বাংলা অসাধারণ কথাসাহিত্যে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ওরফে বনফুলের জন্ম ১৯ জুলাই ১৮৯৯, মৃত্যু ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯। তিনি একজন বাঙালি নাট্যকার ও কবি । তিনি বাংলা সাহিত্যে বনফুল ছদ্মনামেই অধিক পরিচিত। বাংলা সাহিত্যে তাঁকে অনুগল্পের জনক বললে অতুক্তি হয় না।তিনি পেশায় একজন চিকিৎসক হয়েও বাংলা সাহিত্যে অসংখ্য ছোটগল্প, উপন্যাস লিখে যে অবদান রেখেছেন তাতে তিনি বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে থাকবেন।
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় কৈশোর থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। শিক্ষকদের কাছ থেকে নিজের নাম লুকোতে তিনি বনফুল ছদ্মনামের আশ্রয় নেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে সাহেবগঞ্জ স্কুলে পড়ার সময় মালঞ্চ পত্রিকায় একটি কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। পরে প্রবাসী, ভারতী এবং সমসাময়িক অন্যান্য পত্রিকায় ছোটগল্প প্রকাশ করেন। বনফুলের লেখা দুটো নিচেয় দিলাম।
অমলা
অমলাকে আজ দেখতে আসবে। পাত্রের নাম অরুণ। নাম শুনেই অমলার বুকটিতে যেন অরুণ আভা ছড়িয়ে গেল। কল্পনায় সে কত ছবিই না আঁকলে। সুন্দর, সুশ্রী, যুবা–বলিষ্ঠা, মাথায় টেরি, গায়ে পাঞ্জাবি–সুন্দর সুপুরুষ।
অরুণের ভাই বরুণ তাকে দেখতে এল। সে তাকে আড়াল থেকে দেখে ভাব্লে–‘আমার ঠাকুরপো!’
মেয়ে দেখা হয়ে গেল। মেয়ে পছন্দ হয়েছে। একথা শুনে অমলার আর আনন্দের সীমা নেই। সে রাত্রে স্বপ্নই দেখলে!
বিয়ে কিন্তু হল না–দরে বন্ল না।
।।দুই।।
আবার কিছুদিন পরে অমলাকে দেখতে এল। এবার পাত্র স্বয়ং। নাম হেমচন্দ্র। এবারও অমলা লুকিয়ে আড়াল থেকে দেখলে, বেশ শান্ত সুন্দর চেহারা–ধপ্ধপে রঙ–কোঁকড়া চুল–সোনার চশমা–দিব্যি দেখতে।
আবার অমলার মন ধীরে ধীরে এই নবীন আগন্তকের দিকে এগিয়ে গেল।
ভাবলে–কত কি ভাবলে!
এবার দরে বন্ল, কিন্তু মেয়ে পছন্দ হল না।
।।তিন।।
অবশেষে মেয়েও পছন্দ হল–দরেও বন্ল–বিয়েও হল। পাত্র বিশ্বেশ্বর বাবু। মোটা কালো গোলগাল হৃষ্টপুষ্ট ভদ্রলোক–বি. এ. পাশ সদাগরি আপিসে চাক্রি করেন।
অমলার সঙ্গে যখন তাঁর শুভদৃষ্টি হল–তখন কি জানি কেমন একটা মায়ায অমলার সারা বুক ভরে গেল। এই শান্ত শিষ্ট নিরীহ স্বমী পেয়ে অমলা মুগ্ধ হ’ল।
অমলা সুখেই আছে।
বেচারামবাবু
হরিশ মুদী সন্ধ্যাবেলা হিসাব বুঝাইয়া গেল যে গত মাসের পাওনা ২৭.৭০ পঃ হইয়াছে এবং তাহা অবিলম্বে দেওয়া দরকার। সদ্য-অফিস-প্রত্যাগত বেচারামবাবু বলিলেন–“আচ্ছা মাইনেটা পেলেই–!” অতঃপর কাপড়-চোপড় ছাড়িয়া বেচারামবাবু বাহুরের রোয়াকটিতে বসিয়া হাঁক দিলেন–“অরে চা আন্–।” চা আসিল। চা আসিবার সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার হরিবাবু, নবীন রায়, বিধু ক্লার্ক প্রভৃতি চার পাঁচজন ভদ্রলোকও সমাগত হইলেন এবং সমবেত গল্প-গুজব সহযোগে চা-পান চলিতে লাগিল।
গল্প চলিতেছে। এমন সময় বেচারামবাবুর ছোট মেয়ে পুঁটি আসিয়া উপস্থিত–“বাবা, দুখানা চিঠি এসেছে আজ ডাকে। আনব?”
