প্রত্যুষবাবু আজ ভীষণ খুশি। ছেলে চাকরী পেয়েছে আজ এক মাস পরিপূর্ণ হল। রির্টায়ার্ড প্রত্যুষ মিত্রর চোখেও আজ জল। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ছেলেই ছিল একমাত্র অবলম্বন। ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্যই অবসরের আগেই অবসর নিয়ে নেন তিনি, তার কারন এককালীন একটা টাকা হাতে আসবে, আর তাছাড়া এই বাড়িটাও যে ব্যাঙ্কের কাছে মরগেজ রেখেছিলেন, আজও প্রত্যেকমাসে বাড়িটার মরগেজ রাখার জন্য পেনশনের টাকাটা প্রায় পুরোটাই কেটে নেয়। এতদিন অভাব অনটন ঘিরে ছিল তাদের বাপ-ব্যাটাকে, তবে আজ আর চিন্তা নেই, ছেলে যে একটা মোটা অঙ্কের মাইনের সরকারি চাকরি পেয়েছে। আর কোনো অভাব তাদের গ্রাস করবে না। তারা এবার দুবেলা ভরপেট খেয়ে বাঁচতে পারবে। এবার শুধু ছেলের বিয়েটাই দেওয়া বাকি। উনি আর কতদিন, জীবন নদের একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে তার আয়ু। আর কয়েকবছর পরেই সেই নদ মোহনায় মিশবে, না ফেরার দেশের হাতছানি এখন অনেক সময়ই উপলব্ধি করেন প্রত্যুষবাবু। এখন না হয় থাক সেসব কথা।
হঠাৎ করেই বাইরের লোহার গেটে আওয়াজ হল, আর প্রত্যুষবাবুও আনন্দের সাথে এগিয়ে গেলেন,
” কই রে বাবান এলি!!! ” তবে বাবান অর্থাৎ সাগর তখন ফোনে কথা বলতেই ব্যাস্ত। বাবার দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো বিরক্তির হাসি হেসে ভেতরে চলে গেল। বাবা ভাবলেন হয়ত ছেলে খুব ব্যাস্ত। এখন আবার ওইসব ফোনেই সব কাজ চলে, তাদের সময় কি আর এসব ছিল নাকি!! এখন তো আবার ল্যাপটপেই নাকি পড়াশোনাও চলে, কি জানি বাবা তাতে পড়াশোনা আদেও হয় নাকি। সে রান্নাঘরে চলে গেলেন, কারন বাবান যে এতটুকু ক্ষিদে সহ্য করতে পারে না। আজ আবার তিনি নিজে কই মাছ কিনে এনেছেন ছেলের জন্য বাজার থেকে। একে তো কইমাছের যা আকাশচুম্বী দাম, তাই অনেকদিন খাওয়া হয়না, তবে ছেলেটা যে কালোজিরা ফোরন দিয়ে তেলকই খেতে বড্ড ভালোবাসে, তাই আজ একটু জমানো টাকা দিয়ে কিনেই আনলেন, ছেলেটা খেলে খুশী হবে। যথারীতি খাবার গরম করে ছেলেকে ডাক দিলেন।
” বাবান আয় রে, তোর খাবার দিয়েছি, দেখ তোর পছন্দ মতো তেলকই, আর বেশী করে মটরশুঁটি দিয়ে বাঁধাকপির তরকারি করেছি। ” উজ্জ্বল মুখ নিয়ে প্রত্যুষবাবু বাবানের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু, ছেলে যে তার এখন মস্ত বড়ো মাপের মানুষ। তাই বাড়ির খাবারে যে তার স্বাদ বা রুচি আসার নয়। ” ওহ বাবা আমি তোমাকে বলতেই ভুলে গেছি, আমি আজ বাইরেই লাঞ্চ করে এসেছি। তুমি খেয়ে নাও, আর বাবা তোমাকে কাল আমি একটা যায়গায় নিয়ে যাবো, আসলে আমি একটি মেয়েকে ভালোবাসি, তাকে বিয়ে করতে চাই,, “
” বাহ্, এতো আনন্দের কথা রে, কি নাম রে আমার বৌমার। কেমন দেখতে আমার ঘরের লক্ষীকে!! আর শোন না, তোর তো ওই বড়ো ফোনে ছবি থাকবে, দেখা না রে বাপ, আমার ঘরের লক্ষীকে।”
” আরে করো কি! সাতাশ হাজার টাকা দামের ফোন, তোমার হাতে তো এঁটো লেগে আছে, তুমি ওই হাতে ফোনটা ধোরো না, আমি দেখাচ্ছি।” ছেলের কথায় অপ্রস্তুতিতে পড়ে বৃদ্ধ বাবা। আসলে এভাবে হামলে পড়া কি তার মানায়!!
