ডুবন্ত সূর্যের সোনালী আলো আর ঠান্ডা মৃদু হাওয়া, বুড়ি গঙ্গা নদীর জলের গায়ে সৃষ্টি করেছে অসংখ্য সোনালী আর রুপালি হিজিবিজি,  হ্যাঁ হিজিবিজি- কারণ জলের উপর সৃষ্ট রেখা গুলির কোনো নির্দিষ্ট আকৃতি নেই, প্রকৃতি দেবী তার আনমনা শিশু সুলভ ভঙ্গিতে জলের উপর রেখাপাত করে চলেছেন। ঠিক যেমন ভাগ্য দেবী কোন অজানা সুতোর বুননে বুনে চলেছেন, নবাব বেগম লুৎফুন্নেসার ভাগ্য। ভাগ্য, একে বলা যায় না – শুধুই দুর্ভাগ্য। মনে মনে মৃদু হাঁসলেন মির্জা মোহাম্মদ সিরাজ উদ দৌল্লার পেয়ারের বেগম লুৎফা। আজ সাতটা বছর কেটে গেলো এই জিঞ্জিরা প্রাসাদে। তার চোখের সামনে জানলায় সেই একই দৃশ্যপট। সেই বুড়ি গঙ্গা, সেই ডুবন্ত সূর্য। শুধু প্রকৃতির রং পাল্টে যায় আলাদা আলাদা সময়ের ব্যবধানে। সময়, এই সময়ই তো থেমে গেছে, সাত বছর আগে তার নবাবের মৃত্যুর সাথে সাথে।

এই সব সাতপাঁচ ভাবছিলেন বেগম লুৎফা। এই সময় কুদুসিয়া বলে ওঠে..

-“আম্মিজান সব সামান গুছিয়ে নেওয়া হয়েছে কি দেখে নাও। কাল সুভহ আমরা জলদি বেড়িয়ে যাবো।এখানে তো আর ফেরা হবে না।”

লুৎফা একটু হাসে, সামান, তার সব সামান তো ছিল তাদের হিরাঝিল মেহেলে। এখানে আর কি আছে? কিন্তু কুদুসিয়া, ওই ছোট্ট মেয়েটাকে তো আর তা বোঝানো যাবে না। জন্ম থেকে মেয়েটা কি পেয়েছে দুখ – দরদ ছাড়া, তার আব্বাজানের ভালোবাসা তো দূরে থাক, তার চেহেরাটুকুও দেখতে পায়নি কখনো। এমন কি নবাব আর শাহজাদী উম্মে জোহরাকে হারানোর পর তার নিজেরও মাথা খারাপ হয়ে গেছিলো। সেভাবে তাই নজরই দিতে পারে নি কুদুসিয়ার উপর।

কুদুসিয়া আবার বলে ওঠে 

-“আম্মিজান, কি ভাবছো দেখে নাও একবার।”

-“সাব ঠিক আছে বেটা।”

এরপর লুৎফা নিজের রোজকার কাজ শেষ করে কুদুসিয়াকে রাতের খানা খাইয়ে শুইয়ে দিল।

তারপর নিজে এসে বসলো আইনার সামনে। ছোট্ট একটা দিয়ার আলোয় তার মধ্যে যে আউরতের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠলো সেটাই কি নবাব মির্জা মোহাম্মদ সিরাজ উদ দৌলার প্যারের বেগম লুৎফুন্নেসা? এই সাত বছরে যেনো তার উমর কুড়ি বছর বেড়ে গিয়েছে। যে নজরের জাদুতে পাগল ছিলেন কতো তাবর বীর যোদ্ধা, সুপুরুষ যুবক এমন কি স্বয়ং নবাব, সেই নজরের জৌলুস আজ নিভে এসেছে। তার নজরের সামনেই ঘটেছিল কতো ঐতিহাসিক ঘটনা ,উল্টে গিয়েছিল বাংলার তক্ত – তাজ, কতো জল আর খুন বয়ে গিয়েছিল এই ভাগীরথীর বুক চিরে, একে একে যেনো সেই সব ঘটনা ভেসে ওঠে লুৎফার নজরের সামনে – 

