অন্ধকার রাস্তা – বাইরে একটা লণ্ঠনও জ্বলছে না।
একটি যুবক বটগাছের আড়াল থেকে পরিস্থিতি দেখছে – দেখছে সময়টা অনুকূল কি না ।
নিজের ধুতির মধ্যে কোনরকমে তার রিভলভার ও ২০-২৫ টা গুলি সামলে রাখে, আর ভাবতে থাকে, “কোন বাড়িতে আজকের মত আশ্রয় নেওয়া যায়?”
পা টিপে টিপে দেখতে থাকে কোন বাড়িটা সুরক্ষিত। হঠাৎ তার ডান হাতে একটি কুটির থেকে একটি বেশ বয়ষ্ক বৃদ্ধের গলা শোনা যায় –
” খোকাবাবু কি কোনো আশ্রয় খুঁজছে? চলে আসো খোকা”।
সঙ্কুচিত চোখে দেখতে পায় এক সাধুবাবা তার কুটিরে বসে ধ্যান করছে – দরজা ভেজানো, কিন্তু যুবকটির মন টা কেমন করছে।
“ঢুকে পরো। না হলে ইংরেজরা এলে -“
কথাটা শেষ হতে না হতে যুবকটি ঢুকে পড়ে কুটিরে । সাধুবাবা দরজা লাগাতে বললে সে ছিটকিনি তুলে দেয়। কপালের ঘাম জামার হাতা দিয়ে মুছতে থাকে যুবকটি।
বাবার কাছ থেকে বসার অনুমতি পেয়ে মেঝেতে বসে অনেকক্ষন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতে থাকে যুবকটি।
চোখ মেলে তাকিয়ে সাধুবাবার ঠোঁটের কোণে একটি হাসি ফুটল, বলে উঠলো,” আজ কটা ইংরেজকে মারলে?”
হতচকিত ভাবে যুবকটি বললো, ” মা – মানে?”
“১৯৩৪ সালের ৪ ঠা আশ্বিনের রাত ১১:৩০ টার সময়ে এই গ্রামে অন্তত কোনো শিষ্য আমার এই কুটিরে চিন্তিত অবস্থায় আসতে পারে না – শুধু এক বিপ্লবী বাদ দিয়ে। তাই বলছি,কটা মারলে?”
“দুজন। ওরা খুব অত্যাচারী ছিল – মেয়েদের অসম্মান করতো, গরীবদের পেটে লাথি মারত, অপমান করে এই দেশকে। দিন কে দিন দেখে গেছি – একটা সুযোগ খুঁজছিলাম শুধু। আজ পেলাম।”
মিচকি মিচকি হাসতে থাকে সাধুবাবা – তার ঘন দাড়ি – গোঁফের আড়ালে এই হাসি ঠিক বোঝা যায়নি। সে বলে উঠল, “বেশ করলে। গোড়া থেকে অত্যাচারকে নির্মূল করলে। তা,তুমি শ্রীশ পালের যুগান্তর থেকে এসেছ?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু আপনি জানলেন কি করে?”
” তোমার চোখের সেই তেজ দেখে বুঝেছিলাম- তুমি যুগান্তকারী এবং তোমার মধ্যে দেশপ্রেমের প্রদীপ শ্রীশ পাল ছাড়া কেউ জন্ম দিতে পারেনা।”
লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করে যুবকটি। সাধুবাবা বলেন, ” সবাই তো একরকম গান্ধীর পথ নির্ধারণ করেছে,তুমি নাওনি কেন?”
একটু বেশ জোর গলাতেই বলে যুবকটি,”তার আর আমাদের পথ আলাদা। সে ক্ষমতায় ভারতীয়দের রাখতে চায় কিন্তু দেখতে চায় যে ইংরেজরা হুকুম করছে কি না। তার জন্যই দেখুন, আমরা ভগৎ সিং এর মত বিপ্লবীকে হারিয়েছি! কিন্তু অন্যদিকে আমরা চাই বিপ্লব – ক্ষমতা আর হুকুম দুটোই আমরা আমাদের ভারতীয়দেরকে দিতে চাই – যাতে দেশে সার্বিক কল্যাণ হক,সেটাই আমরা চাই। তাই সশস্ত্র বিপ্লব আনতে চাই”
হঠাৎ দরজাতে ধাক্কা পড়তে থাকে। সন্ত্রস্ত হয়ে যুবকটি একটা আলমারির আড়ালে লুকিয়ে পড়ে – অপেক্ষা করে কিছু অস্বাভাবিকের জন্য।
কিন্তু সাধুবাবা তাকে শান্ত হয়ে থাকতে বলে এবং আস্তে আস্তে দরজা খোলে – দেখে তিনজন উর্দিধারী সশস্ত্র পুলিশ দাড়িয়ে।
“কিসিকো দেখা হায় ভাগতে হুয়ে , সাধুজি?”
“নেহি তো, হাম ধ্যান কর রহে থে।”
পুলিশরা তাও উঁকি মেরে দেখে কেও আছে কি না – কিন্তু কিছু বই, লাল শালু কাপড়, পুজোর সামগ্রী ও আলমারি বাদ দিয়ে কিছু নেই। অন্যদিকে, সেই আলমারির আড়ালে নিশাশবন্ধ করে যুবকটি দাড়িয়ে আছে, শুনতে পাচ্ছে সব কিছু।
” ঠিক হায়। লেকিন কুছ পাতা চালে তো বোলনা”, বলে পুলিশগুলো বেরিয়ে গেলো।
