অঙ্কন : নীলাঞ্জনা সরকার

শরৎ এসেছে….
ত্রিনয়নীর অপেক্ষায় লাল ডুরে শাড়ি পরে ছোটো মেয়েটি পুকুর ঘাটে বসে। মায়ের কাছে গল্প শুনেছিল সে ঈশ্বরী পাটনির তাই আজ অপরিসীম কৌতূহল তার। কি যে হলো কিছুদিন ধরে সে কিছুই বুঝতে পারছে না! দোষের মধ্যে সে কদিন আগে মা দুগ্গা আসার আনন্দে সন্ধ্যেবেলা গ্রামের বড় মাঠে গিয়েছিল- যেখানে অনেকে মিলে বড়, অনেক উঁচু প্যান্ডেল বানাচ্ছে। মেয়েটি তার নিষ্পাপ হাসিতে কলকলিয়ে উঠেছিল, চারপাশের বুনো অন্ধকার টের পায়নি সে। স্বতস্ফূর্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল -ও কাকু, দুগ্গা আসতে আর কত দেরি!
এই তো রে, আর মাত্র কদিন।
কাকু খুব হেসে কথা বলায় সরল মেয়েটি কাকুর পাশে পাশেই ঘোরে আর এটা সেটা জিজ্ঞেস করে।
মেয়েটির হাতে ছিল একটা ভেঙ্গে নেওয়া কাশফুল। তাদের গ্রামে ছড়িয়ে আছে এখন এই ফুল। বেশ কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরে মাঠের পাশের একটা পুরোনো পাঁচিলের ওপর উঠে বসেছিল সে। পা দুলিয়ে দুলিয়ে আপন মনে নিজের হাতের ছোট ছোট সুন্দর আঙ্গুলগুলো দিয়ে কাশফুলের গায়ে হাত বোলাচ্ছিল। কি নরম! ঠিক মায়ের হাতের মতো।
কি রে বাড়ি যাবি না?
হ্যাঁ কাকু, যাবো তো।
চল, পৌঁছে দি। উঠে আয় আমার সাইকেলে।
মেয়েটির এ সৌভাগ্য আগে কোনোদিন হয়নি তাই স্বাভাবিক ভাবেই সে খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ে। বাড়ির পথে চলে সে কাকুর সাইকেলের সামনে বসে। মাঠ, গাছ, গরু, ছাগলের পাল সব নিমেষে পিছনে পড়ে রইলো আর সে চললো হাওয়ার বেগে। কত কিছু মনের মধ্যে আসতে লাগলো তার…..
আচ্ছা, পোস্টমাস্টার কাকু তাই এত তাড়াতাড়ি সবার বাড়ি পৌঁছে যায়! আর ওই স্কুলের মাস্টারবাবু সেও।
উফ্! কি সুন্দর ঠাণ্ডা হাওয়া, বাবারে বাবা!
জানো কাকু, আজ পুটি খুব রেগে যাবে।
কেন রে? পুটি কে হয় তোর?
কে আবার! আমার বোন। ওকে না বলেই চলে এসেছি আজ একা একা। ও তখন ঘুমাচ্ছিল যে।কাকু সাইকেল থামায়। মেয়েটি দেখে চারিদিক ফাঁকা।
কোথায় এলাম গো কাকু?
সাইকেল চড়ার আনন্দে বাড়ির রাস্তাটাও খেয়াল করলি না? কি মেয়েরে তুই … কাকু হাসে এক নেকড়ের হাসি।
ভয় পায় ছোট মেয়েটি। কাকু সুর পাল্টে বলে –
চল না ! লজেন্স খাবি?
ভয় ভুলে আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে ছোট মেয়েটি। এতে তার কি দোষ বলো! সে কালেভদ্রে লজেন্স খেতে পায়….
কিন্তু অন্ধকারে লজেন্সের মিষ্টি স্বাদের বদলে সে রক্তের নোনা স্বাদ পায়। মায়ের পরিয়ে দেওয়া শাড়ি ছিড়ে যায় তার। আমপাতায় পাতা কাজল পড়ানো চোখে কাকুর রূপ বদলে যেতে দেখে সে। সত্যিই তো
তার কি দোষ বলো! কেউ কি তাকে বলেছিল –
ওরে মেয়ে, অচেনা মানুষের এত কাছে যাস না।
সে তো জানেই না বুনো অন্ধকার কি? সে তো জানে কাকুর হাতের বানানো বাড়িতে মা দুগ্গা বসে। সেই হাত দিয়ে যে কুমারী পুজো হয় না তা ও মেয়ে বুঝবে কেমন করে?
মাটি মাখা ছেড়া শাড়িতে বাড়ি পৌঁছায় সন্ধেবেলায়। ওই কাকুই পৌঁছে দিয়েছিল আর অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছিল। সারা শরীরে ব্যথা নিয়ে মার কাছে গিয়েছিল ছোট মেয়েটি। মা চোখের জলে তাকে পরিষ্কার করেছিল আর বলেছিল –
দুগ্গা, কাউকে কিছু বলিস না মা আমার। লোক জানাজানি হলে মুখ দেখাতে পারবো না।
মেয়েটি অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে তাতেই সায় দিয়েছিল।
কিন্তু তবু জানাজানি হলো, কি করে তা এই রক্ত মাংসের দুগ্গা জানেনা, বোঝেও না। আজও সে পুকুর পাড়ে বসে অভিমানে চোখের জল পোছে আর ভাবে-
সে যখন রোজ পুকুর সাঁতরে এপার ওপার করে জেতে, কই! কেউ তো তাকে নিয়ে আনন্দ করে না?
আর সে বার পলাশ, পুটি দৌড়ে তার থেকে হেরে গেল। সেবার!
কত ইচ্ছে হলেও বাকিদের মত স্কুল যেতে পারে না সে।
আর মা খালি তাকেই বকে, কি এমন করলো সে! মা তাকে মরতে বললো আজ। আরও বললো এ সমাজে তার জায়গা নেই।
আচ্ছা, সমাজ কি? সে কি ওই মাটির ঠাকুরের থেকেও বড়?
বুঝে পায়না সে। দুগ্গার জল ভরা চোখ দেখে সামনে সূর্যাস্তের আলো বুঝি মন ভোলায় তার। জলের ঢেউয়ে সেই সূর্যের আলো সিঁদুরের লেপ্টে যাওয়া লাল টিপ। মায়ের কপালেও তো এমন টিপ।
মন কেমন করে ওঠে তার, দৌড় লাগায় বাড়ির দিকে। শুনতে পায় মা আসলে বলছে –