তার বাবা ছিল মুকশুদাবাদের একজন ব্যবসায়ী, কতোই বা তখন বয়স হবে লুৎফার, ছয় কিংবা সাত। অব্যশ লুৎফা নয় তার বাবামশাই তাকে ডাকতো রাজকুমারী বলে। আরও একটা নাম বোধহয় ছিল তার, কিন্তু সেই নামটা তলিয়ে গেছে স্মৃতির অতলে। সেই সময়েই মারাঠা বর্গীরা লুঠ করলো তাদের সব কিছু। মা বাবামশাই, বাড়ির সবাইকে মেরে ফেললো। তাকে আর তার বাড়ির অন্য কম উমরের মেয়েদের বিক্রি করে দিল কাশিম বাজারে। বিভিন্ন হাত ঘুরে সে এসে পৌঁছালো নবাব আলীবর্দী খাঁর মেহেলে। সেখানে তার মতো আরো অনেক মেয়ে নিযুক্ত হলো নবাব বেগম সারিফুন্নেসার খিদমতে। উনি তাদের কয়েকজনকে পাঠিয়ে দিলেন খাস জারিয়া হিসাবে তার মেয়ে আমিনা বেগমের কাছে। লুৎফা আর অন্য কিছু জারিয়া সারাদিন আমিনা বেগমের খিদমাদ করে। আর আমিনা বেগমের আম্মিজান, বেগম সারিফুন্নেসা, তাদের সেলাই বনাই, খাস নওয়াবি খানা তৈরি, দস্তরখান সাজানো, নাওয়াবি তেহেসিব এই সবের পাঠ দিতেন। মাঝে মাঝেই মির্জা সিরাজ আসতেন তার দাদিজানের কাছে। সারিফুন্নেসা কোনো জারিয়াকে কাছে ঘেঁষতে দিতেন না, যতক্ষণ তার নওয়াসা তার মেহেলে থাকতেন। কিন্তু রাজকুমারীর সাথেই ঘটলো সেই ঘটনাটা। 

দাদিজানকে চমকে দিতে কোনোরকম ইত্তালা না করেই মির্জা সিরাজ হঠাৎ চলে আসেন দাদিজানের মেহেলে। সেই সময় রাজকুমারী দস্তরখান সাজাচ্ছিলো নবাব আলীবর্দীর জন্য। রাজকুমারীর বয়েস তখন ১২। কিন্তু ওই বয়েসেই মির্জাকে দেখে মাথা ঘুরে যায় রাজকুমারীর। অন্য জারিয়াদের রাজকুমারী প্রায়ই বলতো

 -“এই জারিয়ার জীবন কাটাতে আমি পৃথিবীতে আসেনি, আমার বাবামশাই আমাকে ডাকতেন রাজকুমারী বলে। আমি নিশ্চয়ই একদিন নওয়াবের বেগম হবো। দেখে নিও তোমরা” 

 অন্য জারিয়ারা তার কথা শুনে মুখ টিপে হাসতো। তখন খুব রাগ হতো রাজকুমারীর।এই সময়েই বিশাল জাসান শুরু হয় মির্জা সিরাজের নিকাহার। ‘বাহু বেগম’ হয়ে আসে উন্মদউন্নেসা। কিন্তু বছর ঘুরতেই দাদিজান লক্ষ্য করলেন তার পেয়ারের নাওয়াসার বাহু বেগমের দিকে মন নেই। এদিক ওদিক অনেক মেয়েদের সাথে নাম জড়াতে থাকে মির্জার। বাইরে এভাবে মুখ মেরে বেড়ানোর থেকে ছেলে ঘরে থাকা ভালো। তাই সারিফুন্নেসা ঠিক করলেন যে জারিয়াদের তিনি এতদিন শিখিয়ে পড়িয়ে মানুষ করেছেন তারাই এখন নিযুক্ত হবে মির্জা সিরাজের খিদমাদে। তখন রাজকুমারীর বয়স চৌদ্দো। তাদের সারি দিয়ে দাঁড় করানো হলো মেহেলের চত্বরে। তাদের বলা হলো তারা যেনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, মির্জা সিরাজ তাদের মধ্যে যাদের পছন্দ করবে তারাই হবে মির্জা সিরাজের বাঁদি।

