বিখ্যাত পপ গায়িকা Adele-এর ‘Someone Like You’ গানটা শুনছিল দীক্ষা। দীক্ষিতের সাথে তার বিচ্ছেদের দশ বছর হয়ে গেছে। এখনো মনে হয় যেন তাদের প্রেম, বিয়ে, বিচ্ছেদ – সবই এই সেদিন হলো। স্কুল জীবন থেকে কলেজে ঢোকার মুখে প্রেম – কলেজ পাশ করেই বিয়ে – অবশেষে ছ’বছর ঘর করার পর ডিভোর্স; সেটাও আবার বছর দশেক হতে চললো। এই ছত্রিশ বছর বয়সে এসে হঠাৎ তার মনে হলো জীবন নাট্যের কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় কতো তাড়াতাড়ি অভিনীত হয়ে গেল তার জীবনে। ব্যস্ততার মাঝে কখনো ভাবার সময় পায়নি যে ফেলে আসা জীবনের নির্যাসটুকু কতটা অনুভব করতে পেরেছে সে। পারস্পরিক ভালো লাগায় কাছে আসা – পারস্পরিক একঘেয়েমিতে দূরে যাওয়া, এছাড়া কোনো তৃতীয় ব্যক্তি তাদের সম্পর্কের মাঝে দেওয়াল গেঁথে তোলে নি। তাদের পথ আলাদা হয়ে গেলেও রাস্তাঘাটে হঠাৎ দেখা হলে কেউ কারো কুশল জিজ্ঞাসা করতে ভোলে না।
টিভিটা চালিয়ে দিয়ে কফির কাপে চুমুক দিল দীক্ষা। একটু পরে উঠে যাহোক কিছু রান্না করে নেবে এমন চিন্তাভাবনা করছে। হঠাৎ মনে হলো কিছু আনিয়ে নেবে অর্ডার করে। আজকে সারাটা দিন কাজের অনেক প্রেশার গেছে। দীর্ঘক্ষন ল্যাপটপের সামনে বসে এখন আর রান্না ঘরে ঢোকার এনার্জি নেই। এমনিতে সে বাড়ির তৈরি খাবারই পছন্দ করে, তবে এইরকমই কিছুকিছু ক্লান্তিকর কর্মমুখর দিনে খাবার অর্ডার করে থাকে। মা থাকতে যত কষ্টই হোক কাজ সেরে উঠে গরম-গরম কিছু রান্না করতো। বাইরের খাবার খুব একটা মায়ের সহ্য হতো না। মা-ও আজ নেই বছর দুয়েক হলো। বাবা তো ডিভোর্সের আগেই গত হয়েছেন। এনার্জিতে ভরপুর দীক্ষারও মাঝেমাঝে অতীত স্মৃতি রোমন্থন করতে-করতে একলা বোধ হয়। আসলে হয়তো সব মানুষেরই জীবনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ মুহূর্তে এই একাকীত্ব বোধ জাগ্রত হয়, আবার সময়ের সাথে মিলিয়েও যায়।
একটি খবরের চ্যানেলে সুপার মডেল সোনালি চ্যাটার্জির ‘Me too’ আন্দোলনের স্বপক্ষে বক্তব্যের বিশ্লেষণ চলছে। কীভাবে তিনি একজন বিনোদন জগতের প্রভাবশালী মুখ বলে একজন নামী পরিচালক তাকে কুপ্রস্তাব দিয়েও এঁটে উঠতে পারেন নি, সেই কথাই বিশ্লেষিত হচ্ছে। কিন্তু, বিনোদন জগতের নতুন মুখ যারা, সেই সমস্ত মহিলারা শুধুমাত্র ইনডাস্ট্রিতে টিকে থাকতে চান বলে এইরূপ ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সাহস দেখান না, সে প্রসঙ্গও উঠে আসছে। এ প্রসঙ্গে সোনালি চ্যাটার্জির অভিমত যে বিনোদন জগতের ফেমাস ও সিনিয়র শিল্পীদের উচিৎ এই ভিক্টিমদের ব্যাক-সাপোর্ট দেওয়া, তাহলে ইনডাস্ট্রি অকালে অনেক প্রতিভাবান শিল্পীদের হারাবে না। দীক্ষা ভাবল, আজকাল বেশিরভাগ মিডিয়াগুলোও হয়েছে সেরকম, শুধু বিনোদন আর রাজনীতির কেচ্ছা নিয়ে মেতে রয়েছে। ওদিকে দেশ যে, স্বাধীনতার এত বছর পরেও দারিদ্র সূচকে পরস্পর ঊর্ধ্বগামী, সেদিকে বিশেষ আলোকপাত নেই। তবে, সোনালির বক্তব্যের যুক্তি আছে।
– মা, দীতিক্ষা বানানটা আরেকবার ইংরাজীতে বলো।
– ওফ! তোর বাবা বেছে বেছে একটা নামও রেখেছে! বাচ্চার যে নামের বানান লিখতে কষ্ট হতে পারে সেসব কান্ডজ্ঞান নেই! শুধু সোহাগী নাম রাখলেই হলো…!