” আর শোনো, আসল কথাটাই বলা হলোনা, দেখো, বাড়িটার যা অবস্থা রুমা এবাড়িতে এসে থাকতে পারবে না। তাই আমি ঠিক করেছি, বাড়িটা একটু মডুরেট করব। তাই তোমাকে আমি পনেরো দিনের জন্য একটা যায়গায় রেখে আসব, তারপর বাড়িটা ঠিকঠাক হয়ে গেলে, গিয়ে নিয়ে আসব। তোমার কিছু জামাকাপড় গুছিয়ে রেখো। আর যাও খেয়ে নাও। ” ছেলের কথা শুনে একেবারেই মুখের উজ্জ্বলতা হ্রাস পেয়েছে প্রত্যুষবাবুর। ছেলেটার জন্য এতো ভালোবাসা নিয়ে খাবার বানালো, আর সে খেল না, সেই খাবার কি আর ওনার গলা দিয়ে নামে! তাই সামান্য জল খেয়ে গিয়ে শুয়ে পড়েন, তারপর মনে পড়ে ছেলের জামাকাপড় গুছিয়ে রাখার কথা। আবারও উঠে কয়েকটা জামা আর পাজামা গুছিয়ে নেয়। সাথে বাবানের একটা ছবি। ছেলেটাকে যে বড্ড ভালোবাসেন উনি। তাকে একটা দিনও না দেখে থাকবে কিভাবে!!
চোখের কোনে জলের রেখা নিয়ে শুয়ে পড়েন তক্তপোষের ওপর।
সারাটা রাত দুটো চোখের পাতা এক করতে পারেননি উনি। মনকে বোঝালেও মন বাঁধ মানছে না। আচ্ছা আমার বাবান কি তাহলে এবার সত্যিই বড়ো হয়ে গেল? যে বাবান নিজের বাবাকে ছাড়া একটা দিনও কাটাতে পারত না, সে কিভাবে যে থাকবে এই পনেরো দিন। বড্ড কষ্ট হবে ছেলেটার আমার।
দশটা বাজতেই বাবান তার বাবাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন। সারা গাড়িতে বাবা তার ছেলেকে বুঝিয়েছেন, সে যেন ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করে, বেশী রাত জেগে যেন কাজ না করে, মাথাযন্ত্রনা হলে যেন মাথায় তেলজল দেয়। ঘরের কোন ড্রয়ারে কোন ওষুধ আছে, কোথায় কোন কাগজপত্র আছে সবই বলতে থাকে এক এক করে। আর ওনার বলা শেষ হওয়ার আগেই গাড়িটা এসে থামে একটা বিশাল আশ্রমের সামনে। গেটের ওপর বড়ো বড়ো করে লেখা
“” বৃদ্ধাশ্রম “”
“বাবান আমরা এখানে কেন রে!! এখানে তো….” কথাটা শেষ করতে পারে না। বুকের ভেতরে কেমন যেন চিনচিনে একটা ব্যাথা হতে শুরু করেছে। গলার স্বরও একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে।
” মাত্র তো পনেরোটা দিনের ব্যাপার বাবা। একটু ম্যানেজ করে নাও প্লিজ। পনেরো দিন পরেই তো তোমাকে নিয়ে যাবো এখান থেকে। ” ছেলের গলায় আকুতি স্পষ্ট। তাই নিজের কষ্টটাকে একেবারে হজম করে ফেলে তিনি, তারপর ছেলের সাথে ভেতরে ঢোকেন। এখানে ওনার মতো আরও কতো মানুষ রয়েছেন। সত্যিই এনাদের জন্য খারাপ লাগে প্রত্যুষবাবুর। সত্যিই এনাদের ছেলেমেয়েরা কতো স্বার্থপর।