কিন্তু মির্জা আসতে বেশ দেরী করায় তাদের বহুক্ষণ ওই অবস্থাতেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অবশেষে আসে সেই মুহূর্ত যখন মির্জা সিরাজ এসে হাজির হলেন তাদের সামনে। একে একে তিনি সবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে লাগলেন। তাদের বলা হয়েছিল

-“মির্জার সামনে যেনো সবার মাথা নীচু থাকে।”

কিন্ত হঠাৎ রাজকুমারী দাঁড়িয়ে পড়ে মাথা উঁচু করে। সবাই পাশ থেকে বলে ওঠে

 -“সার ঝুকাও।”

এইটুকু একটা জারিয়ার সাহস দেখে তো সবাই অবাক। নিশ্চয়ই এবার তার সার কালাম করার হুকুম হবে।

কিন্তু রাজকুমারী  কারো কথায় কান দেয় না। মির্জা তার সামনে আসতেই সে মাথা ঘুরে পড়ে যায় মির্জার কোলে। তীব্র গ্রীষ্মের দাবদাহে তার দুধে আলতা গায়ের রং আরো বেশী আরক্ত হয়ে উঠেছিল। বড়ো বড়ো দুটো বাদামী চোখে তখন শুধু মির্জা সিরাজের প্রতিচ্ছবি। তৃষ্ণা কাতর শুষ্ক গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁটে শুধু একটাই শব্দ “মির্জা”

মির্জা সিরাজেরও দুচোখ জুড়ে তখন শুধু রাজকুমারী। তখন এগিয়ে এলেন সেই জারিয়াদের দায়িত্বে থাকা দায়াউন্নেসা। মির্জা তাকে হুকুম দিলেন এই জারিয়ার যেনো বিশেষ খয়াল রাখা হয়। আর কিছু না বলেই সেদিন তিনি সেখান থেকে চলে যান। অজ্ঞান হওয়ার অভিনয় করে রাজকুমারী একটু বাঁকা হাসে। নবাব বেগম হওয়ার পথে এটিতো তার প্রথম পদক্ষেপ। তবে মির্জাকে সে মনে মনে সত্যি পসন্দ করে। এরপর একদিন হুকুম হয় মির্জা তাদের কয়েক জনকে ডেকেছেন তার খাস কামরায়। দায়াউন্নেসা তাদের বলেন 

-“ভালো করে তৈরি হয়ে নাও। মির্জা যদি মেহেরবানী করে কারোর উপর হরা রুমাল ফেলেন তাহলে তার কাছে সুযোগ থাকবে মির্জার খাস বাঁদী হওয়ার ।”

রাজকুমারী নৃত্য গীতে পারদর্শী ছিলেন। তার এই গুনে মির্জা আরো বেশী করে মোহিত হয়ে যান।আর তার উপরেই ফেলেন হরা রুমাল।

অবশেষে আসে সেই মুহূর্ত যখন এক হয় মির্জা সিরাজ আর রাজকুমারী।চোখে চোখ, ঠোঁটে ঠোঁট, এক হয়ে যায় দুটি শরীর। রাজকুমারী সামান্য জারিয়া থেকে হয় মির্জার খাস বাঁদী। যুদ্ধ বিগ্রহে পরেশন মির্জা, একটু প্রাণ জোড়ানো ঠান্ডা বাতাস খুঁজে পেতেন তার প্রিয় রাজকুমারীর কোলে শুয়ে।

একদিন সিরাজ বললেন

-“রাজকুমারী তুমি আমার প্রাণে নতুন আনন্দ এনে দিয়েছে। তোমার লুৎফ শুধু আমি উঠাতে পারি।তুমি শুধুই আমার। তুমি আমার লুৎফুন্নেসা।”

-“লুৎফুন্নেসা, এর মানে কি জনাব?”

