকে লাগা সাগরিকাই যে ছিল তার জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র সেটা আজ উপলব্ধি করতে পেরেছে সপ্তক।
দেখতে ৩০শে জুলাই দিনটা আসে।
আজ সপ্তকের জন্মদিন। সাগরিকাকে আজ তাদের বাড়িতেই খেতে বলেছে দেবিকা। সাগরিকা গিয়ে দেখে সবই বাইরে থেকে আনানো।এত সব ভালো ভালো খাবারের মাঝেও সপ্তকের খুব মনে পড়ছিল সাগরিকার হাতের সেই পায়েসের কথা। সপ্তকের চোখে মুখে ফুটে ওঠা সেই বেদনার ছাপ সাগরিকার চোখ এড়ালো না। খাওয়া শেষে দেবিকা তার কোনো এক বান্ধবীর সাথে কথা বলতে পাশের ঘরে চলে গেল।পিহু ও ঘুমিয়ে পড়েছিল। এই ঘরে তখন শুধু সপ্তক আর সাগরিকা একা। সপ্তকের আর সাহস নেই সাগরিকার চোখের দিকে তাকানোর।সে মাথা নিচু করে বসে আছে। সাগরিকা হঠাৎই একটা টিফিন বক্স সপ্তকের সামনে রেখে বলে ওঠে,
শুভ জন্মদিন সপ্তক।
এতদিনে এই প্রথম সপ্তকের উদ্দেশ্যে সাগরিকা কোনো কথা বললো।
সপ্তকের মন খুশিতে ভরে উঠলো।সে তাড়াতাড়ি টিফিন বক্সটা খুললো।তারপর সেই চেনা সুগন্ধে সপ্তকের চোখে আনন্দে জল চলে এলো।এত বছর পর আবার সেই সাগরিকার হাতের পায়েস। সপ্তক পরম আনন্দে সেটা খেতে শুরু করলো।মন প্রাণ যেন আনন্দে ভরে উঠলো।খাওয়া শেষ করে সে সাগরিকাকে বললো,
অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।এটা আমার জন্মদিনের শ্রেষ্ঠ উপহার।
সাগরিকা আর কিছু বললোনা শুধু নিরবে চোখের জল মুছে ধীরে ধীরে বেড়িয়ে গেল সেখান দিয়ে।
দেখতে দেখতে পিহুর ফাইনাল পরীক্ষার সময় এলো। একদিন দেবিকা এসে সাগরিকাকে বললো,
সপ্তকের ব্যাঙ্গালোরে ট্রান্সফার হয়ে গেছে।পিহুর ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেড়োতেই আমরা সেখানে শিফ্ট করে যাবো। সাগরিকার চোখে জল চলে আসে সেটা শুনে।পিহুকে সে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবেসেছে তাকে ছেড়ে এবার থাকবে কিকরে ও। সাগরিকার মনে হয় তার হৃদয় মাঝে কেউ যেন একটা বড়ো পাথর চাপিয়ে দিয়ে গেছে। কোনোমতে নিজেকে সামলায় সে।
দেখতে দেখতে পিহুর ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। এইসময় পিহুর পড়াশোনার প্রতি খুব যত্ন নিয়েছে সাগরিকা।পিহু আগের থেকে অনেক উন্নতি ও করেছে। সাগরিকার বিশ্বাস পিহু নিশ্চিত ভালো করবে।
ফাইনাল শেষ হয়ে যায় আর রেজাল্টের দিন ও এসে যায়।যেই পিহুর পাশ করার আশা ছিলনা সে সব বিষয়ে ভালো নম্বর পেয়েছে।বিশেষ করে বাংলায় তো খুবই ভালো করেছে।
সাগরিকার মনে ও আনন্দের শেষ নেই।আজ সত্যি যেন তার সাফল্য।পিহুর রেজাল্ট নিতে পিহুকে সঙ্গে করে সপ্তক আর দেবিকা দুজনেই আসে। দেবিকা এসে সাগরিকাকে বলে,
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি না থাকলে আমার মেয়েটা এত ভালো রেজাল্ট করতোনা।আর কালকেই আমাদের ফ্লাইট।আমরা ব্যাঙ্গালোরে শিফ্ট করে যাচ্ছি।
শেষের কথাটায় সাগরিকার চোখে আবার ও জল চলে আসে।পিহু ও ডুকরে কেঁদে উঠে বলে,
আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবনা ম্যাম।
সাগরিকা পিহুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে,
কাঁদেনা সোনা। আমাদের আবার দেখা হবে কোনোদিন। যেদিন তুমি অনেক বড়ো হয়ে যাবে সেদিন আবার দেখা হবে আমাদের।