শেষ দুটো বাক্য অস্ফুটে বলে মেয়েকে নামের বানান বলতে বসলো প্রাপ্তি। এমনিতে মাল্টিটাস্কিং-এ সে বেশ দক্ষ হয়ে উঠছে দিন-দিন। তাই সংসার-চাকরি-বাচ্চার দেখাশোনা- দীক্ষিতের খেয়াল রাখা এবং সর্বোপরি নিজের জন্য কিছুটা সময় বের করা – সবটাই মোটামুটি ব্যালান্স করতে পারে। তবে, নামের সঠিক মানেটা না জানলেও দীতিক্ষা নামটা তারও বেশ পছন্দের। আত্মজার নামের মধ্যে তাদের দুজনের নামের অংশবিশেষ যে জুড়ে আছে, এর থেকে আনন্দের আর কীইবা থাকতে পারে! তবে, প্রাপ্তি অত তলিয়ে কোনোদিন ভাবে নি যে কেন দীক্ষিত আলগাভাবে হলেও প্রাক্তনকে জুড়ে দিয়েছে নামের মধ্যে। ভাববার অবসরও দীক্ষিত তাকে দেয় নি। সাংসারিক বেড়াজালের মধ্যেও নিজেদের সময় ওরা ঠিক বের করে নেয়। সেইটুকু সময় শুধু ওদের দুজনের। বাচ্চাকেও অ্যালাও করে না তখন। এইরকমই তাদের কোনো এক অন্তরঙ্গ মুহূর্তে মাঝেমাঝে ‘প্রাক্তন’ ছায়া ফেলে যায় তার ভাবনার আঙিনায়। দীক্ষিত ভাবে, পরিস্থিতির স্রোতে ভেসে না গিয়ে তারা যদি নিজেদেরকে এমনভাবে একটু সময় দিতে পারত…! তবে প্রাপ্তিকে পেয়ে সে সুখী। তবুও প্রাক্তন বোধহয় মনে একটু জায়গা অধিকার করেই থাকে। শুধু সময়ে-সময়ে সেই স্মৃতিপাত্রের ঢাকনা খুলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চায়। খুব সযত্নে আমরা সেই দীর্ঘশ্বাসকে চাপা দিয়ে রাখি যাতে বর্তমান তার উত্তপ্ত ছোঁয়ায় আহত না হয়। তাই দীক্ষার জন্য তার মনে আলাদা জায়গা থাকলেও, প্রাপ্তির প্রতি সে কমিটেড।
মাস দুই পরে একদিন গভীর রাতে দীক্ষার মোবাইল স্ক্রিনে আলো জ্বলে উঠলো। এমনিতে এই সময়ে চেনা নম্বর এবং বারংবার ফোন আসা কোনো অচেনা নম্বর ছাড়া কোনো ফোন রিসিভ করে না সে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা ব্যক্তির ছবিটা দেখে মুহূর্তের জন্য তার মুখে এক চিলতে হাসি খেলে গেল এই ভেবে যে, জগতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। ফোনটি রিসিভ করতে ও-প্রান্তের কণ্ঠ বলে উঠলো, ‘সুন্দর স্বপ্নটা ভেঙে দেওয়ার জন্য দুঃখিত।’ দীক্ষা ফোনটা পাশে রেখে চিত হয়ে শুয়ে শুরু করলো, ‘তারপর… কেমন আছো?’ ও-প্রান্ত থেকে হাসির সাথে উত্তর এলো,
– ঐ… ভালো-মন্দ মিশিয়ে ভালোই, তুমি?
– তোমার মতোই… এই… চলমান, তা… পুজোর প্ল্যান কী?
– আপাতত পুজোর ফটোশুটের কাজগুলো শেষ করলাম…. যে কথা বলছিলাম… পুজোর ক’দিন ফাঁকা রেখেছি… একদিন কি মিট করা যায়?
