“দাদান দাদান, সেই বাঘের গল্পটা বলো না”, ছয় বছরের ছোট্ট বাবান এক হাতে ওর খেলনা বাঘের সফট্ টয়টা নিয়ে অন্য হাত দিয়ে আবদারের সুরে বিপিনবাবুর আকাশী রঙের হাফ হাতা পাঞ্জাবির বাঁ দিকের পকেটে টান দিল। বাবান তাঁর একমাত্র পুত্রের একমাত্র পুত্র, খুব আদরের। বিপিনবাবুর বয়স তা প্রায় পঁয়ষট্টি হবে। এখন নাতির সঙ্গেই খেলা করে, গল্প-গুজব করে তাঁর সময় কেটে যায়; নাতিটিও বেশ ভালো, চুপ করে বসে দাদুর কাছে গল্প শোনে। তার সবথেকে প্রিয় গল্প হচ্ছে বাঘের গল্প। বিপিনবাবু রকিং চেয়ারে বসে পেপার পড়ছিলেন, বাবান এসে ডাকতেই পেপার থেকে মুখ তুলে বললেন,”একটু দাঁড়াও দাদুভাই, আমি পড়া শেষ করেই তোমাকে শোনাব, ততক্ষণ তুমি একটু খেলা করে নাও”। কিন্তু বাবান কিছুতেই শুনবে না, সে গল্প শুনবে এখন। অগত্যা বিপিনবাবু পেপারটা ভাঁজ করে টেবিলে রেখে বাবানকে বললেন খাটে উঠে পড়তে। বাবান কথামতো বিছানায় উঠে বসল। তারপর তিনি বলতে শুরু করলেন,”দাদুভাই আজকে একটা বড় গল্প শোনাব কেমন। সার্কাস, বাঘ আর একজন রিং মাস্টারের গল্প”।
“রিং মাস্টার কী দাদান?”, প্রশ্ন করল বাবান। “যারা সার্কাসে খেলা দেখায়, পরিচালনা করে তাদেরকে বলা হয় রিং মাস্টার, বুঝলে? তুমি চুপ করে শুনবে, কোনো কথা কিন্তু মাঝখানে বলবে না”।
“হ্যাঁ” বলে ঘাড় নাড়াল বাবান। “তো আজকে বলব সেই রিং মাস্টারের কাহিনী যে কিনা বাঘের খেলা দেখাত”। বাবান ওর চোখ দু’টো গোল গোল করে তাকিয়ে থাকল বিপিনবাবুর দিকে।
বিপিনবাবু শুরু করলেন তাঁর গল্প। “সে অনেক বছর আগের কথা। খুব নামকরা একটা সার্কাস দল ছিল,’দ্য গ্রেট প্লেজ়েন্ট সার্কাস’ ছিল তার নাম। আর সেই সার্কাসের প্রধান আকর্ষণ ছিল একটা বাঘ আর একজন রিং মাস্টার। বাঘ বললে ভুল হবে, সে ছিল বাঘিনী।”
“দাদান, বাঘিনী কী?” বিপিনবাবুকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল বাবান। “দাদুভাই তোমাকে বলেছি না গল্প বলার মাঝে কোনো কথা না বলতে তাহলে গল্প বলার মজাটাই মাটি হয়ে যায়। একদম শেষে জিজ্ঞাসা করবে। যাইহোক, স্ত্রী বাঘকে বলা হয় বাঘিনী, এটা মনে রেখো।” বিপিনবাবু উত্তর দিলেন। বাবানও ” ওহ্ বুঝতে পেরেছি, বাঘের বউকে বলে বাঘিনী। আচ্ছা, ভুল হয়ে গেছে, সরি, আর কথা বলব না।”
বিপিনবাবু হেসে আবার শুরু করলেন তাঁর গল্প। “সেই বাঘিনীর নাম ছিল তন্দ্রা আর তার রিং মাস্টার ছিলেন বিখ্যাত বাবু মাস্টার। তন্দ্রা নামটা অবশ্য তাঁরই দেওয়া, বাবু মাস্টার আদর করে ডাকতেন তন্দ্রাসুন্দরী বলে। কারণ তন্দ্রাসুন্দরী শুধু নামেই সুন্দরী ছিল না, দেখতেও ছিল অসাধারণ”। বাবান আবার মুখে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হেসে বলে উঠল,”বাঘের নাম তন্দ্রাসুন্দরী”। বিপিনবাবু “উঃ দাদুভাই, বাঙালি বাঘের বাঙালি নাম, এটাই তো স্বাভাবিক, তাই নয় কি?” বলে বলতে থাকলেন গল্প। “তার হলুদ-কালো ডোরাকাটা লোমশ শরীরে