-“মানে, মানে হলো সেই বেগম যে শুধুই আনন্দ দেয়।

আজ থেকে তোমার নাম লুৎফুন্নেসা।

আর এই হলো আমার তরফ থেকে তোমার জন্য নাজরানা।”

এই বলে সিরাজ তার একটি অতি মূল্যবান পান্না বসানো আংটি লুৎফাকে দেন। এটি ছিল লুৎফাকে দেওয়া সিরাজের প্রথম তৌফা। হাজার কষ্টের মধেও লুৎফা সেটা কোনোদিনও হাতছাড়া করে নি।

এরপর কতো জল গড়িয়েছে ভাগীরথী দিয়ে সিরাজ আর লুৎফা আরো কাছে এসেছেন।

একদিন কথায় কথায় দায়াউন্নেসার থেকে লুৎফা জানতে পারেন নবাব বেগম হতে পারে শুধু একজন খাঁটি মুসালমান।

লুৎফা সেদিনই সিরাজকে বলে

-“আমিও সেই ধর্মেই ইমান রাখতে চাই যে ধর্মে আমার মালিক ইমান রাখেন।”

-“তুমি মুসালমান হতে চাও?”

-“জী হুজুর।”

-“বেশ আমি নিজে তোমায় কুরআন শরীফ পাঠ করাবো।”

এই বলে লুৎফাকে পবিত্র পানি দিয়ে গোসল করিয়ে, পাক কাপড় পড়িয়ে সিরাজ নিজে কুরআন পাঠ করান। আর তার প্রতিটা আয়াত উনি বুঝিয়ে দেন তার প্যায়ারের লুৎফাকে।

এরপর লুৎফার গর্ভে আসে মির্জার প্রথম সন্তান। এই খবর আমিনা বেগম আর সারিফুন্নেসার কানে পৌঁছাতেই তারা মির্জার সাথে লুৎফার বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। একজন বাঁদী কী করে বেগম হতে পরে ভবিষ্যত নবাবের? এই ঘটনার প্রতিবাদ করে উন্মদ উন্নেসা আর তার দাদা বিরাজ খাঁ। কিন্তু সব বাধা কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত এক হয় সিরাজ আর লুৎফা। লুৎফাকে সিরাজ তার প্রাণের চেয়েও ভালোবাসতেন। কয়েক মাস পরেই লুৎফার কোল আলো করে আসে সিরাজের প্রথম সন্তান শাহজাদী উম্মে জোহরা। কতো জাসন হয়েছিল সেদিন গোটা মুকসুদাবাদ জুড়ে।

লুৎফা শুধু সিরাজের দিল বেহেলানোর বস্তুই ছিলো না, অনেক ব্যাপারেই সিরাজ পরামর্শ নিতেন লুৎফার। মির্জা সিরাজ অনেক সময়েই নিজের রাগকে সংযত করতে পারতেন না। এর মধ্যে আবার যোগ হয়েছিল মদের নেশা। এই রাগের বশে আর নেশার ঘোরে মাঝে মাঝে তিনি অনেক নিষ্ঠুর কাজ করে ফেলতেন। তবে সিরাজের এই সব কাজের খবর লুৎফার কানে পৌঁছালে সে যথা সম্ভব সেগুলো সংশোধন করার চেষ্টা করতো। সিরাজের সাথে যখন ইংরেজদের প্রথম যুদ্ধ শুরু হয়, সিরাজ তার নিজের মহলে সপরিবারে বন্দী করেন কাশিমবাজার কুঠির কুঠিয়াল ওয়াট সাহেবকে। ওয়াট সাহেবের দুটি ছোটো ছোটো দেব শিশুর মতো সন্তানকে দেখে আম্মিজান আমিনা বেগম কতবার সিরাজকে বলেছিলেন তাদের মুক্তি দিতে। কিন্তু সিরাজ কারো কথা শোনেন নি। কিন্তু লুৎফা এই খবর জানতে পেরে সিরাজকে অনুরোধ করেন তাদের মুক্তি দিতে। তখন সিরাজ তাদের মুক্তি দেন।