।। দুগ্গা লাঠি ধর তুই।।

 

 

কলমে নীলাঞ্জনা সরকার, মুম্বাই

বিভিন্ন পত্রিকা,অন্তর্জাল ম্যাগাজিন এ নিয়মিত গল্প এবং কবিতা লেখার সাথে যুক্ত। এছাড়াও লাবণ্য পত্রিকার সম্পাদকীয় গ্রুপের একজন সক্রিয় সদস্য। বর্তমানে ‘ কুহক ‘ গল্পসমগ্র রচনার মাধ্যমে রহস্যময় জীবনের নানা দিক তুলে ধরেছেন।


পড়ুন ‘গল্প‘ : আলেখ্য সংস্করণ ১


SOURCEনীলাঞ্জনা সরকার
Previous articleশাম্ভবী
Next articleবোধন
Avatar
Disclaimer: Monomousumi is not responsible for any wrong facts presented in the articles by the authors. The opinion, facts, grammatical issues or issues related sentence framing etc. are personal to the respective authors. We have not edited the article. All attempts were taken to prohibit copyright infringement, plagiarism and wrong information. We are strongly against copyright violation. In case of any copyright infringement issues, please write to us. লেখার মন্তব্য এবং ভাবনা, লেখকের নিজস্ব - কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত..................

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here