রোদের আলো পড়লে চিকচিক করে উঠত, চলাফেরায় ছিল একজন রানির মতো গাম্ভীর্য, আওয়াজ ছিল গমগমে, হাঁটার সময় সে মাথা উঁচু করে হাঁটত আর একটু নম্র স্বভাবের ছিল, খাওয়ার সময় ছাড়া অন্য সময়ে কেউ ওর গায়ে হাত দিলে কিছু করত না। অন্য আরো বাঘ, বাঘিনী থাকলেও তন্দ্রাসুন্দরীর জন্যই প্লেজ়েন্ট সার্কাসের খুব রমরমা অবস্থা ছিল, আর সাথে তো ছিলেনই বাবু মাস্টার, তিনি খুব ভালোবাসতেন এই বাঘিনীটিকে। এই দু’জন ধীরে ধীরে বাকি সার্কাস দলের ঈর্ষার কারণ হয়ে উঠছিল। ঈর্ষা মানে হচ্ছে হিংসা। বুঝলে দাদুভাই হিংসা খুব খারাপ জিনিস। বাবু মাস্টার জেলার বিভিন্ন শহর ছাড়িয়ে দেশের বড় বড় শহরে তাঁবু ফেলতে লাগলেন। একের পর এক শো, প্রচুর টাকা, খ্যাতি সব বাবু মাস্টারের ঝুলিতে জমা হতে থাকল। কিন্তু এত সুখ বাবু মাস্টারের কপালে বেশিদিন সইলো না। তন্দ্রাসুন্দরী তখন গর্ভবতী, কিন্তু তাকে ছাড়া শো চলবে না। অতএব রিং মাস্টার তন্দ্রাসুন্দরীকে কিছু মাসের বিশ্রাম দিলেন। তিনি বাড়ি এসে জমি কেনা-বেচার কাজে হাত দিলেন। বাড়িতে তাঁর স্ত্রী ছাড়াও ছিল একটা ছেলে আর একটা ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে, মেয়েটা তোমার থেকে দু’তিন বছরের বড় হবে। ছেলেটার বয়স ছিল ষোলো। অনেকদিন পরে বাবা বাড়ি আসাতে তারা তো খুব খুশি। এমনিতেই বাবাকে কাছে বেশিদিন পায়না, এবার অনেক ক’দিন একসাথে মজা করে সময় কাটাবে। তবে ছেলেটা তার বাবার সাথে মাঝে মধ্যে গিয়ে বাঘেদের ট্রেনিং দেওয়া, তাদের স্বভাব, আচরণ বোঝা এগুলো দেখত। তাদের বাবা তাদের দু’জনকে সাথে নিয়ে তন্দ্রাসুন্দরীকে দেখতে যেতেন, তার খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদির ওপরে নজর দেওয়ার জন্য একজনকে ঠিক করেছিলেন। ছোট ছেলে, মেয়ে দু’টি তন্দ্রাসুন্দরীর খাঁচার সামনে গিয়ে ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিত, ওদের কিন্তু একটুও ভয় লাগত না, যতই হোক যাদের বাবা বাঘের খেলা দেখায় তাদের আবার কিসের বাঘের ভয়! তবুও রিং মাস্টার বাবু দাঁড়িয়ে থাকতেন ওদের সাথে; বাঘিনীটাও বোধহয় ওদের কচি হাতের স্পর্শ ভালোবাসত কারণ সেও তো মা হতে চলেছে। একজন মা বুঝতে পারে কারা তার ভালো চায় আর কারা তার ক্ষতি করতে চায়।
কিছুদিন পরে তন্দ্রাসুন্দরী তিনটে সুন্দর শাবক প্রসব করল। ছোট ছেলেটা তাদের একটার নাম দিয়েছিল তারা, সেও তার মায়ের মতই দারুণ দেখতে। ছোট ছোট বাঘের বাচ্চারা এত মিষ্টি দেখতে হয় তা তোমায় কী বলব দাদুভাই। এদিকে বাবু মাস্টার জমির এক দালালের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লেন। দিন চারেক পরে খবর এলো তন্দ্রাসুন্দরী ভীষণ অসুস্থ, কেউ ওকে খাবারে কিছু মিশিয়ে দিয়েছে। খবর এসেছিল যাকে তিনি তন্দ্রাসুন্দরীর দেখভালের জন্য রেখেছিলেন সেই গোপনে অন্য সার্কাস দলের লোকের সাথে হাত মিলিয়ে টাকা খেয়ে