মানবতার জন্য বিতর্ক। নামের মধ্যেই যেন মানবতা, মানুষের জন্য ভালোবাসা মিশে আছে। কী অসাধারণ একটি উদ্যোগ। বিতর্ক আমরা অনেকেই করি, কিন্তু মানবতার জন্য বিতর্ক করে কতজন? বিতর্ক আমাদের অন্যের বক্তব্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায়, পরমতসহিষ্ঞুতা শেখায় কিন্তু মানবতা শেখায় কী? শেখায়, মানবতা অর্জনে সহায়তা করে। বাংলাদেশের একটি ছোট্ট শহর নারায়ণগঞ্জে ডিএফএইচ (ডিবেট ফর হিউম্যানিটি) নামক একটি সংস্থা রয়েছে যা মানুষের মাঝে মানবতা জাগরণের মহত দায়িত্বটি নিয়েছে। আমার কথাটি শুনতে হয়তো হাস্যকর লাগছে। মানুষের মাঝে আবার মানবতা জাগাবে কেমন করে? পরিবার আছে কী করতে? কিন্তু আমাদের দেশের সাপেক্ষে তা খুব একটি হাস্যকর নয়। তার কারণ আমাদের দেশে যখন একজন শিশুর ভালো-মন্দ শেখার কথা তখন তারা দেখছে তাদের বাবা-মা ফোনে মিথ্যে কথা বলছে, অন্যের জিনিস নিয়ে নিচ্ছে। তাই সে শিশুকাল থেকেই সে শিখছে নিজের প্রয়োজনে মিথ্যা কথা বলাই যায়, পাপ কাজ করলে তেমন কিছুই হয় না। আমাদের পৃথিবীতে এখন পৈশাচিক সময় চলছে, ভাইরাসের প্রলয়ংকরী তান্ডবে পুরো পৃথিবী আজ শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়িয়ছে। এই সময়টা মনুষ্যজাতিকে পরীক্ষা করা হচ্ছে, মানুষ তো মানুষেরই জন্য এটা কী শুধুই কথার কথা না সত্য? পৃথিবীর এই অসহায় সময়ে যখন দরিদ্র মানুষেরা না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে তখন ধনী দেশগুলো নিজেদের ক্ষমতা দেখাতে ব্যস্ত। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্র যখন কোটি কোটি টাকা ত্রাণ দিচ্ছে তখন কিছু মানুষ রয়েছে ত্রাণ লোপাট করায় ব্যস্ত। এই কী মানুষ আমরা, এই আমাদের মনুষ্যত্ব, এই আমাদের মানবতা? এই প্রশ্নগুলো, এই অভিযোগগুলো কার কাছে, এই নির্মম অমানবিক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ কার কাছে? বিশ্ববাসীর কাছে, মানবতার কাছে, আমার কাছে। চারপাশে যখন মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা করাই প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন মানুষ তার মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে অর্থ উপার্জনে মগ্ন। আবার আমাদের দেশের কিছু দরিদ্র মানুষ তাদের সর্বস্ব দিয়ে দিয়েছে মানুষের কল্যাণে। কিন্তু মন্দ মানুষদের জন্য অপরাধ বেড়েই চলেছে। তার কারনও স্পষ্ট, ব্যধিই মাত্র সংক্রামক স্বাস্থ্য নয়। এসব পরিস্থিতিতে যখন আমি নিজেকে নিয়ে হতাশাগ্রস্ত, মানবিকতার বিপর্যয়ে যখন আমি দু:খভারাক্রান্ত তখন মানবিকতার পরশ ছুঁয়েছে ডিএফএইচ।
এই সংস্থাটিতে মোট সাতশত শিক্ষার্থী রয়েছে। সবাই মেধাবী ছাত্র- ছাত্রী। এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০১৭(দুই হাজার সতের সালে)। যাত্রা শুরু করেছিল পঞ্চাশ জন শিক্ষার্থী নিয়ে। যাত্রা পথের অনেক প্রতিকূলতা ছিল। কিন্তু উদ্যোগ- উদ্যম ও সাহসিকতার সাথে সবাই সংস্থাটিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। বর্তমানে সংস্থাটি জাতীয় পর্যায়ের সব বিতার্ককদের নিয়ে কাজ করে। সাথে আরো একটি কাজও করে। এই সংস্থার সকল স্বেচ্ছাসেবকেরা দৈনিক ষাটজনের খাবারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। মানবসেবার মূর্ত প্রতীক ডিএফএইচ। বিভিন্ন উত্সবে জামা- কাপড় বিতরণ করে এই সংস্থা। সবার মানবসেবার এই মহান ব্রতীদের জন্য শ্লোগান শুভেচ্ছা অপরাজিত আলো। আসলেই তারা অপরাজিত আলো, তাদের তেজকে রোধ করার মতো শক্তি কোনো