ভেতরে যিনি হেড আছেন, তার সাথে কিছু কথা বলার পর, একজন মহিলা এসে প্রত্যুষবাবুকে নিয়ে যান, উনি আর কয়েক মুহূর্ত ছেলের সাথে থাকার আর্জি জানান, কিন্তু সেটা নামঞ্জুরই হয়। বাধ্য হয়ে, মহিলার সাথে ঘর থেকে হেঁটে বেড়িয়ে যান উনি। তারপর লম্বা করিডর দিয়ে গিয়ে একটা হলরুমে ঢোকেন। পাঁচটা বিছানা পাতা রয়েছে সেখানে, দুজন বসে রয়েছে । প্রত্যুষবাবুর দিকে তারা এগিয়ে আসেন, আন্তরিকভাবে কথা বলতে শুরু করেন। কথায় কথায় জানা যায় তারা একজন এখানে রয়েছে ছয়মাস, আর একজন রয়েছেন প্রায় দেড়বছরের কাছাকাছি। তবে প্রত্যুষবাবুর রাগটা হয় তখন, যখন ওনাকে এনারা বলেন, যে ” সবার ছেলেমেয়েরাই বলে পনেরো দিন কি একমাস পরেই নিয়ে যাবে এখান থেকে, কিন্তু আর নিয়ে যায় না। আপনি মশাই এত আশা করবেন না। আসলে আশা করার পর যখন সেটা ক্ষুন্ন হয়, তখন খুব কষ্ট হয়। “
” আরে থামুন মশাই আপনি, আমার বাবান এমন নয়। ও ঠিক নিয়ে যাবে আমায়। ও আমাকে কতো ভালোবাসে আপনি জানেন!! “
” ঠিক আছে দেখুন কি হয়। “
এরপর থেকে দুদিন পরপরই প্রতু্্যষবাবু তার বাবানকে ফোন করেছে, কিন্তু ছেলে যে তার ভীষণ ব্যাস্ত মানুষ কথা বলার সামান্যতম সময়ও নেই তার। হবে নাই বা কেন!! মস্ত অফিস….
আস্তে আস্তে পনেরো দিন পার করে একমাস হতে চলেছে, তবে বাবানের এখনও যে কাজ শেষ হয়নি। আগে যাও বা গলার আওয়াজ শুনতে পেত, এখন যে সেটাও শুনতে পায়না প্রত্যুষবাবু। কারন ছেলেকে ফোন করলেই নাম্বারটা নটরিচিবেল বলে।
ক’দিন ধরেই প্রত্যুষবাবুর বুকের ব্যাথাটা মারাত্মক বেড়ে গেছে। শ্বাসকষ্টটাও বেড়েছে। আসলে উনি যদি একটু বেশী চিন্তা করেন, তাহলেই এটা হয়। একবার ডাক্তার দেখিয়েছিলেন উনি। যেটা ভয় পাচ্ছিলেন সেটাই হয়েছে, ডাক্তার বলেছিলেন যদি উনি বেশী চিন্তা করেন, তাহলে ওনার হার্টঅ্যাটার্কের একটা সম্ভাবনা আছে। তাই উনি যেন বেশী চিন্তা না করেন।
তবে এখানে আশার পর থেকেই ছেলেটার জন্য বড্ড মন কাঁদে। আসলে এখন মনের একটা কোনায় একটু হলেও মনে বিশ্বাস জেগেছে, যে এখানের মানুষগুলি ওনাকে যা বলতেন, সেটাই হয়ত সত্যি। একদিন নীলরতনবাবু বলছিলেন, ” আমরা হলাম আপদের জাত গো এখন। আসলে আমাদের কর্তব্য ছিল শুধু তাদের মানুষ করা, উচ্চশিক্ষিত করা, করে দিয়েছি। এখন আমাদের কাজ শেষ। এখন আমরা বাড়তি। আমরা এখন ওদের কাছে আপদ গো, আস্ত একটা আপদ!! ” এরপর উনি উচ্চস্বরে হাঁসতে থাকেন। আর ওনার ওই হাসির মধ্যেই লুকিয়ে ছিল একরাশ আক্ষেপ। একসমুদ্র হতাশা, যা কেউ আর কখনোই কেউ পার করতে পারবে না