এসব করেছে। তিনি তাড়াতাড়ি করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন তন্দ্রাসুন্দরীকে দেখতে। সেই যে ছোট ছোট বাচ্চা দু’টো আর স্ত্রীকে রেখে গেলেন আর ফিরে এলেন না। তন্দ্রাসুন্দরীর শেষ সময়েও তাকে চোখের দেখা দেখতে পাননি, রাস্তায় একটা অ্যাক্সিডেন্টে…তন্দ্রাসুন্দরীও তার মালিককে অন্তিমবার দেখার জন্য হয়তো পথ চেয়ে ছিল। কিন্তু দুঃখের যে, কেউই কাউকে শেষ বিদায়টুকুও জানাতে পারল না।” অনেকক্ষণ কথা বলার পর বিপিনবাবু টেবিলে রাখা জগ থেকে গ্লাসে জল ঢেলে খেলেন। লক্ষ্য করলে দেখা যেত তাঁর চোখের কোণটাও যেন একটু চিকচিক করছে।
বিপিনবাবু একটু থেমে নিয়ে আবার বলতে থাকলেন,”দু’জনের একসাথে চলে যাওয়ার পরে প্লেজ়েন্ট সার্কাস মুখ থুবড়ে পড়ল। পাওনাদাররা বাড়িতে আসতে লাগল, বাড়ি বয়ে বাবু মাস্টারের স্ত্রীকে অকথ্য গালিগালাজ, নোংরা ভাষায় কদর্য ইঙ্গিত দিতে থাকল। ছোট ছেলে, মেয়ে দুটোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে গেল। কিন্তু ছোট ছেলেটা ঠিক করল সে তার বাবার পথই অনুসরণ করবে। সার্কাসের বাকি কিছু সদস্যের সাথে সে কথা বলে সব ঠিকঠাক করে নিল, বাড়িতে তাঁর মা কেঁদে হত্যে দিয়ে পড়লেন, কিছুতেই তিনি তাঁর সন্তানকে একই পথে যেতে দেবেন না, যেখানে গেলে কিছু মানুষের হিংসার জন্য স্বামীর মতো আবার হারাতে হবে তাঁর ছেলেকে। ছেলেও নাছোড়বান্দা, বোনের পড়াশোনা, বাড়ির খরচ সবকিছুর দায়িত্ব সে একার কাঁধে তুলে নিল। সে বুঝতে পারল সার্কাসের রিংই তার আসল জীবন, তার বাবার সম্মানও এই সার্কাস থেকেই। তারও রক্তে রয়েছে সার্কাসের প্রতি ভালোবাসা। সেই যে ছোট্ট বাঘের জন্ম হয়েছিল, তন্দ্রাসুন্দরীর মেয়ে তারা, সে আসতে আসতে বড় হতে লাগল। ছোট ছেলেটা আর ছোট রইল না, সার্কাস জগতে নতুন নাম নিল রিং মাস্টার বাপি। এর আগে সে বাবার সাথে থেকে যেগুলো শিখেছিল, বাবা তাকে যা যা পরামর্শ দিয়েছিলেন সেগুলো সে মাথায় রেখে বাবার আশীর্বাদ সাথে নিয়ে শো’তে নামল। দর্শক ওকে বাবু মাস্টারের ছেলে হিসেবে জানলেও সে তার নিজস্ব পরিচয়ে পরিচিত হতে চেয়েছিল। কিন্তু দর্শক তন্দ্রাসুন্দরীকে আর দেখতে না পেয়ে ওদের সার্কাসে আসা কমিয়ে দিয়ে অন্য দল আসলে তাদেরটাতে ভিড় করত।
আদর করে বাপি মাস্টার তন্দ্রাসুন্দরীর মেয়েকে তারাসুন্দরী বলে ডাকত। প্লেজ়েন্ট সার্কাস ছেড়ে অনেকে বেরিয়ে যেতে লাগল। যে কিছুজন ছিল তাদের নিয়ে ছোট শহর, এমনকি গ্রামেও যেতে হলো। এদিকে তারাসুন্দরীও বড় হচ্ছে, রিং মাস্টার বাপি এবার তারাসুন্দরীকে নিয়ে ট্রেনিং করাতে লাগল। খুব কম দিনের মধ্যেই উভয়ের মধ্যে তৈরি হয়ে গেল এক গভীর বন্ধন। লোকজন তারাসুন্দরীকে দেখতে আবার ওদের সার্কাসে আসতে লাগল, বাপি মাস্টারেরও নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকল। তারাসুন্দরী ও তার রিং মাস্টার বাপি দু’জনেই যেন ওদের