দুষ্টু চক্রের নেই। সব পরিস্থিতিতে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাওয়া শিখিয়েছে আমাদের। সবচেয়ে অবাক করা তথ্য হচ্ছে ডিএফএইচ কোনো বড় মানুষ চালায় না বরং চালায় মানবপ্রেমী কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর। সবার আর্থিক অবস্থা সমান না হলেও তারা নিজের যতটুকু আছে তাই দিয়েই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই তাদের বৃত্তির টাকা, জমানো টাকা দিয়ে মানুষকে সাহায্য করেছে, দুস্থ- অসহায়দের সাহায্য করছে। মানুষকে এত নি:স্বার্থভাবে ভালোবাসা ইতিহাসে খুবই দুর্লভ। তারা সত্যে বজ্রের মতো কঠিন, বিশ্বাসে তারা অটল। তাদের বিশ্বাস এই পৃথিবীর কেটে যাবে অন্ধকার, আসবে আলো। লড়ব আমরা এবং জিতবও আমরা।
ডিএফএইচের সবচেয়ে বড় অবদান একজন মেয়ের প্রাণ বাঁচানো। এই সংস্থার একজন সদস্য একটি মেয়েকে বাঁচানোর জন্য নিজে এসিড নিক্ষেপের শিকার হয়েছে। ডিএফএইচ সর্বত্র তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করছে। বৃদ্ধাশ্রম, অনাথাশ্রম তৈরী করেছে। বৃদ্ধাশ্রমের একজন মহিলার কথা না বললেই নয়। তাদের একটাই ছেলে ছিল। তারা তাদের ছেলেকে উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা পাঠায়। তারপর তার স্বামী মারা যায়। ছেলেটা তার বাবাকে দেখতে পর্যন্ত আসে না। এরপর দেশে ফিরে তার মাকে বাসা থেকে বের করে দেয়। মহিলাটি যখন আত্মহত্যা করতে নেয় তখন তাকে রক্ষা করে ডিএফএইচ। তিনি এখন এই সংস্থাটিতে আছেন এবং ভালো আছেন।
ডিএফএইচ এর জন্যই পৃথিবীতে মানবিকতা এখনো রয়েছে। ডিএফএইচ আমাকে শিখিয়েছে দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশের মাঝে উদারতা আছে, নীল জলের স্বচ্ছতা মানুষকে নির্মল জীবনের অনুপ্রেরণা দেয়, মাটি আমাদের ধৈর্য্য ধারণ করতে শেখায়, ঝর্ণা আপন গতিতে ছুটে চলতে বলে। মানুষকে ভালোবাসা, মানুষের জন্য কাজ করার জন্য যে মানসিকতা লাগে তা ডিএফএইচ বুঝিয়েছে। আমি জানি আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা হয়তো সফল হবে না, তবুও মানুষের জন্য যতদিন করা যায়।
স্বপ্নডানা নামটি কী সুন্দর! তাইনা? এটি কোনো সংস্থা নয়, বরং একটি স্কুল। স্বপ্নডানা স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছে ডিএফএইচ। এখানে সব পথশিশুদের বিনামূল্যে পাঠদান করা হয়। সহায়- সম্বলহীন সব শিশুরা এখানে পড়তে পারে। করোনার এই সময়ে তারা পড়াশোনা করতে পারছে না ঠিকই, কিন্তু ডিএফএইচ তাদের মাস্ক, সাবান,খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করছে। তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, মনোবল বৃদ্ধি করেছে। তাদের মত সাহসী যোদ্ধারা কখনোই প্রতিকূলতায় হার মানে না।
ডিএফএইচ আরও একটি উদ্যোগ নিয়েছে বই পড়া কর্মসূচী। এ সংস্থাটি সকলকে বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলছে। পাশাপাশি, বই বিতরণও করছে।বই পড়ার এই কর্মসূচীটি আমাদের বই পড়ার জন্য অনুপ্রাণিত করে। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন,
“ শিক্ষার সর্বপ্রধান অঙ্গ সাহিত্য চর্চা”।
তাই ডিএফএইচ কিশোরদের নিয়ে গল্প লেখার প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। ম্যাগাজিন পড়ায় উত্সাহ দিচ্ছে। মেধার যথাযথ বিকাশে সাহায্য করছে। ডিএফএইচ এর এসকল কার্যক্রম আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি চাই পৃথিবীতে মানুষের মানবিকতা সবসময় অক্ষুন্ন থাকুক। সফল হোক এই মনুষ্যত্বের যাত্রা।