শ্রাবণ শেষে অবিরত বৃষ্টির বিরাম ঘটেছে। আকাশের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা তুলোর মত মেঘ। উমার মনেও আজ খুশির জোয়ার এসেছে। ধানক্ষেত থেকে এক ছুটে বাড়ি এসে সে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো “মা, দুর্গাপুজো এসে গেছে তাই না”…. বাসন্তী এক গাল হেসে বলে “ওমা তুই কি করে বুঝলি রে ?…. উমা বলে “বুঝবো না? উজ্জ্বল আকাশের এক প্রান্ত থেকে এক ঝাঁক পাখি উড়ে যেতে দেখলাম যে ! আমি জানি দুর্গা পুজো এসে গেলেই তো ওরা আসে।” সাত বছরের উমার মুখে অমন গোছানো কথা শুনে মা খুব অবাক হয়। আর এটাও জানে মেয়ের এত আনন্দ কিসে। বাসন্তী হল ঠাকুর বানানোর কারিগর। উমার বাবা ঠাকুর বানানোর শিল্পী ছিলেন কিন্তু চার বছর আগে হঠাৎই তার মৃত্যু হওয়াতে বাসন্তী একা হয়ে যায়,ছোট্ট মেয়ে উমাকে বড় করবে কি করে ভেবে দিশাহারা হয়ে পড়ে। আর্থিক অবস্থাও খারাপ হতে শুরু করে। তাই অনেক ভেবে স্বামীর পেশাকেই বেছে নিয়েছিল সে। আজ বাসন্তী এক দক্ষ কারিগর। উমার বাবার ধরা বায়নাগুলো শেষ করার মাধ্যমেই তার কাজের হাতেখড়ি হয়েছিল। সব ঠাকুরের বায়নার মধ্যে রায় বাড়ির ঠাকুর ছিল সব থেকে পুরোনো, উমার বাবারা আরো তিন পুরুষ ধরে এই রায় বাড়ির ঠাকুর গড়ে আসছে। তারা বাসন্তীর স্বামী মারা যাওয়ার পরেও বাসন্তীর নিপুণ কাজ দেখে তাকেই ঠাকুর গড়ার দায়িত্ত্ব দেন। তবে চক্ষুদান রায় বাড়ির দালানেই করতে হয় এটাই তাদের বাড়ির পরম্পরা। পুজোর চারটি দিন বাসন্তীকে ওই বাড়িতেই কাটাতে হয়। তাই উমার আনন্দের সীমা নেই। সারাটা বছর ওই দিনগুলোর অপেক্ষায় থাকে মেয়েটি। জমিদার গিন্নি নিজে এসে বাসন্তীকে নিমন্ত্রণ করে যান। জমিদার গিন্নি বেশ রাশভারী মহিলা হলেও মনটা নরম মোমের মত। পুজোর দিনগুলিতে উমা যাতে খুব আনন্দ পায় তার জন্য একরকম জোর করেই তাদের নিয়ে যান তিনি। আর মেয়ের মুখ চেয়ে বাসন্তীও না করতে পারে না। তার যে জমিদার বাড়ি গিয়ে আনন্দ হয় না তেমন নয় কিন্তু সমাজের কিছু মানুষের কটুকথার সম্মুখীন হতে হয় তাকে। তবে গিন্নি মায়ের অফুরন্ত ভালবাসা সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়। একরত্তি মেয়েটাও গিন্নিমা বলতে অজ্ঞান। বাসন্তী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে আশ্বস্ত করে যে প্রতিবারের মতই এবারও তার যাওয়া হবে। রোজের গতানুগতিক জীবনে ব্যস্ত বাসন্তী বোঝে মেয়ের মন হিসেব কষতে শুরু করেছে সেই বাকি দিনগুলোর। বাসন্তীর প্রতিমা গড়ার কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়ে এসেছে। এবার শুধু রায় বাড়ির ঠাকুর দালানে পৌঁছানোর অপেক্ষা।
