ছোটকা, জামলু ও মুর্গী

কলমে মহুয়া মল্লিক

0
316

সকাল থেকে বাড়িতে আজ সাজো-সাজো রব I ছয় মাস পরে বাড়ি ফিরছেন শ্রীমান হাবু চন্দ্র অর্থাৎ কিনা আমাদের ছোটকাকা, সোজা তার মিলিটারি হেডকোয়ার্টার, লাদাখ থেকে। তার অবশ্যি একটা পোশাকি নাম আছে- কান্তি ভূষণ মুখোপাধ্যায় I তিনি নিজের আর্মির ছেলেদের কাছে জাঁদরেল “মেজর সাব”, কিন্তু আমাদের ছোটোদের কাছে, একমাত্র আদরের ছোটকাI ছয় ফুট দু ইঞ্চি, এই সুপুরুষ 

মানুষটি এলেই বদলে যেত আমাদের হাজারীবাগের সেই চিরাচরিত কড়া নিয়মে চলা এই বিশাল বাড়িটি I বয়ে যেত মৃদু মধুর দক্ষিনা বাতাসI

ছোটকা ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে যাওয়ার পর থেকেই একটা থমথমে আবহাওয়া ছিল বাড়িতে । বড়োরা গম্ভীর মুখে রেডিওর সামনে বসে থাকতেন । কারো মুখে হাঁসি ছিল না। আমরা ছোটোরাও ভয়ে ভয়ে ঘুরে বেড়াতাম। এরই মধ্যে ঘোষণা হলো ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে, ভারতের জয় I ঠাম্মার পুজোর ঘর থেকে ভেসে আসলো উলুধ্বনি। টেলিগ্রাম করে ছোটকা জানালো সে আসছে I বাড়িতে ছড়িয়ে পড়লো খুশির আমেজ । আমরা ছোটোরা আনন্দে খেতে লাগলাম ডিগবাজি I 

 ঠিক বেলা দশটায় সেই বিখ্যাত কড়া নাড়ার শব্দ। আমরা যে যেখানে ছিলাম হুড়মুড় করে ছুট লাগলাম দরজার দিকে। কে সবচের আগে ছোটকার সামনে পৌঁছাতে পারে I ছোটকার গমগমে গলায় ঘরে ঢুকেই শুরু হয়ে গেলো হাঁকডাক। সারা বাড়ি তখন লুচি ভাজার গন্ধে ম-ম । তার সাথে ঠাম্মার হাতের পায়েস। আহা! যেন দেবতাদের অমৃত। ছোটকা যে কেন প্রতি মাসে ছুটিতে আসে না। আমার রাশভারী দাদু মাঝে মাঝে খড়ম পায়ে স্মিত মুখে এসে দাঁড়াচ্ছেন আর ছোটকার সাথে টুকটাক যুদ্ধের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা বাদ করছেন।  কি আনন্দ আকাশে বাতাসে I আমাদের নো পড়াশুনা, নো অঙ্ক কষা, নো বকাঝকা I 

জানিনা কেন আমি অঙ্কে কিছুতেই ৩৩ এর উপর উঠেতে পারতাম না। মাঝে মাঝে আবার ৩৩ টাও নিচের দিকে গোঁত্তা মারতো I অঙ্ক মাস্টারমশাই, আগের জন্মে বোধহয় লংকার রাবন ছিলেন। কি বাঁজখাই গলা রে বাবা I  তেমন মোটা রাবন মার্কা গোঁফ I রেসাল্ট এর দিন আমার হতো ছেড়া তারওয়ালা গিটারের মতন অবস্থা I গলা দিয়ে বিভিন্ন সুর বেরোতো I ভাই বোনগুলো ছিল আবার অঙ্কে তুখোড় I বাড়িতে শুধু ঠাম্মাই ছিল আমার সাপোর্টার। মা কে বলতো- বৌমা ওরে বৈকো না। রাবন মাস্টার ইচ্ছা কইরা ওরে কম নম্বর দিসে । এই কথার পর মার আর কিছু বলা চলে  না । মিনমিন করে মা, ঠাম্মাকে তার আদরের বড় নাতনির ব্যাপারে কিছু বলার চেষ্টা করতো, আর আমি সেই ফাঁকে সোজা সেধিয়ে পড়তাম ঠাম্মার কাঁথার তলায়। ব্যাস, আমায় পায় কে I এ তো গেলো আমার অঙ্ক কান্ড এবং রাবন মার্কা গোঁফ মাস্টার মশাই এর বিভীষিকা I 