দরজা বন্ধ করে সাধুবাবা বলে, ” বেরিয়ে আসো। ভয় নেই।” আড়াল থেকে পরিস্থিতি দেখে বেরিয়ে এসে সাধুবাবার কাছে বসে পড়ে যুবকটি।
সামনের কলাপাতাতে ফল – মিষ্টি ও জলের কলসি এগিয়ে সাধুবাবা যুবকটি কে খেতে বলে । খিদেও খুব পেয়েছিল, সেটা যুবকের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল। তাই সবটা সাবাড় করে দেয়ে সে।
” তুমি হও বিপ্লবী। কিন্তু তোমার মধ্যে শিশুসুলভ আচরণ এখনও আছে”, বেশ নরম ভাবে হেসে বলে সাধুবাবা।
খাওয়া শেষ হলে ভোজনের জন্য ধন্যবাদ জানায় যুবকটি। তারপর সাধুবাবা বলে, ” তোমার আর আমার মধ্যে কিন্তু খুব একটা তফাৎ নেই।”
যুবকটি বলে, ” বুঝতে পারলাম না। কি ভাবে এটা বলছেন?”
” তুমি দেশের মঙ্গল চেয়েছ সরকারের পরিবর্তন এনে, আমি মানুষের মঙ্গল চেয়েছি তাদের কুৎসিত মনের পরিবর্তন এনে। তুমি তোমার দেশমাতৃকার হাতের শিকল ভেঙে তাকে কম সময়ের মধ্যে মুক্তি দিতে চেয়েছ, আমি মানুষের মধ্যে ঘৃণার খাঁচা কে ভেঙে গুড়িয়ে তাকে সেই সাদা পায়রার মত মুক্তি দিতে চাইছি। হ্যা, আমার ক্ষেত্রে সময় লাগতে পারে, তা ঠিকই। কিন্তু সত্যি বলতে কি, তোমার আর আমার মধ্যে অনেক মিল আছে।”
যুবকটি মাথা নিচু করে রাখে – ভাবে যে তিনি কি ভাবে এই অত্যাচারী সময়েও মানুষকে সঠিক দিক দেখানোর ইচ্ছে রাখতে পারেন। যেখানে জায়গায়ে জায়গায়ে বিশ্বাসঘাতকের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে, তিনি কি ভাবে মানুষকে একটি প্রকৃত রূপ দেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। যুবকটি শুধু চিন্তা করছে, “আমার সাথে আপনার মিল কম,অমিল বেশি আছে”।
কিন্তু সাধুবাবা তার থুতনিতে হাত রেখে তার মুখ তুলে বলে, ” এতে তোমার লজ্জা কেন? তুমি কি করেছ? তুমি অত্যাচারিত কে বাঁচানোর জন্য অত্যাচারীদের অস্তিত্বকে সরিয়ে দিতে চেয়েছো – আমি অত্যাচারকে মানুষের মন থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছি। তোমার মন পরিষ্কার বলে তুমি দেশকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছো ,নাহলে কেও করতো না। আমিও মানুষের মনুষ্যত্বকে বাঁচানোর জন্যে নিজের জীবন ত্যাগ করেছি। জানি আমাদের লড়াই খুব কঠিন,কিন্তু চালিয়ে যেতে হবে।”
কেমন যেন একটা শ্রদ্ধা আর ভক্তি জেগে ওঠে সাধুবাবার প্রতি। কেমন যেন একটা বিপ্লবীর প্রতি শ্রদ্ধা যেমন হয়,তেমন। সে বলে, ” ঠিক বলেছেন”।
এরম করেই রাতটা কেটে যায় – কখনো সাধুবাবা নিজের জীবন ও সমস্ত সংসার,সুখ ত্যাগ ও শান্তির পথ খোঁজার অনেক গল্প বলেন। কখনো যুবকটি নিজের জীবনের কাহিনী,তার মা – বাবা – বোনের গল্প, তার খেলাধুলোর কৃত্রিম হাওয়ার গল্প,তারপর যুগান্তর , বন্দুক চালানো,বোমা বানানো আর লাঠিখেলা,কুস্তির গল্প বলে।
এই হাসি ঠাট্টার মধ্যে কখন যে যুবকটি ঘুমিয়ে পড়ে, সে নিজেও জানেনা। সাধুবাবা তার ওপর চাঁদর টেনে দিয়ে নিজে পরে কিছু শাস্ত্র পড়ে ঘুমিয়ে পড়েন।
তখন অনেক সকাল যখন যুবকটি জেগে যায়। সে কিছুক্ষন ঘুম চোখে এদিক ওদিক দেখতে থাকে চারপাশ। কিন্তু হঠাৎ তার মনে পড়লো যে সাধুবাবা তো নেই। তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও সে সাধুবাবা কে খুঁজে পায়নি।
তারপর জলের ঘটির পাশে একটি কাগজ দেখতে পায়,যেখানে কিছু লেখা আছে। যুবকটি সেই কাগজ পড়ে,যেখানে লেখা আছে –


