কাঁদছে মেয়েটা। অজস্র, অবাধ্য অশ্রু গড়িয়ে আসছে চোখের কোল বেয়ে। ভিজিয়ে দিচ্ছে ওর বুক, মুখ। এক অসহ্য ব্যথায় দুমড়ে মুচড়ে উঠছে কচি মন। তবু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কবিতা। তারপর থেকে আর একটা কথাও বলেনি। কাঁদুক। কেঁদে কেঁদে হাল্কা হোক। ক’রে নিক নিজের মনের সঙ্গে বোঝাপড়া। তবে তো ফিরতে পারবে আপন বৃত্তে। হ্যাঁ অনেকটা লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হল। হয়ত আরো করতে হবে। তবু .. বুকের ভেতরের ভারটা উধাও হয়ে গেছে আজ। বড় বেশি ভারমুক্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। এতদিন ধরে যার প্রত্যাশা ছিল আজ হঠাৎ এ বেশে সে দেখা দেবে কে ভাবতে পেরেছিল? হ্যাঁ। মূল্য হয়ত একটু বেশি-ই দিতে হল। তা হোক। একদিন না একদিন এ যন্ত্রণা তো নিতেই হত। নিক। চিনুক নিজেকে। উপলব্ধি করুক নিজের অস্তিত্ব। কষ্ট তো হবেই। নিজের অস্তিত্বের সাথে লড়াইতে হার মানতে হল যে শেষ পর্যন্ত। ভাবেনি কবিতা এই দিন আসবে ওর জীবনে কখনো। আশাই ছেড়ে দিয়েছিল। প্রতিটি রাত্রি—প্রতিটি দিন বিষে বিষে বিষময়। দূর্বিসহ।
আর আজ! কিভাবে মন্ত্রবলে যেন পালটে গেল দিনটা! যেন ভাগ্যলক্ষী হাতে করে তুলে দিয়ে গেলেন! অথচ আজও তো শুরু হয়েছিল এক-ই ভাবে। সেই গতানুগতিক ভঙ্গিমায়। সেই চিৎকার, সেই অশান্তি, সেই নিরুপায়তার কান্নায়।
স্কুল কলেজ ছুটি আজ। বাবু খেয়েদেয়ে লাইব্রেরি গেছে। মেয়ে নিজের ঘরে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে দেখে নিশ্চিন্তে বিছানায় গা এলিয়েছে কবিতা। একটু ভাতঘুম মতও এসেছে। হঠাৎ কেন কে জানে একটা অস্থিরতা টেনে তুলে দিয়েছে ওকে বিছানা থেকে ! নিঃশব্দে গিয়ে ঢুকেছে বাবুর ঘরে। যা ভেবেছে ঠিক তাই। আজও ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বাবুর হাফহাতাশার্ট আর ফেডেড জিন্স পরে একমনে নিজেকে দেখছে মেয়ে। বুকের ওপরের দিকের বোতামটা খুলে রেখেছে। যেমন বাবু রাখে। ভেতর দিয়ে স্যাণ্ডো গেঞ্জির একটুখানি দেখা যায়। গেঞ্জির বর্ডারের কাছে ঝোলে চেনের ছোট্ট লকেটটা! ঠিক সেই রকম। আর আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছে বুকের দুপাশে ঠেলে ওঠা মাংসপিণ্ড দুটোকে বশে রাখতে ! পারছে না। তাও–। দেখেই মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠেছে ,
“ আবার তুই বাবুর জামা প্যান্ট পরেছিস ?’’