তবে সব থেকে বড় ঘটনাটি ঘটেছিল সিরাজের বেহেন শাহজাদী আফসিনকে নিয়ে। আফসিন ভালবাসত হিন্দু দেওয়ান মোহনলালকে। তাদের এই ভালোবাসার কথা যখন লুৎফার কানে পৌঁছায়, তখন তা তিনি জানান সিরাজকে। কিন্তু একজন বিধর্মীর সাথে নিজের বেহেনের শাদি, তা কি মেনে নেওয়া যায়! সিরাজ চেয়েছিলেন ওদের দুটিকে জ্যান্ত কবর দিতে। মোহনলালকে অনেক অপমানও করেছিলেন। কিন্তু লুৎফা তাকে বোঝায় ভালোবাসা ধর্মের শাসন মানে না। সে নিজেও তো ছিলো বিধর্মী, এমন কি হবু নবাবের বেগম হওয়ার মতো আউধাও তার ছিলো না, সামান্য একটা জারিয়া ছিলো সে। এই সব কিছু সত্বেও সিরাজ তাকে বুকে টেনে নিয়েছেন কারণ তিনি তাকে ভালোবাসতেন।একই ঘটনা ঘটেছে আফসিন আর মোহন লালের সাথেও। সিরাজ এরপর হাসি মুখেই এই সম্পর্ক মেনে নিয়েছিলেন। পরে এই মোহনলালই পলাশীর যুদ্ধে ছিলেন সিরাজের অন্যতম বন্ধু। কিন্তু হায় তাতেই বা লাভ হলো কই?

সিরাজের দাদাজানের মৃত্যুর পর তিনি নবাব হলেন। লুৎফা আর অন্য বেগমদের নিয়ে গেলেন মনসুরগঞ্জের হিরাঝিল মেহেলে। হিরাঝিল মেহেল সিরাজ নিজের তত্বাবধানে সাজিয়েছিলেন। কি তার জৌলুস। নবাবের সাথে এই হিরাঝিলে কাটানো মুহূর্তগুলোই ছিলো বেগম লুৎফার জীবনের সব চেয়ে সুনেহেরা দিন। ওই স্মৃতি নিয়েই লুৎফা তার সারা জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারেন।

লুৎফার পরেও সিরাজের জীবনে অন্য নারী এসেছিল। কিছুদিনের জন্য তার মনে দাগও কেটেছিল, দেওয়ান মোহনলালের বোন হীরা বাই।তাকে তিনি নিকাহও করেন। তার নিকাহার পর নাম হয় জেব উন্নেসা। ইংরেজদের সাথে নবাবের যুদ্ধের সময় যখন টালমাটাল অবস্থা জেব উন্নেসা নবাবের সঙ্গ পরিত্যাগ করেন। তাই লুৎফার জায়গা কেউই নিতে পারে নি। লুৎফার প্রতি সিরাজের ভালোবাসা ছিলো চিরকালীন। আর লুৎফারও তার প্রিয় নবাবের প্রতি ছিলো আমরণ আনুগত্য।

পলাশীর যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর যখন নবাব বলেছিলেন তাকে সব ছেড়ে কিছুদিনের জন্য লুকিয়ে থাকতে হবে, লুৎফা তখন গর্ভবতী। এতো দুঃখের মধ্যেও এই খবরে নবাবের খুশীর অন্ত ছিল না।নবাব চেয়েছিলেন এই অবস্থায় লুৎফা যেনো দাদিজানের কাছে চলে যায়। কিন্তু লুৎফা একা ছাড়তে চায়নি নবাবকে। তখন এমন অবস্থা, কি যে কখন ঘটে যাবে, কে বিশ্বাসযোগ্য কিছুই বলা যায় না।নবাবের সাথে থাকলেই সে আর তার বেটি মেহেফুজ থাকবে এটাই তার মনে হয়েছিল। তাই মেহেলের সুখ ছেড়ে কোন অজানা অতলে, অন্ধকার ভাগীরথীর জলে ভেসে যেতেও সে দুটিবার ভাবে নি।কিন্তু শেষ রক্ষা হলো কই।