●●●●
ধীরে ধীরে নুইয়ে পড়তে থাকে প্রত্যুষবাবু। এবার বুঝি তার জীবননদের পরপার নামক মোহনায় বিলীন হওয়ার সময় এসেছে। বড্ড দেখতে ইচ্ছা করে ছেলেটাকে। একটা বার বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করে, কিন্তু পারেনা। জীবন বুঝি এখানেই শেষ। মনে মনে একটা কথাই বলেন এখন শুধু উনি।____
” ” “পরজন্ম বলে যদি কিছু হয় বাবা, তাহলে আমি যেন তোর ছেলে হয়ে আসতে পারি বাবান, যাতে আমার মতো শেষ বয়সে তোকে কষ্ট পেতে না হয়। নিজের ছেলেকে দেখার জন্য তোকেও আমার মতো রাস্তায় চোখ পেতে অপেক্ষা করতে না হয়। তোকে যেন বৃদ্ধাশ্রমে যেতে না হয়। ” ” ” মানুষটি তার মনের এই কথাগুলো একটা চিঠিতেও লিখে রেখে গিয়েছিলেন। যদি কখনও বাবান আসে, তাহলে সে যেন এই চিঠিটা পায়। কিন্তু, সত্যিই কখনও আসবে!!
●●●
আচ্ছা, আমরা কেন এত স্বার্থপর হয়ে যাই বলুন তো!! আমরা যখন ছোট থাকি, তখন তো আমাদের বাবা মায়েরা আমাদের আপদ ভাবে না। পরম স্নেহে, ভালোবাসায় আমাদের লালন পালন করে। কিন্তু, আমরা কি করি, তাদের যখন আমাদের সবথেকে বেশী প্রয়োজন হয়, সেইসময় তাদেরকে আমাদের বোঝা মনে হয়।
আমরাই পারি আমাদের বাবা মাকে ঈশ্বররূপে পূজো করতে, আমরাই পারি বৃদ্ধ বয়সে তাদের লাঠি হতে। আর আমরা যদি এই সংকল্পকে বাস্তবায়ন করি, তাহলে হয়ত আমাদের সমাজে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা অনেক কমে যাবে। অনেক….
কলমে শিল্পী চক্রবর্তী, ত্রিবেনী, হুগলী
লেখালেখির প্রতি আগ্রহ ক্লাস সিক্স থেকে। তবে কখনও ভাবিনি আমি আমার লেখার দ্বারা এগিয়ে যেতে পারব। তবে আমার শিক্ষকরা বলতেন, যেন লেখা না ছারি কখনও। ছারিনি, কারন এত সবকিছু, বন্ধুর মাঝেও যখন এমন কিছু কিছু মুহূর্ত আসে, যার বিবরন কাউকে দিতে পারিনা, সেইসময়গুলোতে আমার ডায়রীটা আমাকে বড্ড সাহায্য করে।
লেখাকে ভালোবাসি, তাই মাত্র কুড়ি বছর বয়সে যাদের লেখা পড়ে লেখার প্রতি গল্পের প্রতি ভালোবাসা জাগত, সেইসমস্ত সনামধন্য লেখকদের সঙ্গে নিজের একটি গল্প প্রকাশ করতে পারি। 2020 সালে যেটি আমার সবথেকে বড়ো একটি পাওয়া।
ভালো লাগলো বোন। কলম যেন না থামে। এগিয়ে যা।
অনেক ধন্যবাদ দাভাই🙂🙂 আশীর্বাদ করো।
অনেক ধন্যবাদ দাদাভাই। আশীর্বাদ করো, যেন এভাবেই এগিয়ে যেতে পারি।🙂🙂🙂
Superb. Amazing
অপূর্ব লেখা✏️