দেখতে দেখতে পঞ্চমী এসে গেলে রায় বাড়িতে প্রতিমার সঙ্গে মা ও মেয়েও হাজির হয়। বাসন্তী প্রতিমার অসম্পূর্ণ কাজটি শেষ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। উমা এসেছে এই খবর রায় বাড়ির ছোট্ট ছেলে বিল্টুর কান অবধি পৌঁছতেই সে এক ছুটে ঠাকুর দালানে চলে আসে। বিল্টুও একবছর অপেক্ষায় থাকে খেলার সাথীর জন্য। এক বাড়ি ভর্তি লোকের মাঝে ছোট্ট শিশু দুটি আজ খুব স্বাধীন। পুজোর কটাদিন সব শাসনের উর্ধ্বে গিয়ে দুজনে নিশ্চিন্তে খেলে বেড়ায়। সাথে আরো কচিকাঁচাও জোটে। ঢাকের আওয়াজ, ফুলের গন্ধ, ভোগ রান্না খাওয়া দাওয়ায় সে এক বিশাল উন্মাদনা সকলের মনে। সকলের ব্যস্ততার মাঝে বাসন্তীও পুজোর কাজ শেষ করে বাড়ির নানা কাজে লেগে পড়ে। যতই গিন্নিমা তাকে নিয়ে আদিখ্যেতা করুক কিছু লোকের চোখের বিষ ছিল বাসন্তী। তারা বাসন্তীকে বাকি পরিচারিকাদের থেকে কোন অংশেই বেশি সম্মান দিতে রাজি নয়। বিশেষ করে রায় গিন্নীর দেওরানী। উঠতে বসতে সে উমা ও তার মাকে নজরদারি করে বেড়ায়, অপেক্ষায় থাকে কখন কিসে ত্রুটি খুঁজে পাওয়া যায়। বাসন্তী তাই এই বাড়ি এলে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে,কি জানি কখন কি হয়।
ষষ্ঠীর দিন সকাল বেলায় শিউলী তলায় হালকা শিশিরে ভেজা দূর্বা ঘাসের উপর চাদরের মত ফুল বিছিয়ে আছে। উমা জামার কোচরে মালা গাঁথবে বলে জড়ো করেছিল। ছোট্ট ছেলে বিল্টুর এসব কাজে অতটা স্বাধীনতা নেই। বড়ো বাড়ির ছেলের অনেক নিষেধাজ্ঞা আছে। কিন্তু পুজোর কটা দিন তাকে ছাড় দেওয়া হয়। তাই উমার সঙ্গে ছোট ছোট খেলায় তার ভারী আনন্দ হয়। রায় গিন্নী দেখেন দুজনে আপন মনে ফুল কুড়োচ্ছে। ছেলেকে এত খুশি দেখে মনটা ভরে ওঠে তার। নিশিন্তে ঠাকুর দালানে ষষ্ঠী পুজোর আয়োজনে চলে যান তিনি। শিউলী গাছের কাছের পুকুরের পাড়টা খানিকটা শ্যাওলা ধরা। উমা তো বেশ সাঁতার জানে কিন্তু বিল্টুর সাঁতার জানা নেই। তবুও খেলার ফাঁকে সে বেশ খানিকটা পুকুরের দিকে এগিয়ে যায়। তার পিছন পিছন যায় উমা। বেশ কিছুক্ষণ পর বাসন্তী মেয়েকে খুঁজতে খুঁজতে শিউলী তলায় আসে কিন্তু সেখানেও মেয়েকে না দেখে বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। কিন্তু আচমকা এক চিৎকার শুনে পুকুর পাড়ে ছুটে যায় সে। সেখানে সবকিছু দেখে তার তো চক্ষুস্থীর হয়ে গেছে ততক্ষনে। বিল্টু তখন অচৈতন্য হয়ে ঘাটে পড়ে আছে। বাসন্তী তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে কোলে তুলে নেয়। সে আর উমা দুজনেই জলে ভিজে চুপচুপে। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাড়ির কিছু আত্মীয় হইহই করতে করতে ছুটে আসে। সাত পাঁচ না ভেবেই সোজা উমার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিতে থাকে সকলে। উমা একবার কিছু বলতে চায় কিন্তু তার কথা কে শোনে তাই মাথা নিচু করে থাকে বাসন্তী ও তার একরত্তি মেয়ে উমা। একবারও কারো সঠিক কারণ খুঁজে বের করার আগ্রহ ছিল না। বিল্টুর জন্য যত না চিন্তা তার চেয়ে রায় গিন্নির চোখে উমাকে খারাপ করার চেষ্টা বেশি প্রকট হয়ে উঠছিল। গিন্নীমা ও কর্তা ততক্ষনে এসে গেছেন ,তারা নিজের সন্তানের এরকম অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে বিচার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন তাই তারাও কিছু বললেন না। বাসন্তী যেন তাদের উত্তরেরই অপেক্ষা করছিল মনে মনে। কিন্তু সেটা হল না। বাড়িতে ততক্ষনে ডাক্তার এসে গেছে । ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা। কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে বিল্টুর জ্ঞান ফেরে। ততক্ষনে উমা ও তার মা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। গিন্নীমা আনন্দে বিল্টুকে জড়িয়ে ধরেন আর জানতে চান কি করে এমন হল। বিল্টু জানায় “ জানো মা আজ আমি উমার জন্যই আবার তোমার কাছে ফিরে এলাম । আমি উমার কথা না শুনে পুকুরপাড়ে ছুটে যাই, ও আমাকে জলে ঝুঁকতে বারণও করেছিল কিন্তু আমি শুনিনি। হঠাৎ পিছলে জলে পড়ে যাই কিন্তু উমা ঝাঁপিয়ে আমায় জল থেকে টেনে বের করে তারপর কিছু মনে নেই আমার।” গিন্নীমা লজ্জায় লাল হয়ে বাসন্তীর হাত ধরে বলেন “আমাকে ক্ষমা করো বাসন্তী ,ছেলের চিন্তায় নিজের জ্ঞান বুদ্ধি হারিয়ে উমাকে সন্দেহের চোখে দেখে কি যে মহাপাপ করেছি তা বেশ বুঝতে পারছি। আজ এই মেয়ে ও আমার ছেলের প্রাণ বাঁচিয়েছে। সমাজ সংসারে ঘটে যাওয়া কিছু ভুল ত্রুটি মানুষের বিবেককে জাগিয়ে তুলতে অনেক সাহায্য করে। ছোট মেয়েটি আমাদের সেই শিক্ষা দিল”। ততক্ষনে বাক্যবাণে জর্জরিত মা ও মেয়ে এককোনে দাঁড়িয়ে অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে। অন্যদিকে যাদের মুখে নিন্দার বুলি ফুটেছিল তারাও ভিড় হালকা করে ফেলে এক নিমেষে।
অন্যদিকে ঠাকুর দালানে দেবী বোধনের তোড়জোর শুরু হয়েছে। কাসর, ঘণ্টা, ঢাকের আওয়াজে আরাধনা শুরু হয়। চারিদিকে দ্বীপ জ্বালানো শুরু হয়ে যায়। গিন্নীমা উমা ও বাসন্তীকে নিয়ে ঠাকুর দালানে যান। সেখানে সবার সামনে তিনি বলেন এমনিতে দীপ জ্বালানো সহজ কিন্তু অন্তরের দীপ জ্বালানো খুব কঠিন। আজ মা এর বোধন কালে উনি আমাদের চেতনারও বোধন করিয়ে দিলেন উমার মাধ্যমে।।
কলমে সুস্মিতা বিশ্বাস, মুম্বাই
লেখালেখি এবং ছবি আঁকার পাশাপাশি লাবণ্য পত্রিকার সদস্য।
ভালো লাগলো ❤️👍🏻