লুৎফার চোখে ভেসে উঠলো সেই অভিশপ্ত দিনের স্মৃতি।

পলাশীর যুদ্ধে জিতে মীরজাফর রাজধানীতে পৌঁছে নবাবকে খুঁজে না পেয়ে চারদিকে লোক পাঠালেন। সেদিন কোনো বিপদের আশঙ্কায় প্রকৃতিও যেনো স্তব্ধ হয় গিয়েছিল। সারাদিন ধরে তার অশ্রুধারা, বৃষ্টি রূপে ঝরে পড়ছিল অঝোরে। চারিদিকে যেনো মৃত্যুরুপী কালো ছায়া নেমেছিল।এরমধ্যেই নবাব সিরাজদ্দৌলা হীরা ঝিল মেহেল থেকে ভাগীরথী দিয়ে ভেসে চললেন তার নৌকায়, সঙ্গে তার বেগম লুৎফা আর চার বছরের শাহজাদী উম্মে জোহরা। সারাদিন নৌকা বয়ে  মহানন্দা নদীর স্রোত অতিক্রম করে এলেও, তাতে জোয়ার ভাটার ফলে হঠাৎ করে জল কমে যায়। নাজিমপুরের মোহনায় এসে নৌকা চড়ায় আটকে যায়। এদিকে সারাদিন পেটে কোনো দানাপানি পরে নি। বেচারী জোহরা খিদের চোটে কেঁদে আকুল। নবাব লুৎফাকে বললেন 

-“তোমরা নৌকাতেই থাকো। জোয়ার না এলে তো নৌকাও চলবে না।আমি আশপাশ থেকে জোহরা আর তোমার জন্য একটু দুধ নিয়ে আসছি।”

-“নেহি নেহি জনাব আপনার যাওয়ার দরকার নেই।আমার মনটা খুব কু ডাকছে। না জানি কি হতে চলেছে।”

-“পাগালপান মত কারো লুৎফা। জোহরা বেটি কিছু খায়নি সারাদিন। তোমারও এই অবস্থায় না খেয়ে থাকা ঠিক নয়। আমি আসছি।”

এই বলে কোনো বাধা না শুনেই চলে গেলেন নবাব।

 তিনি নৌকা থেকে নেমে খাবার সংগ্রহের জন্য একটি মসজিদের নিকটবর্তী বাজারে আসেন। পরনে তার সাধারণ পোশাক আর গায়ে জড়ানো একটা আলোয়ান। কিন্তু পায়ে ছিল সোনার জরির কাজ করা মনি মুক্ত খচিত নাগরা। সেখানে এক ফকির নবাবের এই নাগরা দেখেই তাকে চিনে ফেলে। এই ফকির ইতঃপূর্বে নবাব কর্তৃক শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছিলো কোরআনের আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা করায়। সে তার এক কান হারিয়েছিল। সেই ফকির নবাবের খবর জানিয়ে দেয়। তখন মীরজাফরের সেনারা এসে সিরাজকে বন্দি করে। এদিকে আর একদল সেনা দেখতে পেয়ে যায় ঘাটে বাঁধা নৌকার মধ্যে লুৎফা আর উম্মে জোহরাকে। সেনারা তাদের সবাইকে বন্দী করে রাজধানী মুকসুদাবাদে পাঠিয়ে দেয়। এর পরের দিন মীরজাফরের হুকুমে তার পুত্র মিরনের তত্ত্বাবধানে নবাব আর উম্মে জোহরাকে লুৎফার চোখের সামনে শেষ করে দিলো ওই জল্লাদ মুহম্মদিবেগ। এই দৃশ্য দেখে বিধ্বস্ত লুৎফা জ্ঞান হারায়। সিরাজের মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ হাতির পিঠে চড়িয়ে সারা শহর ঘোরানো হলো। তারপর মুর্শিদাবাদের খোশবাগে নবাব আলিবর্দী খানের কবরের কাছে তাকে কবর দেওয়া হলো।