মা ও বাবার হৃত গৌরব ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় মরিয়া ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও দলের মধ্যে কিছুজন বেতন বাড়ানো, খাবারের মান ইত্যাদি নিয়ে ঝামেলা করে অন্য সার্কাস দলে চলে গেল। গুটি কয়েক সদস্য-সদস্যা নিয়ে সার্কাস চলে না, আর তা ছাড়াও যে কয়েকটা বাঘ, হাতি অবশিষ্ট ছিল ওদেরকে বেচে দিতে বাধ্য হলো বাপি মাস্টার। ভেঙে পড়ল ‘দ্য গ্রেট প্লেজ়েন্ট সার্কাস’। বুকফাটা কান্নার সাথে বিদায় জানাতে হলো তারাসুন্দরীকেও। তাকে কিনে নিল অন্য একটা সার্কাস দল। তারাসুন্দরীর গায়ে হাত বুলিয়ে, ওর কপালে চুমু খেয়ে শেষ বারের মতো দেখে নিল রিং মাস্টার বাপি। তারাসুন্দরীও বোধহয় কিছু আন্দাজ করতে পেরেছিল, সে কিছুতেই তার নতুন মালিকের সঙ্গে যেতে চাইছিল না, তবুও জোর করে ওকে খাঁচায় ঢুকিয়ে ওরা নিয়ে গেল, ওদের চলে যাওয়া পথের ধুলোর দিকে তাকিয়ে রইল বাপি। রিং মাস্টার উপাধিটা ওর নামের আগে থেকে সরিয়ে ফেললো, এরপরে সে আর কোনোদিন কোনো সার্কাসে ঢোকেনি।
যা কিছু ছিল সব বেচে দিয়ে বড় শহরে চাকরি খুঁজতে লাগল বাপি। তারাসুন্দরীকে মনে পড়লেও ওর পক্ষে গিয়ে ওকে দেখা সম্ভব ছিল না। প্রথমে একটা রেস্তরাঁতে বাসন ধোয়া-মোছা, খাবার অর্ডার নেওয়া এসব করতে লাগল, বিপত্নীক ও নিঃসন্তান রেস্তরাঁ মালিকের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠল ধীরে ধীরে। এরপর একদিন তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে বাপি তার দিনরাত সেবা করল। মারা যাওয়ার আগে তিনি বাপিকে তাঁর রেস্তরাঁর দায়িত্ব দিয়ে সব কিছু লিখে দিয়ে গেলেন। বাপিও ব্যবসায় উন্নতি করতে থাকল, বোনের বিয়ে দিল, মা’কে নিজের কাছে এনে রাখল, নিজেও বিয়ে করে সংসারী হলো। জীবন সুখেই কাটতে লাগল।
এর দু’বছর পরের কথা। একদিন রাস্তা দিয়ে গাড়িতে করে যাওয়ার সময়ে একটা হোর্ডিং বোর্ডে একটা বড় পোস্টার দেখতে পেল, ‘দ্য ফেমাস ইস্ট সার্কাস’-এর, তাতে একটা বাঘের ছবি দিয়ে লেখা আছে ‘আপনাদের প্রিয় প্রিন্সেসের আজকেই শেষ খেলা। তাই ছোট, বড়, কচি, বুড়ো সব্বাই আসুন দেখতে’। লেখাটা পড়ে কেমন যেন আনমনা হয়ে গেল বাপি। যতই সে প্রতিজ্ঞা করুক আর কোনোদিন সার্কাস দেখতেও যাবে না তবুও মনকে বোঝাতে পারল না। পরেরদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে একা চলে গেল, সামনের সিটের টিকিট কেটে বসল। প্রথমে নেটের খেলা হলো, তারপর একে একে পাখি, জোকার, সাইকেল, হাতি সবকিছুর শেষে আসলো সেই প্রিন্সেস বাঘের খেলা; ওহ্ প্রিন্সেস, তাহলে তো বাঘিনী। বাপি দেখল রিং মাস্টার খাঁচা থেকে বাঘিনীটাকে বের করে দিল, চারিদিক অবশ্য উঁচু নেট দিয়ে মোড়া আছে। কিন্তু বয়সের ভারে সে যেন একটু ন্যুব্জ, কোনোরকমে খুঁড়িয়ে এসে একটা নিচু টুলের ওপরে দু’পা তুলে দাঁড়াল। রিং মাস্টার এসেই ওকে