থতমত খেয়ে পিছনে ফিরে তাকাতেই চুলের মুঠি চেপে ধরেছে ,
“কী হল ? উত্তর দিচ্ছিস না যে ? তোকে হাজার বার বারণ করেছি না – তুই বাবুর জামা কাপড় পরবি না–’’
“আমার ভাল লাগে। কী হবে পরলে ?–’’
কথা শেষ করার আগেই প্রচণ্ড জোরে গালে এক থাপ্পড় কষিয়ে দিয়েছে কবিতা, “ আবার মুখে মুখে কথা ! লজ্জা করে না ? খোল — খোল বলছি শিগগির। নির্লজ্জ ! বেহায়া ! আবার গেঞ্জি পরেছে –! বেরো– এক্ষুনি বেরো এ ঘর থেকে ’’ মারমূর্তি হয়ে আবার তেড়ে গেছে ওর দিকে । কয়েক পলক স্থির দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে চেয়ে থেকে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে মেয়ে। আর সেদিকে তাকিয়ে মুহূর্ত আগের তীব্র ক্রোধ হঠাৎ-ই অসহায়তার অশ্রু হয়ে নেমে এসেছে কবিতার চোখে! হায় ভগবান! এ কী অনাসৃষ্টি ! দিনকে দিন কী হচ্ছে এসব? তবে কি– যা টি.ভি. তে দেখে–চারদিকে শোনে.. সেরকম-ই
কিছু? ছি—ছি-! যদি সত্যি হয় ! লোক সমাজে মুখ দেখাবে কী করে? কিন্তু কেন.. কোন পাপে কবিতার-ই এমন হল? ওর তিনকুলে এমন সৃষ্টিছাড়া ঘটনা তো একটাও নেই ! চন্দনের দিকেও সব-ই স্বাভাবিক! তবে কোথা থেকে এল এরকম ভয়ঙ্কর..সর্বনেশে ব্যাধি ! হ্যাঁ ব্যাধি-ই তো ! একেবারে তছনছ করে দিচ্ছে ওর সুখের সংসার !
অথচ এমন তো ছিল না ! এই তো ক’ বছর আগে পর্যন্ত সব ঠিকঠাক-ই ছিল। অন্যের চোখে ঈর্ষা জাগানোর মত সুখী পরিতৃপ্ত সংসার ! সুন্দর..সুকান্তি ছেলে..ফুলের মত ফুটফুটে মেয়ে। কই ! বোঝে নি তো কখন ভেতরে ভেতরে ঘটে চলেছে এই চরম সর্বনাশ? কতবার বারণ করছে…কতরকম করে বোঝাচ্ছে…কিছুতেই কিছু নয় ! সেই একই চাল! একই ধরণ! তবে কি কবিতার শিক্ষায় কোন গলদ ছিল? খামতি ছিল কোথাও ওকে বড় করে তোলায়? কোন ত্রুটি, ঔদাসীন্য? দেখেও না দেখার কিছু ভুল? শিশুর খেয়াল ভেবে এড়িয়ে যাওয়া কোন ভয়ঙ্কর সত্য? কিন্তু… কি করে হয় তা? নিজের মনেই ঘাড় নাড়ে কবিতা। একে কি ভুল বলে? দুটি ভাইবোন ! একের পোশাক অন্যে পরেনা? পরে তো। কবিতার ছোট ভাই তো সব ওর-ই ছোট হয়ে যাওয়া সোয়েটারগুলো প’রে বড় হয়েছে ! কবিতা নিজে পরেনি ওর দাদার শার্ট ?
কই ! এরকম কোন সমস্যা তো হয়নি কখনো? তাহলে? এর এরকম কী করে হল?
ছোট থেকেই অদ্ভূত বায়না লেগে থাকত মেয়ের, ” দাদার জামাটা পরব মা ? দাদার মত সাজব মা ’’
নিজের অগুন্তি আছে। তাও ! কানে ঠেকলেও এইরকম সাঙ্ঘাতিক কিছুর কল্পনা … অতি বড় দুঃস্বপ্নেও করে নি ও। অথচ তাই হল। প্রথম দিকে তো বুঝতেই পারেনি। যখন বুঝল … পায়ের তলার মাটিটাই যেন কেমন সরে সরে যাচ্ছিল! বিশ্বাস-ই হতে চায়নি ! সাময়িক খেয়ালে শিশু মনে একটু আধটু এসব হতেই পারে ! তা ব’লে-! চন্দনও ভরসা দিয়েছিল তখন। প্রায় সমবয়েসী দু ভাই বোন। ফারাক করতে পারছে না। সময়ে সব কেটে যাবে ! চন্দনের কথায় যুক্তি ছিল। ভেবেছিল সামাল দেওয়া যাবে। যত বড় হবে…মেয়েলি সম্পদে সম্পন্না হবে …ততই নিজের অস্তিত্বে বিশ্বাসী হয়ে উঠবে মেয়ে। কিন্তু হলো না তো ! বরং দিন-কে-দিন প্রবল…আরো প্রকট হয়ে উঠতে লাগল লক্ষণগুলো ! আজকাল নিজের নামটা পর্যন্ত পুরো বলে না। সেবার দিল্লী থেকে চন্দনের মামাতো ভাই- ভাইয়ের বউ এলো। নাম জিজ্ঞেস করতে বেমালুম বলে দিল “ শুভ’’ ।