ওই ঘটনা লুৎফা কল্পনাতেও মনে করতে চায় না। সাত বছর পরেও ওই ঘটনা মনে পড়লে তার ধারকান বন্ধ হয়ে আসে। মীরজাফর চেয়েছিল লুৎফার সব কিছু শেষ করে নিজের করে পেতে। এর জন্যই নবাবের সাথে সাথে ছোট্ট উম্মে জোহরাকেও কাতাল করে। কুদুসিয়া তখন লুৎফার গর্ভে, তাই তখন রক্ষা পায়। নবাবের আখরি নিশানি, ওকে বাঁচাতে নবাবের দেওয়া সমস্ত গয়না, সম্পত্তি লুৎফা দিয়ে দেয় মীরজাফরকে। কিন্তু দুবারা শাদি করতে রাজি হয়নি। লুৎফা বলেছিল

-“যে একবার হাতির পিঠে চড়া নবাবের শয্যা সঙ্গিনী হয়েছে সে গাধার পিঠে চড়ে কি করে।”

মীরজাফরকে সবাই ইংরেজদের গাধা বলে। তার এই কথায় সেই ইঙ্গিতই বোঝাতে চেয়েছিল লুৎফা।

মীরজাফর ছাড়াও তার পুত্র মিরণ আরও কতো বড়ো বড়ো আউধার মানুষ লুৎফার কাছে এসেছিলেন প্রেম প্রস্তাব নিয়ে। মিরন, সেতো কি না করেছে লুৎফাকে ভয় দেখিয়ে শাদির জন্য হ্যাঁ বলাতে। অনেক অনুরোধ উপরধের পর, মিরন, লুৎফাকে একদিন এসে বললো  

-“কি ভেবেছো তুমি? বাকি জীবনটা কার ভরসায় কাটাবে? যদি ভেবে থাকো আমিনা বেগম আর ঘসেটি বেগম, ওই দুই বুড়িয়া তোমাকে বাঁচাবে তাহলে খুব ভুল করেছো। ওরা নিজেরাই আর কতদিন দুনিয়ায় থাকবে কে বলতে পারে? এই বলেই কুটিল অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে মিরন।

লুৎফার বুক কাঁপে, কি বলতে চাইছে মিরণ, ও কি আম্মিজান আর খালাজানের সাথে খারাপ কিছু করতে চলেছে।

নবাবের মৃত্যুর পর খালাজান ঘসেটি বেগমকেও জিঞ্জিরায় বন্দী করে মীরজাফর। তখন ঘসেটি বেগম নিজের ভুল বুঝতে পারেন। তার ছেলে এক্রমউদদৌলাও নিজের হক পায় নি। ঘসেটি বেগম তখন লুৎফার দু হাত ধরে বার বার মাফি চায়। আর বলে 

-“আমি নিজের পাপের কর্জ নিশ্চয়ই আদা করবো বেটি। আমি ঠিক আমাদের সবার মুকসুদাবাদে ফেরার ব্যবস্থা করবো। তুমিও তোমার হক পাবে।”