পুঁটির ছোট বোন টুনিও সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছিল। সে কহিল–“আমি আনব বাবা!” বেচারামবাবু মীমাংসা করিয়া দিলেন–“আচ্ছা দু’জনে দুটো আনো!”
শ্রীযুক্ত বেচারাম বক্সির পাঁচ কন্যা এবং দুই পুত্র।
পুঁটি ও টুনি দুজনে দু’খানি পত্র বহন করিয়া আনিল। প্রথম পত্রখানি বেচারামবাবুর প্রবাসী পুত্র বহরমপুর হইতে লিখিয়াছে–তাহার কলেজ ফি, হস্টেল চার্জ প্রভৃতি লইয়া এ মাসে ৫৫ টাকা চাই। দ্বিতীয় পত্রটি তাঁহার কন্যা শ্বশুরবাড়ী হইতে লিখিয়াছে যে গত বৎসর ভাল করিয়া পূজার তত্ত্ব করা হয় নাই বলিয়া তাহাকে অনেক খোঁটা সহ্য করিতে হইয়াছিল। এবার যেন পূজার তত্ত্বে কার্পণ্য করা না হয়, তাহা হইলে তাহার পক্ষে স্বশুরবাড়ীতে তিষ্ঠান দায় হইবে।
বেচারামবাবু চিন্তিত মুখে পত্র দুটি পকেটস্থ করিলেন।
…আবার গল্প চলিল। নবীন রায় একটা পান মুখে পুরিয়া কহিলেন–“তোমার মেজ মেয়ের বিয়ের কচ্ছ কি? বিয়ে না দিলে আর ভাল দেখাচ্ছে না!”
বেচারাম কহিলেন–“পাত্র একটা দেখ না!”
নবীন তদুত্তরে বলিলেন–“পাত্র একটি আছে, খাইও খুব বেশী নয়। ৫০১ টাকা নগদ–তেত্রিশ ভরি সোনা আর বরাভরণ। এমন কিছু বেশী নয় আজকালকার দিনে।”
থামিয়া বেচারাম উত্তর দিলেন–“তা বটে।”
ক্রমে সভা ভঙ্গ হইল। বেচারামবাবু অন্দরে গেলেন। ভিতরে গিয়া আহারে বসিতেই গৃহিণী হরিমতি কাছে আসিয়া বসিলেন এবং নানা কথার পর বলিলেন–“বিনোদের মুখে মাসীমা খবর পাঠিয়েছেন যে, কাল তিনি আসবেন। কিছু আলোচাল আর একসের দুধের কথা বলে দিও তাহলে কাল থেকে। তিনি আফিং খান জান তো?”
শুইতে গিয়া দেখিলেন ছেলেমেয়েরা ঘুম ভাঙিয়া কাঁদিতেছে। বলিলেন–“কি হল এদের?”
স্ত্রী বলিলেন–“হবে না? শীত পড়ে গেছে–কারো গায়ে একটা জামা নেই। লেপটা ছিঁড়ে গেছে। সেই পাঁচ বছর আগে করান হয়েছিল। ছিঁড়বে না আর। তোমাকে ত বলে বলে হার মেনেছি। কি আর করব বল!”
বেচারাম এবার আর কিছু বলিলেন না! শুধু টেবিলের উপর আলোটার দিকে চাহিয়া রহিলেন। মোমবাতিটা পুড়িয়া পুড়িয়া প্রায় নিঃশেষ হইয়া আসিয়াছে।
মনোজিৎকুমার দাস, লাঙ্গলবাঁধ, মাগুরা, বাংলাদেশ।