তা যা বলছিলাম আমরা সবাই ঘিরে ফেলাম ছোটকা কে। ছোটকা মিলিটারি গলায় অর্ডার দিলো – কচি কাচার দল, “ফলো মি”। তোদের দেখাবো ম্যাজিক বাক্স I আমরা চললাম দল বেঁধে ছোটকার ম্যাজিক বাক্স দেখতে। আমাদের চার ভাই বোনের জন্য বেরিয়ে পড়লো কত সব মজার জিনিষ। আমরা আজ একেক জন ফুর্তির ফোয়ারা I ছোটকা যে কেন প্রতি মাসে ছুটিতে আসে না। এমন সময় আমার দারোগা বড়পিসি নিজের শশুরবাড়ি থেকে সদলবলে এসে পৌঁছালো I ৫ফুট ৮ইঞ্চির এই মহিলাটিকে তার মেজাজের জন্য আমরা আড়ালে দিপু দারোগা বলে ডাকতাম I 

এরই মধ্যে ছোটকা ঘোষণা করলো -আজ হাম মুর্গীর মাংস রান্না করেগা ।আমরা প্রমাদ গুনলাম। ঠাম্মার আবার দুটো জিনিষে প্রবল আপত্তি। এক মুর্গী ও দুই মুসলমান। আমাদের ছোটদের সন্ধে বেলার  

 পর থেকে মুঘল ইতিহাস পড়া ছিল বারণ I ঠাম্মা ভীষণ চোটে যেত I ঠাম্মা বোধহয় কোনকালে মেনে নিতে পারেনি দেশ ভাগের সাথে নিজের জনদের হারানোর ব্যাথাটা । তার বুকে ভীষণ ভাবে আজও হয়তো বাজতো, রাতের অন্ধকারে দেশ ছাড়ার দুঃখ I