হে প্রিয় বিপ্লবী,
তোমাকে দেখে আমার ছেড়ে আসা ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ে। সে তোমার মতই দেশপ্রেমিক, সেও খেলাধুলোতে নামজাদা। তোমার স্বপ্ন ও লক্ষ্য শুনে আমার ওর কথা মনে পড়লো। তোমার চোখের ও মনের দৃঢ়তা দেখে এটা জানলাম যে তুমি দেশোদ্ধারের জন্য প্রাণপাত করতে তৈরি আছ। কিন্তু তোমাকে একটা কথা দিতে হবে – তুমি দেশকে মুক্তি দেবে তো বটে, দেশ নির্মাণের জন্য তোমাকে এগিয়ে আসতে হবে – তখনই তোমার বিপ্লব সফল হবে। কারণ তুমি একটা পাখির ছানাকে জন্ম দিলে, কিন্তু যদি উড়তে কি করে হয় সেটা না শেখাও, তাহলে ওর থাকা না থাকা সমান – তখন যে কেউ এসে পদদলিত করে দেবে। তাই তাকে উড়তে শেখাও,তাহলেই সে নিজের সঠিক মানে জানবে – সে মুক্ত হয়ে উড়তে পারবে। যাই হোক, তুমি তোমার লড়াই চালিয়ে যাও, জানিনা আমি কদিন বাঁচবো,কিন্তু যতদিন বাঁচব,আমিও আমার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার দিকে এগিয়ে যাব। কিছু টাকা রেখে গেলাম পরের যাত্রার জন্য। শুভেচ্ছা জানাই তোমার বিপ্লবকে । দেখা হবে আবার, এক প্রকৃত মুক্ত ভারতে।

ইতি,
তোমার বিপ্লবী


একটা হালকা হাসি ঠোঁটের কোণায় আসে যুবকটির। “না এখন থেমে থাকলে হবে না – অনেক দূর যেতে হবে”। চিঠিটাকে আর টাকাটাকে বুক পকেটের মধ্যে রাখে। নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে এক সাদা পায়রা কেমন মুক্ত ভাবে উরে যাচ্ছে – যেন আজ ও স্বাধীনতা পেল ওড়ার জন্য।
মনে হয় এটাকেই বলে, এক বিপ্লবীকে এক বিপ্লবীর চিঠি।

কলমে অনীশ দত্ত, ব্যারাকপুর, কলকাতা, বয়স – ১৯+

স্কটিশ চার্চ কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। ইতিহাস নিয়ে স্নাতকের পড়াশোনা। লেখা লেখি একটু ভালো লাগে। রাজনৈতিক,খেলা, ইত্যাদি বিষয় চর্চা করা। দশম এবং দ্বাদশ শ্রেণী বেলঘরিয়া অ্যাডামস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল থেকে পাশ করেছি। ২০১৯ থেকে লেখালেখির জগতে প্রথম হাতেখড়ি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here