চন্দন তো হাঁ ! কোনরকমে “শ্রী’’ টুকু বলে ম্যানেজ করল। ওরা কি আর বোঝে নি? ঠিক-ই বুঝেছে। ওইরকম চালচলন ! হাব ভাব। যে ক’টা দিন রইল ওরা…
হাতকাটা গেঞ্জি আর বারমুডা পরে বাড়িময় ঘুরে বেড়ালো। ঠিক যেমন বাবু পরে ! মেরেধরেও ওই দুটো দিন একটা ফ্রক কি ম্যাক্সি পরাতে পারল কবিতা? অথচ মেয়েলী গড়ন তো সব রয়েছে! আগে তবু বকাবকি করলে ভয় পেত ! ইদানীং লক্ষ্য করছে চোখের চাউনিও বদলাচ্ছে ! সঙ্গে মুখের ভাষাও ! একদিন তো স্পষ্ট বলেই দিল—
“ সবসময় টিকটিক করনা তো। আমাকে আমার মত থাকতে দাও। দাদাকে তো জামা পরা নিয়ে কোনোদিন খিচখিচ করো না ?’’ শুনে কাঁদবে কি মাথা চাপড়াবে ভেবে পায়নি কবিতা ! চিৎকার করে হাত তুলে ছুটে গেছে ! চন্দন না ধরে ফেললে রক্তারক্তি হয়ে যেত।
সুযোগ পেলেই বাবুর ঘরে ঢুকে বসে থাকবে ! এমন কি–! ছি ! ছি ! কী লজ্জা ! সেদিন বাবুর জাঙ্গিয়াটা পর্যন্ত পরার চেষ্টা করেছে ! গিয়ে কেড়ে নিতে এমন চোখে তাকাল …যেন দোষটা কবিতার-ই। মেয়েলী সব কিছুতেই অরুচি ! চোদ্দ পেরোয় নি এখনো ! অথচ বুকের আভাস বেশ স্পষ্ট ! বাড়নশা গড়ন ! পছন্দ করে দামী কোম্পানির অন্তর্বাস কিনে নিয়ে এল কবিতা – আহ্লাদ করে নেওয়া দূরের কথা… ছুঁয়েও দেখলনা ! বরং –কেমন আড়ষ্ট ভঙ্গী ! অথচ এই বয়সে এগুলোর প্রতি একটা আকর্ষণ জন্মানোই তো স্বাভাবিক! সব উলটো ! স্কুলের ড্রেস পরে যেতে হয় তাই। বাড়ি ফিরতে তর দেয় না ! সেই বাবুর ফেলে দেওয়া…পুরোন হয়ে যাওয়া…রংচটা বারমুডা আর গেঞ্জী…অঙ্গে তুলবে ! তাও আটকাতে চেষ্টা করেছে কবিতা। একদিন বাবুর সব পুরোন জামা প্যান্ট সরিয়ে ফাঁকা করে দিয়েছিল ওয়ার্ড্রোব। নতুন বা যেগুলো বাবু রোজ পরে সেসবে হাত দিতে সাহস করবে না জানে। একমাত্র ওকেই যা একটু ভয় পায়। মনে মনে তড়পাচ্ছিল কবিতা। …পরাবোই তোকে আজ তোর নিজের জামা। স্কুল থেকে ফিরতেই সরে গেছে সামনে থেকে। দেখা যাক কী করে ?
বাড়ি ফিরে ওয়ার্ড্রোব খুলে ধাক্কা যে খেয়েছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। মনে মনে তখন হাসছে কবিতা। বোঝ এবারে ঠ্যালা ! কী করবি এখন? দাঁড়িয়ে কী ভাবলো কে জানে …সোজা ঢুকে গেল ওদের বেডরুমে। তখনো বোঝে নি কবিতা। রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে বেরিয়ে স্তম্ভিত ! চন্দনের একটা লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী গায়ে চড়িয়ে ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ তুলে খোশমেজাজে বসে আছে মেয়ে !