এরপর ঘসেটি বেগম ব্রিটিশ কোম্পানি বাহাদুরের কাছে চিঠি লেখেন। কিন্তু এই চিঠির খবর পৌঁছে যায় মিরণের কানে। এই খবর শুনেই সে সিদ্ধান্ত নেয় ঘসেটি বেগমের মুখ বন্ধ করতে হবে। আর আমিনা বেগম আর ঘসেটি বেগম না থাকলে লুৎফাও খুব ভেঙে পড়বে। তারপর নিশ্চয়ই লুৎফা তার হবে। তখন মিরন ষড়যন্ত্র করে ঘসেটি বেগমকে খুন করার। আমিনা বেগম আর ঘসেটি বেগম মুকসুদাবাদ যাচ্ছেন এই খবর লুৎফার কানে পৌঁছতেই সে বুঝতে পারে মিরণ নিশ্চয় কোনো গভীর ষড়যন্ত্র করছে। লুৎফা সাবধান করার জন্য খালাজানের কাছে যেতে চায়। কিন্তু এই সময়েই লুৎফার ঘরের সামনে বসানো হলো কড়া পাহারা। তাই লুৎফা খবর দিতে পারলো না। আর তার পরের দিন আমিনা বেগম আর ঘসেটি বেগমকে মিরান জানায় কোম্পানি বাহাদুর তাদের মুকসুদাবাদ ফেরার হুকুম দিয়েছে। তাদের বুড়ি গঙ্গায় নৌকা করে নিয়ে যাওয়ার সময় মিরন তাদের নদীর জলে ডুবিয়ে হত্যা করে। এই খবর লুৎফার কানে পৌঁছতেই তার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এরপর কি মিরন কুদুসিয়াকেও তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে – না, না প্রাণ থাকতে লুৎফা তা হতে দেবে না। কিন্তু এই সময়েই ঘসেটি বেগমের চিঠি ব্রিটিশ কোম্পানির কাছে পৌঁছায়। আর তারা এদিকে নজর দিয়ে, ঘসেটি বেগম আর আমিনা বেগমের মৃত্যুর খবর জানতে পারেন। তারা তখন মীরজাফরকে আদেশ দেন তিনি যেনো মিরনকে এই ধরনের কাজ করা থেকে নিরস্ত্র করেন। তাই সে যাত্রায় কুদুসিয়া বেঁচে যায়। এরপর মিরন আর কিছু না বললেও অন্য অনেক পুরুষ বিবাহের প্রস্তাব রেখেছিলেন লুৎফার কাছে। কিন্তু লুৎফা তাতে রাজি হয়নি। এই সাত বছরের বন্দী জীবনে লুৎফা অনেকবার ভেবেছে কেনো করলো সে এটা। ওই প্রস্তাবে রাজি হলে হয়তো তার সুখের জীবন হতে পারতো। কিন্তু সত্যি কি তাই – নাকি বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাববের প্রিয় বেগমকে থাকতে হতো কোনো নকারের বাঁদি হয়ে। শুধুমাত্র নিজের আউধা টিকিয়ে রাখতেই কি সে সেদিন সাথী হয়েছিল নবাবের। সাত বছর ধরে ভেবে সে উত্তর পেয়েছে – না, তার আর নবাবের মধ্যে শুধু একটাই বাঁধন ছিলো ভালোবাসা, ভালোবাসা আর ভালোবাসা। সেখানে জায়গা ছিলো না কোনো আমিরী, গরিবি, তক্ততাজ, মেহেলের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের।

এই সব ভাবতে ভাবতেই লুৎফা এসে শুলো কুদুসিয়ার পাশে। তার মাথায় আলতো করে হাত বোলালো। নবাব তো এখনও বেঁচে আছেন ওর মধ্যেই। কাল একটা নতুন সূর্য উঠবে।এই সূর্য দীর্ঘ  কয়েদখানার জীবন থেকে তাদের আজাদী দেবে। এই সাত বছর ধরে বহু চেষ্টা করে অবশেষে এসেছে এই মুক্তির দিন। লুৎফা ফিরে যেতে পারবে তার পেয়ারের নবাবের বুকে, ছুঁতে পারবে তাকে, ছুঁতে পারবে তার জিগার কা টুকরা উম্মে জোহরাকে। এই স্পর্শ টুকুই তার বাকি জীবনের পাথেয় হয়ে থাকবে। বাকি জীবনটা  কাটিয়ে দেবে তার নবাবের কবরের পাশে, যত দিন না বেগম লুৎফা নিজে কবরে যাচ্ছে। আর এই ভাবেই পূর্ণতা পাবে বেগম লুৎফুন্নেসার সামান্য বাঁদি থেকে বাংলা – বিহার -ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ দৌলার বেগম হয়ে ওঠার কাহিনী। যাকে ইতিহাস ‘তা উমর’ মনে রাখবে তার সহনশীলতার জন্য, বহু দুখ দরদ ,কষ্ট, অপমান সয়েও নবাবের প্রতি তার আনুগত্য আর প্রাণ ভরা ভালোবাসার জন্য।

কলমে মৌলী কুন্ডু, হাওড়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here