একটা লাঠি দিয়ে খোঁচা মারলেন, ও গুঁতো খেয়ে আবার এগিয়ে এসে একদম সামনের সিটে বসে থাকা বাপির দিকে রাখা একটা টুলে এসে পা তুললো। বাপি হঠাৎই সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মুখ দিয়ে অস্ফুটে ‘তারাসুন্দরী’ বলে বাঘিনীটার কাছে এগিয়ে গেল, এদিকে ওকে এরকম করতে দেখে দর্শকও চিৎকার করতে লেগেছে। ও বাঘটার কাছে গিয়ে ওর দিকে হাত নাড়িয়ে কাঁদতে লাগল, বাঘটাও টুল ছেড়ে এসে নেটের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আওয়াজ করে চলেছে, জীর্ণ শরীর, অসুস্থ, তবুও যা শক্তি আছে তাই দিয়েই আওয়াজ করছে, বাপি মাস্টারের চোখ ছলছল। গ্যালারিজুড়ে লোকজন ভয় পেয়ে ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছে। ওদিকে রিং মাস্টারও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বাপি রিং মাস্টারকে কি যেন বললো। রিং মাস্টার দর্শকদের শান্ত হতে বলে জোর গলায় বললো,”ইনি এই বাঘিনীর আগের মালিক, আপনারা একটু চুপ করে বসুন, নইলে আমরা অসুবিধায় পড়ব”। দর্শক কিছুটা আশ্বস্ত হলো। প্রাক্তন রিং মাস্টারের সাথে তার প্রিয় বাঘিনীর মিলনের সাক্ষী রইল সবাই। এরপর অসুস্থ তারাসুন্দরী আর কয়েক দিন বেঁচে ছিল, বাপি রোজ গিয়ে ওর দেখাশোনা করত। শেষের দিন তারাসুন্দরী ওর প্রিয় মালিকের কোলেই চোখ বুজেছিল। কিন্তু বাপি এরপর থেকে ওর শহরের প্রায় সব সার্কাসেই যেত যতদিন পর্যন্ত বাঘের খেলা দেখানো হতো। সার্কাস ছিল ওর শিরায়, উপশিরায় আর প্রতিটা বাঘের মধ্যে ও যেন তারাসুন্দরীকে দেখতে পেত, সার্কাস বাঁচিয়ে রাখার জন্য অনেক দলকে অনেক সাহায্যও করেছিল, কিন্তু রিং মাস্টার আর কোনোদিন হয়নি। নিজের ছেলেকেও এই নেশা আর পেশাতে ও আনতে চায়নি, ছেলেটাও অবশ্য ব্যবসাতেই মনোযোগী, কিন্তু ছেলের ছেলে মানে নাতিটা আবার ঠাকুরদা ও তাঁর পূর্বজের নেশা পেয়েছে”।
” বলো দাদুভাই, কেমন লাগল গল্পটা?”,গল্প শেষ করে নাতিকে জিজ্ঞাসা করলেন বিপিনবাবু।
“দারুণ দাদান”, হাততালি দিয়ে বলে উঠল বাবান। “এর আগে যে সার্কাসটায় গিয়েছিলাম ওখানে বাঘ ছিল না”।
” হ্যাঁ, দাদুভাই, এখন তো বাঘের খেলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, বাঘের সংখ্যাও কমে গিয়েছে, তাই দেখতে পাওনি। চলো, তোমার ওই খেলনা বাঘটাকে নিয়েই খেলা দেখাব”।
“তুমি?”
মুচকি হেসে বিপিনবাবু খেলতে লাগলেন তাঁর নাতির সঙ্গে।
সেদিনের সেই রিং মাস্টার বাপির মধ্যে আজও যেন কোথাও বাঘের প্রতি ভালোবাসাটা একইরকম রয়ে গেছে, তাই তো নাতির সঙ্গে খেলনা বাঘ নিয়েও খেলা দেখাতে ছাড়লেন না।
কলমে সুপ্রিয়া মণ্ডল, মুর্শিদাবাদ
লিখতে খুব ভালোবাসি; এছাড়াও কবিতা আবৃত্তি, গল্প পাঠ ইত্যাদিও অন্তরের অনুভূতি দিয়ে করি। লেখালেখির যাত্রাপথ সবে শুরু, আপনাদের সকলের আশীর্বাদ ও সমর্থন নিয়ে অনেক দূর চলতে চাই।
সেই ছোটবেলায় ফিরে গেলাম… অপূর্ব ❤️