এরপর আর দেরী করেনি। টেনে নিয়ে গেছে ডাক্তারের কাছে ! কিন্তু লাভ কী হলো? ডাক্তার তো বললেন …সব-ই নর্ম্যাল! তাহলে? এই রকম পুরুষালী ভঙ্গী ! হাঁটাচলা—কথাবলার ধরণটা অবদি বদলে ফেলেছে ! নিজেকে সবসময় পুরুষ ভাবা ! ছেলেদের জিনিসের দিকে অস্বাভাবিক ঝোঁক! এগুলো নর্ম্যাল? ডাক্তারের বক্তব্য …এরকম হয় কিছু কিছু ক্ষেত্রে। হরমোনাল সমস্যা। কেটে যাবে। বোঝান…বকাবকি একদম নয়। মেয়েদের সাথে মিশতে দিন। মেয়েদের জিনিস ব্যবহার করান। ডাক্তার তো বলেই খালাস। করলে তো ! ওর তো বন্ধু মানেই যত রাজ্যের ছেলে। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাজ-পোশাক, কথাবার্তা…এমন কি ওদের সাথে মিলে মেয়েদেরকে লেগ- পুলিংও ! অবাক হতেও ভুলে যায় কবিতা রকম সকম দেখে ! কোথাও সেই ফুটফুটে নরম সরম মেয়েটাকে খুঁজেই পায়না আর ! সেদিন তো রীতিমত অশান্তি করে চুলও কেটে এল নিজের পছন্দ মত ! কি বিশ্রী ! চেয়ে চেয়ে দেখেছে আর পুড়েছে তিলেতিলে। দগ্ধ হয়েছে নিরুপায়তার, অসহায়তার দহনে। আজকাল গভীর হতাশা দেখে চন্দনের চোখেও। মেয়েটা সত্যি-ই ক্রমে ক্রমে অচেনা হয়ে উঠছে ! ইদানীং ও বাথরুম থেকে বেরোলে আফটার শেভ লোশনের গন্ধ পায়। চন্দন তো এ বাথরুমে আসেই না ! তবে ? কে জানে এসবও ব্যবহার করছে কিনা ! এক এক সময় রাগে, দুঃখে মাথায় আগুন জ্বলে যেন! মনে হয় মাটিতে ফেলে ছিপটি দিয়ে পেটায় ! মার-ই বোধহয় এর একমাত্র ওষুধ। কিন্তু পারে কই? ওপরে যতই রাগ দেখাবার চেষ্টা করুক ভেতরে ভেতরে নিজের জোরের উৎসে টান ধরেছে। নিয়তির কাছে… ভাগ্যের কাছে নতি স্বীকার? তাই হবে ! আজ নয় কাল আত্মীয় –বন্ধু- বান্ধব সবাই জানবে। লুকিয়ে রাখবে কী করে? চোখে পড়ে না লোকের?
সেবার খুড়তুতো বোন মনার দেওরের বিয়েতে সাজ পোশাক , ধরণ – ধারণ দেখে রঞ্জনা বউদি তো বলেই বসল, “ মেয়েটাকে এরকম সাজিয়ে এনেছো কেন গো ? এত সুন্দর মেয়ে ! ও–কী সাজ ! হাতে আবার স্টীলের বালা ছেলেদের মত ! এরকম ভাবে চুল কাটিয়েছো কেন? তোমার তো একটা ছেলে রয়েছে ! আবার মেয়েটাকেও ছেলে সাজাচ্ছো ?’’
সারা বিয়ে বাড়ির আলো যেন চোখের ওপর নিভে গেল। সবার নজরে পড়ছে। কত করে বলল …একটা ভালো গাউন বা নিদেনপক্ষে সালোয়ার কামিজ পর …। শুনল কথাটা? লোকে তো বলবেই। তাদের কি দোষ ?
সবচেয়ে বেশি যেটা চোখে লাগে তা ওর ওই ভাব ভঙ্গী। সারা বিকেল নীচের পার্কে বসে গুলতানি করবে পাড়ার ওই এক দঙ্গল ছেলের সঙ্গে ! কী যে এত কথা বলে হাত নেড়ে নেড়ে? কপাল ! না হলে ওর-ই বা কেন এমন হবে ! এই তো পূজা, শ্রীময়ী, সৃজিতা – কী সুন্দর ওর-ই বয়সী মেয়ে সব ! কেমন ঘুরছে –ফিরছে – দেখে চোখ জুড়োয়। আর ওর ভাগ্যে-ই এইরকম ! সব ছেড়ে দিয়েছে কবিতা। ক্লাব, কিটি পার্টি—সব। শুধু শুধু লোকের কাছে হাস্যাস্পদ হয়ে লাভ কি ? মুখে সবাই সহানুভূতি দেখাবে। জেনেও না জানার ভান করবে—কিন্তু পেছনে হাসবে। বুঝতে ঠিক-ই পারা যায়। তারপর পার্কে বসে ওই বখাটে ছেলেগুলোর সঙ্গে আড্ডা মারা ! কেউ ভালো চোখে দেখে ? বললে কী চোপা মেয়ের !