এরপর ওরা নিজেদের গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। সাগরিকা শোকে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে স্কুলের গেটে।পিহু আর দেবিকা গাড়িতে গিয়ে বসলেন সপ্তক হঠাৎই পিছন ঘুরে এসে দাঁড়ায় সাগরিকার সামনে। তারপর বলে,
সাগরিকা,আজ আমার সব আছে শুধু নেই আমার জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সম্পদটা।যেটা ছিলে তুমি।এই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বার্থে আমি যে আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকেই হারিয়ে ফেলেছি সাগরিকা।এই গাড়ি,বাড়ি, ভালো চাকরি সবকিছু পেয়েও তোমাকে হারিয়ে আজ নিজেকে নিঃস্ব বলে মনে হয় আমার। তোমার ভালোবাসার মর্ম না বুঝে তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। পারলে আমাকে ক্ষমা করো।
সাগরিকা উত্তর দেয়,
আমি তোমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছি তাই আমাকে আর নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলোনা।এখন যদি কেউ তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হয় তবে সে হলো পিহু। শুধু ভালো ভালো জিনিসপত্র কিনে দিলেই যে বাবা মায়ের কর্তব্য শেষ হয়না।ও তোমার সময় আর ভালোবাসা চায় সপ্তক।ও যে বড়োই একা। এবার তোমার ব্যস্ত জীবন থেকে ওকে একটু সময় দিও।এই আমার তোমার থেকে শেষ চাওয়া।
সপ্তকের চোখ দিয়ে বিন্দু বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ে।সে কাঁন্না ভেজা স্বরে বলে,
হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আমার কর্তব্য পিহুকে সময় দেওয়া।আমি আমার কর্তব্য পালনে এবার আর কোনো গাফিলতি করবোনা।পিহুকে আমি পর্যাপ্ত সময় দেবো তোমাকে কথা দিলাম আমি।
সাগরিকার ঠোঁটে এবার হাসি ফুটে ওঠে।
দেবিকা ও গাড়ি থেকে সপ্তককে আওয়াজ দেয়,
আরে তাড়াতাড়ি আসো।কাল ভোরেই তো বেরোতে হবে।
সপ্তক পিছন ফিরে এগিয়ে চলে গাড়ির দিকে। সাগরিকা ও পিছন ফিরে এগিয়ে চলে গেট পেরিয়ে সানফ্লাওয়ার স্কুলের ভিতরে। একসময় শুরু হওয়া স্বপ্নের মতো সুন্দর প্রেম কাহিনীটার কারিগর দুজনের পথ আজ আলাদা। সপ্তক এগিয়ে চলে তার স্ত্রী আর সন্তানকে নিয়ে আরো এক নতুন জীবন শুরু করতে।আর সাগরিকা যে ভালোবেসে আজো কাঁদে সে এগিয়ে চলে এখনের নিজের একমাত্র ভালোবাসা তার ছোট্ট ফুলের মতো পড়ুয়াদের কাছে। তার স্বপ্নের স্কুল সানফ্লাওয়ার এর দিকে।এখন এটাই তার পরিবার।
এইভাবেই বহু সাগরিকা আর সপ্তক আলাদা হয়ে যায়। তারপর যখন মানুষের কাছে সব থাকে তখন সে বুঝতে পারে যে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান রত্নটাই যে আর নেই।আর হাজারো চেষ্টা করলেও তাকে ফেরত পাওয়া যাবেনা। তখন সব থেকেও মানুষ নিঃস্ব হয়ে যায়। তখন হাজারো মানুষের ভীড়েও নিজেকে একা বলে অনুভব হয়।তাই সময় থাকতে নিজের প্রিয় মানুষের মর্ম বোঝা উচিত। নিজের প্রিয় মানুষদের ছাড়া যে সব থেকেও জীবন বড়ো কষ্টদায়ক।
একজন ছাত্রী ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বাসিন্দা।গল্প পড়তে আর লিখতে এবং আবৃত্তি পরিবেশন করতে আমি ভালোবাসি।