ঠাম্মা পুজোর থালা হাতে বেরিয়ে এলো। তার কানে কথাটা গেছে। জমিদারি মেজাজে ঘোষণা করলো- কভি নাহি, একেবারেই না। তোরা কি মগের মুল্লুক পাইছোস। অতি কষ্টে বাবা এবং দারোগা, থুড়ি, বড়পিসি ঠাম্মাকে শান্ত করলো । ঠাম্মা রাজি হলো এক শর্তে I রান্নাঘরে মাংস রান্না করা যাবে না I মুর্গীটি কে কেটে,রান্না করতে হবে বাইরের বাগানে I ছোটকা বললো কুছ পরোয়া নেই , আজ বাগানে পিকনিক হোগা I খুশি খুশি মুখে বাবা নিজে চলেন মুর্গী আনতে। বাচ্চাদের পল্টন চললো ছোটকার অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে বাড়ির পিছনের ফলের বাগানে। জুট গেলাম ইঁট, ডাল-পালা জোগাড়ে। এরই মধ্যে বাবা মুর্গী নিয়ে ফিরে এলেন। আমাদের আদিবাসী কাজের ছেলে মংলু কে বলা হলো মুর্গীটি কে কেটে রেডি করতে। যদিও মুর্গীটি কে কাটার কথা ভেবে আমাদের দুঃখ হলো, কিন্তু তখনকার মতো পিকনিক এর আনন্দে সব ভুলে গেলাম I ছোটকা এরই মধ্যে মংলুর সাহায্যে পেয়াঁজ রসুন ইত্যাদি ছুলে রেডি। ইঁট দিয়ে পাতা উনোনে কড়াই চড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা গলা ফাটিয়ে হিপ -হিপ হুররে , ভারত মাতা কি জয়, ছোটকা জিন্দাবাদ, স্লোগান মুহুর মুহুর দিতে লাগলাম। আমাদের তারোহ স্বরে চেঁচানো শুনে, পাশের বাড়ির লাহিড়ী জ্যেঠু, বন্দুক হাতে ছুটে এলেন, ভেবে যে বোধহয় কোনো বিপদ হয়েছে । তখনকার হাজারীবাগে বন্য প্রাণীদের ছিল অবাধ আনাগোনা। সব দেখে শুনে উনি তো থ। এরই মধ্যে কড়াইয়ে তেল দিয়ে দেওয়া হলো, মশলা কাসানোর জন্য I সবাই মিলে ধরলাম গান I সে কি গান I ছোটকার দরাজ গলার সাথে আমাদের হেঁড়ে গলার গানের যুগলবন্দী তে পাশের ক্ষেতে, ঘাস খেতে আসা দুটো গরু লেজ উঠিয়ে পালালো। তারা অনেকক্ষণ ধরে সহ্য করছিলো, আর পারলো না । হটাৎ মঙলুর হাত ফস্কে মুর্গীটি দিলো ছুট I আমরা ছোটোরা মংলুর সাথে সাথে রে রে করে, পালানো মুর্গীটির পেছনে ধাওয়া করলাম I মুর্গীটি ততক্ষনে কাঁটার বেড়া পেরিয়ে সুরুৎ করে ঢুকে পড়েছে পাশের ক্ষেতেI এ হেনো উত্তেজনার মুহূর্তে বাইরে থেকে উঠলো একটা বড়ো -সড়ো শোরগোল। কানে এলো ঠাম্মার রাগি গলার স্বর। কাকে যেন উচগ্রামে বকছে। আমরা এক ছুটে খিড়কি দরজার সামনে হাজির। পিকনিক উঠলো মাথায়I সেখানে দেখি মা, পিসিমা, বাবা, দাদু, পিসেমশাই দাঁড়ানো । মাঝখানে রঘু যাদব ওরফে রঘুয়া, আমাদের গোয়ালা কাম বাজার সরকার কাঁচু মাচু মুখে দাঁড়িয়ে । তার ধুতির আড়ালে ভয়ে লুকিয়ে একটা বছর ১৪র ছেলে । ঠাম্মার রণচন্ডি মূর্তি I তার পূর্ব- বঙ্গীয় মাতৃ ভাষায় রঘুয়ার গুষ্টির পিন্ডি উদ্ধার করছে। বাকি সবাই চুপ। ঠাম্মা রেগে বলছে- নিয়া যা পোলাটারে। আমি কিছুতেই রাখুম না। মুখার্জী বাড়িতে এ হইতে পারে না I জানলাম ছেলেটার নাম জামিল। জাতিতে মুসলমান I গ্রামে মা ছাড়া কেউ ছিলনা তার I মা মারা যাবার পর জ্ঞাতি ভাইরা বের করে দিয়েছে । নিজেরাই খেতে পড়তে পারে না, জামিলের ভার কে নেবে I রঘুয়াদের গ্রামের এক প্রান্তে এদের ঘর। সব শুনে রঘুয়া, জামিল কে সাথে করে নিয়ে এসেছে । রঘুয়া ঠাম্মা কে কাকুতি মিনতি করছে – মাইজি তুম উকে তোমাদের ফাই ফরমাস খাটতে রাখলো । তুমাদের বাড়িতে থাকলে উস্কো কিছু তাখলিফ হবে না। এ হেনো মুহূর্তে ছোটকার আবির্ভাব। সব শুনে বললো যে জামিল আজ থেকে আমাদের কাছে থাকবে। আমাদের দারোগা পিসি ও তাতে যোগ দিলো I ঠাম্মার মুখ তো রাগে, আপেলের মতো লাল। মুখ দিয়ে কথা সরছে না। রেগে বলে উঠলো- ওরা আমাগো সব লুইট্যা পুইট্যা নিসে। ছোটকার অকাট্য যুক্তি, তাতে জামিলের হাত কোথায়? মা, সে সব অনেক দিন চুকে বুকে গেছে I এখন মনুষত্বই আসলI তাছাড়া, তোমাদের জমিদারি তে তো বহু মুসলমানেরা ছিল, যারা ছিল আমার জমিদার দাদুর ডান হাত। তোমাদের বাড়িতে নাসের মিয়াঁ দুধ দিতো। সেই দুধেই তো আমার দিদিমা পায়েস রেঁধে, জামাই আদর করতো। দাদু দেখি মিটিমিটি হাঁসছেন। ঠাম্মা ছোটকার কাছে পরাস্ত হয়ে, শেষ-মেষ রাজি 