—ওরা আমার বন্ধু। কেউ বখাটে নয়। সবাই ভাল স্কুলে পড়ে। আর আমার ওই ন্যাকা ন্যাকা মেয়ে গুলোর সাথে কথা বলতে ভাল লাগে না। —
— তা লাগবে কেন? তাতে যে বাপ মায়ের শান্তি হয়। স্বস্তি পায়। গা জ্বলে যেন।
শুধু একটা সময়-ই খুব তৃপ্তি হয় ওর। যখন ভেতরে টাইট অন্তর্বাস প’রে—তার ওপরে টাইট গেঞ্জি চাপিয়েও বুকের আভাস ঢাকতে পারেনা যখন… অস্বস্তিতে ছটফট ক’রে বারবার জামা টেনে টেনে দুপাশটা প্লেন করার চেষ্টা করে ! ভয়ঙ্কর আনন্দ হয় তখন! আরে ! হাত বুকের ওপর রেখে সবার চোখ এড়ালেই কি ও ঢাকা যায়? আর বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখে না কবিতা… ওই মন্টু, বিজন, বাপির চোখ থেকে থেকে-ই ঘুরে যায় না ওর বুকের ওপর দিয়ে? কিন্তু বললে মানতো মেয়ে? মানতো না।
আর আজ! ওইভাবে ফিরে এল! সেই বুঝল। কিন্তু দেরী করে ফেলল। যখন “ মা ’’ ব’লে চিৎকার করে উঠল – চমকে গেছে কবিতা। কিন্তু ওঠেনি। একবার নয় পরপর দুবার মেয়ের কান্নারুদ্ধ গলা সজোরে এসে আঘাত করার পর চেতনা ফিরেছে। কী এক অজানা আশঙ্কা দলা পাকিয়েছে বুকের কাছে ! কখন ফিরে এলো মেয়েটা? এই তো মার খেয়ে বেরোল। গলাটা অন্যরকম লাগছে মনে হচ্ছে ! কী হল? কাঁদছে কেন? বাথরুমের দিক থেকেই আওয়াজটা আসছে না? বাথরুমে ঢুকেছে? তো? কাঁদার কি হল আবার?
“কী হয়েছে ! এই তো। ডাকছিস কেন ?’’
আর দেরী না ক’রে দ্রুত বাথরুমের দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে কবিতা। ভেজানো দরজা সামান্য ঠেলা দিতেই খুলে গেছে। আর ভেতরে এক পলক দৃষ্টিপাত করেই নিমেষে বুঝে নিয়েছে ব্যাপারটা।
নিজের নিম্নাঙ্গের দিকে ভয়ার্ত… আড়ষ্ট… চোখে চেয়ে আছে শুভশ্রী ! তীব্র অবিশ্বাস সেই চোখে ! আর কবিতার দু চোখকে মুগ্ধ করে ওর দুই উরু বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় গড়িয়ে নামছে… নারীত্বের অহঙ্কার ! রমনীর অলঙ্কার !- আসন্ন যৌবনের মাধুর্য্য ! নেমে আসছে সুগভীর রক্তিম মহিমায় ! ধন্য করছে ওর নারী সত্ত্বাকে ! মাঝে মাঝেই কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর সর্বাঙ্গ ! যন্ত্রণায় কুঁচকে উঠছে মুখ ! আর সেই সঙ্গে আজ কতদিন পর ওই রুক্ষ, চোয়াড়ে হয়ে আসা মুখের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে বহু আগের হারিয়ে যাওয়া এক নিস্পাপ কিশোরীর কোমল পেলব মুখশ্রী। দেখতে পাচ্ছিল কবিতা ! দেখতে পাচ্ছিল নারীত্বে বদলে যাওয়া এক অবাধ্য বুনো ঘাড়– ছটফট করছে নিরুপায়তার জ্বালায় ! মুক্তি চাইছে এই অসহায়তা থেকে।
এই দিনটার-ই অপেক্ষা করেছে ও এতদিন। ডাক্তার বলেছিলেন হবে। হবেই। দেরী হচ্ছে কারণ মেন্টাল দিকটা সাঙ্ঘাতিক স্ট্রং। কিন্তু ভয়ের কোন কারণ নেই। অন্তর্বাস কাচতে গিয়ে কিছু কিছু লক্ষণ দেখে নিজেও বুঝছিল কবিতা। শুধু দিনটা আসার-ই প্রতীক্ষা। আজ সেই দিন। দু চোখ ভরে দেখেছে কবিতা। আর খুশিতে ভরে উঠেছে বুক।
“ মা—প্লীজ –কিছু কর— এসব কী ! কেন ? আমার যন্ত্রণা হচ্ছে মা !’’
