অচিনবাবু গুটি গুটি পায়ে তার প্রাণাধিক প্রিয় আম্বাসাডার গাড়িটির কাছে গিয়ে ভাবতে লাগলেন-কতোদিন গাড়িটিকে ড্রাইভ করেননি।
সরমা গত হয়েছে তিন বছর হলো।
তাপরই শহরের হইচই ছেড়ে চলে এসেছিলেন, একমাত্র চাকর দাসুকে সঙ্গে নিয়ে, এই মফস্বলে।সেদিন নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে গাড়ি-ঘরে তুলে রেখেছিলেন।যদিও নিয়ম করে ধোয়া-মোছা করেন, একটু-আধটু চেক্ করে নেন।একা থাকতে থাকতে সময়কে তিনি নিজের করে নিয়েছেন কখন যেন।আজ মনে হলো একটু লং-ড্রাইভে যাবেন।শহরের দিকেই যাওয়া ঠিক করলেন।
একটু আগে আগে খাওয়া সেরে ড্রাইভিং লাইসেন্স আর গাড়ির যাবতীয় কাগজপত্র ঠিক করে নিলেন।তেলের ট্যাঙ্কটা একটু পরীক্ষা করে নিলেন।না,একটু ট্যাঙ্কটা ভরে নিতে হবে।
গ্রামের রাস্তা ছেড়ে যখন তিনি হাইওয়েতে গাড়ি ছোটালেন তখন সকাল প্রায় সাড়ে দশটা।
স্টেয়ারিং-এ হাত দিলেই তার মনে পড়ে যায়, কতোদিন সরমাকে নিয়ে লং-ড্রাইভে গিয়েছেন।তারপর ছোটো ছেলের বিয়ের সময় এই গাড়িতেই ছেলে বউকে নিয়ে এসেছিলেন নিজের বাড়িতে।সুন্দর করে সাজিয়ে ছিলেন গাড়িটাকে।আরও মনে পড়ে সেনদার কথা-একদিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে গাড়ি আ্যকসিডেন্টে সম্পূর্ণ অথর্ব হয়ে পড়ে আছেন বাড়িতে।
জলের মতো সময় বয়ে গেছে।কতো সুখ-দুঃখের স্মৃতিতে ছেয়ে আছে তার প্রিয় এই গাড়িটি।
ঐতো সামনে বড়ো হাইওয়ের ব্রিজটা, এবার সীট-বেল্টটা বেধেঁ নিলেন অচিনবাবু।যথাসম্ভব সতর্ক হয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে নানা দুঃচিন্তা ভীড় করে আসছে মনে। গত কয়েকদিন যাবৎ তার এন্জিওগ্রাম করানোর কথাটা মনে পড়লেও কিছুতেই মনটাকে নিয়ে যেতে পারছেন না।কি জানি কি ধরা পড়বে!
সামনে রাস্তাটা ফাঁকা পেয়ে গাড়ির গতিটা একটু বাড়িয়ে দিলেন।হাতটা নিজের থেকেই বাজনার তাল ঠুকার মতো নাড়িয়ে যাচ্ছিলেন।আর একটু গতি বাড়িয়ে দেন গাড়িটার।
খেয়াল করেননি তার গাড়ির গতি কতোটা উঠে গেছে।আবেগ ত্বাড়িত হয়ে ড্রাইভ করে যাচ্ছেন অচিনবাবু।
হঠাৎ খেয়াল করলেন সামনেই ট্রাফিক পুলিশ তাকে ইশারা করছেন থামতে।সিগন্যাল ভাঙ্গেননিতো কোথাও;গাড়ির গতিটা কমিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন রাস্তার একপাশে।ট্রাফিক পুলিশ এগিয়ে আসেন তার দিকে।একটু ক্রুর দৃষ্টি দিয়ে তাকালেন।তারপর দৃঢ় গলায় বললেন,
–দাদু, লাইসেন্সটা দেখি।
অচিনবাবু তার ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখালেন।
–হু;ধোয়া পরীক্ষার কাগজটা?
–এই যে।
–হু;সবইতো ঠিক আছে।আচ্ছা, এবার পাঁচশো টাকা ছাড়ুন তো।
–কেন?
–বা:আপনার জন্য কতোটা সময় নষ্ট হলো,তার পারিশ্রমিক।
হঠাৎ অচিনবাবুর মাথাটা গরম হয়ে গেলো।
জীবনে কোনোদিন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি তিনি।আজ কিনা নিজে অন্যায় করেননি আর অপরের অন্যায় আবদারকে মেনে নেবেন আদর্শবান অচিনবাবু?প্রায়ই শোনা যায়, গাড়ি আটকে রাস্তায় পুলিশ পয়সা নিচ্ছে, কিন্তু কোনোদিন চাক্ষুষ করেননি।কতো ধিক্কার দিয়েছেন মনে মনে।রাগও হয়েছে প্রচণ্ড।তাই আজ কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না।আর বেশ রাগত স্বরেই বললেন-
–কেন,সরকার আপনাদের মাইনা দেননা এই কাজের জন্য?
শুনুন মশাই, আজ পর্যন্ত কোনোদিন অন্যায়ের সাথে আপোষ করিনি, আজও করবোনা।তাই বিনা কারণে আমি পাঁচশো কেন ,একটি টাকাও দেবোনা।
–দেবেন না।কিন্তু, আমি যে কেস্ দেবো।সিগন্যাল ভাঙার জন্য, গাড়ি আটকে দেবো,আপনাকে সত্যবাদিতার জন্য আইন-আদালত করতে হবে।
এবার আপনিই ঠিক করুন পাঁচশো না লিখবো?
–আমি,আমি–(হঠাৎ বুকের বাদিকটা চিন্চিন্ করে ব্যাথা করতে থাকে, বুকের বাঁদিকটা হাত দিয়ে চেপে ধরলেন)আ-আ–
মুহূর্তের উত্তেজনায় অসাড় হয়ে গেল দেহটা, মাথাটা নুইয়ে পড়লো।আর নিস্তেজ হয়ে গেল।অন্ধকার, সব অন্ধকার–সবশেষ।
ট্রাফিক পুলিশ, অচিনবাবুর খুব কাছে এসে পরীক্ষা করে দেখলেন।তারপর,
–কিরে,টস্কে গেলো নাকি দাদুটা?ড্রাইভিং লাইসেন্সটা নিয়ে পুড়িয়ে ফেলতো বটু, আর কেস্টাকে সহজ করতে এই কারণটাই যথেষ্ট।কি বলিস??
লেখক পরিচিতি : অরিন্দম বসাক, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ।
বিঃ দ্রঃ লেখাটি জানুয়ারি,২০২০, “মাসিক জনপ্রিয় লেখনী” প্রতিযোগিতার অন্তর্ভুক্ত।