হলেন । কিন্তু নির্দেশ দিলেন যে ও যেন রান্নাঘর, ঠাকুর ঘর ও তার ঘরে না ঢোকেI 

জামিল রয়ে গেলো আমাদের কাছে।আমরা ছোটোরা জামিল কে পেয়ে খুব খুশি। খুব শীঘ্রই জামিল হয়ে উঠলো আমাদের জামলু। যতদিন ছোটকা ছিল তার পায়ে পায়ে ঘুরতো। ছোটকা যাবার দিন সে কি কান্না I দাদু ও বাবার হাতে হাতে কাজ করে দিতো I আমার মার খুব নেওটা ছিল জামলু I কত কি যে জানতো জামলু। আম পাতা দিয়ে বাঁশি বানানো, দড়ি ধরে এক ডাল থেকে অন্য ডালে যাওয়া, লাট্টু ঘোরানো, ঘুড়ি ওড়ানো, নানা রকম মজার খেলা, কত কি যে শিখিয়েছিলো আমাদের। আমাদের ছোটোদের, তো জামলু ছাড়া চলতো না। হটাৎ একদিন জামলুর মাথা ঘুরে গেলো। গায়ে হাত দিয়ে মা দেখলো প্রচন্ড জ্বর। মা ওকে ধরে- ধরে শুয়িয়ে দিলো। বিকেলের মধ্যে ওর গায়ে বসন্তের গুটি দেখা গেলো। ঠাম্মা মা কে ওর ঘরে যেতে বারণ করলো। বৌমা তুমি ছোটো গো নিয়া আলাদা থাকো, এইটা ছোয়াঁচে রোগ। খুব সাবধানে থাকবা। এই বলে ঠাম্মা আমাদের সবাই কে অবাক করে দিয়ে চলে গেলো জামলুর ঘরে। সারা রাত জল পট্টি দিয়ে জ্বর নামালো। ভোর ৫ টা নাগাদ জামলু চোখ মেলে তাকালো। দূর থেকে ভেসে এলো মস্জিদের প্রথম আজান ও একি সাথে পাঁচ মন্দিরের ঘন্টার ধ্বনি । সব মিলে মিশে এক । নতুন ভোরে আমরা ও আবিষ্কার করলাম আমাদের অচেনা ঠাম্মা কে, যার বাইরে টা শক্ত নারকোল, কিন্তু ভেতরের মানুষ টা ভালোবাসা দিয়ে ভরপুর I

জামলু ঠাম্মা কে মা ডাকতে শুরু করলো I জামালুর এখন সারা বাড়িতে অবাধ যাতায়াত I ক্রমে জামলু হয়ে উঠলো আমাদের পরের কচি- কাচাদের, জামলু চাচা , পরবর্তীতে, আমাদের ছেলে মেয়েদের, জামলু দাদা I বয়েস কালে ঠাম্মার, জামলু কে ছাড়া এক পাও চলতো না, চোখে হারাতেন জামলু কেI বাবার যখন রাঁচি তে পোস্টিং হলো, জামলু বাড়ির ছেলের মতো সামলাতো আমাদের সব কিছুI জামলু থাকাতে, আমরাও নিশ্চিন্তে নিজের- নিজের জায়গায় I হটাৎ একদিন  ঠাম্মা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, আমার মায়ের কোলে মাথা রেখে আর জামলুর হাত টি ধরে I সেদিন, সে কি মা হারানো কান্না জামলুর I

তোমরা অনেকেই জিজ্ঞাসা করবে জামলুর পড়াশোনার কি হলো, নিজের ঘর- সংসারের কি হলো I সে আরেক মজার কাহিনী I কোনোদিন সুযোগ পেলে বলবো I কালের স্রোতে আমরা অনেক কিছু পেয়েছি, হারিয়েছি তার চেয়ে অনেক বেশিI আজ, আমরা ভাই বোনেরা ছিটকে পড়েছি নানা জায়গায় I কালে ভদ্রে দেখা হয়I আমাদের ছেলে মেয়েরা, কর্ম জীবনে জড়িয়ে পড়েছে বিদেশ বিভুঁয়েI মোবাইল টা এখন তাদের দুনিয়া I মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে, ভোর রাতে আকাশের তারাদের মধ্যে খুঁজি দাদু, ঠাম্মা, মা, বাবা, ছোটকা ও জামলু কেI ওরা নিশ্চই খুব আনন্দে আছে একে অন্যকে জড়িয়ে I খুব ভালো থাকুক ওরা ই

কলমে মহুয়া মল্লিক

Write and Win: Participate in Creative writing Contest & International Essay Contest and win fabulous prizes.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here