“ ও কিছু না। মাসে মাত্র চারটে দিন। ঠিক হয়ে যাবে। একটু সহ্য কর। ’’
“ মানে? প্রতি মাসে এরকম হবে নাকি ?’’
“ সব মেয়েদের-ই হয় এটা। এতে এত ভয় পাচ্ছিস কেন ?’’
“ওদের হয় না?’’
বুঝতে অসুবিধা হয় নি কাদের কথা বলছে ও। জোর করে তবু ঠাণ্ডা রেখেছে মাথা।
“ না। ওদের হয় না। ওরা ছেলে। আর তুমি মেয়ে। বুঝেছ তুমি মেয়ে –’’
“ মা—’’
আবার একটা আর্ত চীৎকার সঙ্গে কান্না নাড়িয়ে দিয়েছে কবিতাকে। যেন প্রলয়ের পুর্বাভাস।
“ কি হল ? এতে এত কাঁদার কি আছে? ব্যবস্থা করছি। বলছি তো ভয়ের কিছু নেই। শুধু এবার বুঝতে শেখো। আর এসব বন্ধ কর — ’’
“ মা –ওরা আমাকে –’’
যেতে গিয়েও চমকে পিছন ফিরে তাকিয়েছে কবিতা। “ তোকে? কি করেছে?’’
“ওরা আমাকে আজ বিশ্রীভাবে হেসেছে মা। আমার জামায় দাগ দেখে খারাপ কথা বলেছে। ওই মন্টু। আজ হঠাৎ আমাকে জাপটে ধরে –’’
বাকিটা আর বলতে পারেনি শুভশ্রী। অবরুদ্ধ কান্নায় ভেঙ্গে প’ড়ে দুহাতে মুখ ঢেকেছে ।
অন্য সময় হলে কী করত কবিতা কে জানে। আজ শুধু চেয়ে থেকেছে । ওই অসহায় কাতর মুখখানা মায়ায় নয়—এক হিংস্র , তীব্র আক্রোশের আনন্দে—ভরিয়ে তুলেছে ওর বুক ! তারপর রাগে নয়—চিবিয়ে চিবিয়ে– ভেতরে জমে ওঠা গোপন পুলককে আত্মস্থ করতে করতে– দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দিয়েছে , “ তাহলেই বুঝে নে। ওরা তোকে কি চোখে দেখে? ওদের তুই বন্ধু বলতিস না? ওদের মত পোশাক পরতিস—ওদের সাথে ছাড়া আর কারুর সাথে কথা বলতে চাইতিস না—দেখলি ? ওরা তোকে কোনদিন–ই বন্ধু ভাবেনি। ওরা তোকে শুধু একটা মেয়ে ভাবে। বুঝলি …শুধু একটা মেয়ে। ’’

কলমে কাকলি ঘোষ, হাওড়া

SOURCEকলমে কাকলি ঘোষ
Previous articleসার্কাস
Next articleপ্রজাপতির বিয়ে
Avatar
Disclaimer: Monomousumi is not responsible for any wrong facts presented in the articles by the authors. The opinion, facts, grammatical issues or issues related sentence framing etc. are personal to the respective authors. We have not edited the article. All attempts were taken to prohibit copyright infringement, plagiarism and wrong information. We are strongly against copyright violation. In case of any copyright infringement issues, please write to us. লেখার মন্তব্য এবং ভাবনা, লেখকের নিজস্ব - কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত..................

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here