– মাথা খারাপ… ভিড় জমে যাবে… জনপ্রিয়তার সাথে তোমার ভালো সখ্য আছে জানি কিন্তু আমার আবার ওটাতে অস্বস্তি হয়। তার চেয়ে এই ফোন – ভিডিও কল – হোয়্যাটস্অ্যাপ্ এইতো বেশ ভালো…
– ভয় পেয়ো না, কোনো ভিড় জমবে না, শুধু তুমি একটা নির্জন জায়গার খোঁজ দাও যেখানে একটু তোমার সাথে মুখোমুখি বসে কথা বলতে পারি।
– কিন্তু…
– না বোলো না, প্লিস্।
মাস ছয়েক আগে এক বন্ধুর জোরাজুরিতে একটি ফ্যাশন শো-তে গেছিল দীক্ষা। সেখানেই আলাপ ফোনের অপর প্রান্তের মহিলা কন্ঠের সাথে। ভদ্রমহিলা এই সময়ের একজন নামী মডেল। তাই তিনি যখন নিজে যেচে দীক্ষার ফোন নম্বর চাইলেন, দীক্ষার মনের ভিতরে এক প্রকার বিস্ময়ভরা অস্বস্তি হলেও, শেষমেশ নম্বরটা দিয়েই দিয়েছিল সে। তারপর ভদ্রমহিলা-ই উপযাচিকা হয়ে ফোনটা করেছিলেন। প্রথমদিকে মাঝেমধ্যে কথা হলেও মাস চারেক হলো দুজনেই সময় পেলে একে অন্যের খোঁজখবর নেয়। ভদ্রমহিলার থেকে দীক্ষা বিনোদন জগতের অনেক কালো দিক জানতে পেরেছে যেগুলো সম্পর্কে তার একটা ভাসা-ভাসা ধারনা ছিল। কীভাবে একজন শিল্পীকে সর্বদাই তার ইমেজ রক্ষার দায় বয়ে বেড়াতে হয় পেশার তাগিদে, সেকথাও বিস্তারিত জেনেছে তার কাছে। আসলে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দীক্ষা একটা বিষয় উপলব্ধি করেছে যে, অন্যান্য পেশার সাফল্যের সাথে বিনোদন জগতের পেশার সাফল্যের এক বড়ো ফারাক হলো, এই জগতের সাফল্য ধরা দেয় একাকীত্বের বিনিময়ে। তবে, সেই দিক দিয়ে দেখতে গেলে প্রত্যেকটা মানুষই তো একা। সাফল্য, জনপ্রিয়তার পাশাপাশি অপরের ঈর্ষাও বহন করে আনে। দীক্ষা নিজে একজন দক্ষ ফ্রিল্যান্সার, তারও কি শত্রু সংখ্যা নেহাত কম! আলাপচারিতার মধ্য দিয়েই দীক্ষা জানে ভদ্রমহিলা এর আগে বেশ কয়েকটি সম্পর্কে ছিলেন। কেন জানিনা, দীক্ষার মনে হয়, তার কথার মধ্যে অদ্ভুত এক সারল্য আছে যা তাকে খ্যাতির শিখরে থেকেও মাটির কাছাকাছি থাকার টান অনুভব করায়। দীক্ষা একদিন সরাসরি প্রশ্ন করেছিল,
– তোমার কাছে আমার বিশেষত্বটা ঠিক কী?
– এমন একজন যে আমার সব হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলায় না কিন্তু পারস্পরিক পৃথক দৃষ্টিকোণকে সম্মান করে।
– ও… বুঝলাম… (দীক্ষার স্বরের কৌতুক যেন ও-প্রান্তেও পৌঁছাল)
– আই অ্যাম্ সিরিয়াস অ্যান্ড ওয়ান্ট টু মিট ইউ সুন।
– ওকে, উই উইল ডিসকাস ইট লেটার।
ওখানেই সেদিনের মতো কথোপকথনের ইতি টেনেছিল তারা। কিন্তু ফোনটা রেখে দিতেই দীক্ষার মনে হলো, আচমকা যেন তার হৃৎস্পন্দনটা বেড়ে গেছে।
গঙ্গা নদীর ধারে একটু নিরিবিলি পরিবেশে সন্ধ্যাবেলা বসে আছে দুই মানবী। একজনের পরনে গ্রে জিন্স, কালো হুডি, মুখে মাস্ক, চোখে কালো চশমা। অন্যজন পরে আছে ব্লু ডেনিম আর কালো শর্ট কুর্তি। কুর্তি পরা মেয়েটি একমুঠো বাদাম বাড়িয়ে দিল কালো হুডির দিকে। এবার মাস্ক ও চশমা খুলে রাখলো হুডি পরিহিতা মহিলাটি। বাদমগুলো হাতের ভিতর নাড়াচাড়া দিতে দিতে পায়ের নীচে বহমান নদীস্রোতের দিকে তাকিয়ে মহিলাটি খুব শান্ত অথচ আবেগঘন স্বরে বলতে উন্মুখ হলো,
– দীক্ষা তুমি কি সম্মতি দেবে যদি আমি বলি….
তার কথা শেষ হতে না দিয়ে দীক্ষা বলে উঠলো,
– উইল ইউ বি মাইন ফরএভার…?
সোনালি তার শত পুরুষের হৃদয়ে ঝড় তোলা এবং শত মহিলাকুলের কাঙ্ক্ষিত বাঙ্ময় দুই চোখের দৃষ্টি দীক্ষার দৃপ্ত চোখে নিবদ্ধ করলো। তারপর ধীরে ধীরে তাদের দু’জনের উষ্ণ ঠোঁটজোড়া আলিঙ্গনাবদ্ধ হলো। গোধূলি রঞ্জিত গঙ্গা-স্রোত যেন তাদের দুজনের হৃৎস্পন্দনে অনুরণন তুললো।
কলমে স্বাতী ভঞ্জ চৌধুরী, বসিরহাট, উত্তর ২৪ পরগনা
Write and Win: Participate in Creative writing Contest & International Essay Contest and win fabulous prizes.