“না, না, না এ আমি কিছুতেই হতে দেব না। আমি ওনাদের কথা দিয়েছি এ মাসেই শুভদিন দেখে……”               

” এ মাসে নয়, আরো দুটো মাস অপেক্ষা করো। ওকে ফিরতে দাও।”                 

” ও আর ফিরবে না। এতোদিন হয়ে গেল কোনো খোঁজ খবর কিচ্ছু নেই। ওর জন‍্য আর দিন পিছোলে চলবে না।”                 

“এভাবে বোলো না বাবা। ওকে যে ফিরতেই হবে আমার জন‍্য। সেদিন দেখা করে যাওয়ার সময় ও গেয়েছিলো- আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো। আমি সেদিন ওর ঐ গানের মানে বুঝতে পারিনি। কিন্তু ওর গলায় গানটা শুনে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো ও হয়তো গানের মধ‍্যে দিয়ে আমাকে অনেক কিছু বলতে চাইছে। বোঝাতে চাইছে।”                 

“কিন্তু আমি কিছু বুঝতে বা শুনতে চাই না। যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাই হবে।” এই বলে রেগেমেতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন অনিমেষ।                

রজনী দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো।”কোথায় গেলি তুই? ফিরে আয় শিগগিরি।”     

হেমন্তের গভীর রাতে সারা শহর হিমের সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছিলো। শুধু হাসপাতাল চত্বরে জেগে ছিলো একই পাড়ার দুটি পরিবার। এক পরিবারে জন্ম নিয়েছিলো রজনী। ভোররাতে অপর পরিবারে জন্মেই মাকে হারিয়েছিলো হেমন্ত।               

রজনীর মায়ের দুধ খেয়েই হেমন্ত বড়ো হলেও ওদের দুজনের মধ‍্যে গড়ে উঠছিলো এক স্বর্গীয় প্রেমের সম্পর্ক। মাকে হারানোর একবছরের মধ‍্যেই বাবাকে হারিয়ে শিক্ষক দাদুর কাছেই হেমন্ত বড়ো হয়েছিলো। লেখাপড়ায়, স্বভাবচরিত্রে খুব ভালো ছেলে হলেও মেয়েলী স্বভাবের জন‍্য সবাই ওকে ঠাট্টা করতো, দাদুর কাছে এইজন‍্য খুব বকাও খেত।                    

রজনীর মাকে দেখে প্রায়ই নিজের মায়ের শাড়ী পড়ে, কপালে সিঁদুরটিপ, মাথায় গামছা দিয়ে বিনুনী পাকিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মধ‍্যেই নিজের মাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা চালাতো হেমন্ত। রজনীর থেকে একটা পুতুল নিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে বুকের আঁচল সরিয়ে মনে মনে পরম স্নেহে বুকের দুধ খাওয়াতো পুতুলটাকে।  প্রায়ই রজনীর নেইলপলিশ পড়তে গিয়ে ধরা পড়ে কিল খেত রজনীর কাছে। আবার রজনী অঙ্ক না পারলে মাথায় গাট্টা দিত হেমন্ত। স্কুল, কলেজের গন্ডী পেরিয়ে হেমন্ত হলো ব‍্যাঙ্ককর্মী, রজনী হলো বিবাহযোগ‍্যা।
                   বাবার জেদের কাছে হার মেনে রজনী বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ‍্য হলো, আর হেমন্তের ফিরে আসার অপেক্ষায় দিন গুনছিলো। মনে পড়তো হেমন্তের গলায় শোনা  শেষ গানটা-

“আবার হবে তো দেখা                         

এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো।”

দাদুর মৃত‍্যুর পর বেশ কিছু টাকা পেয়ে কোথায় যে গেল!
বিয়ের তিনমাসের মধ‍্যে দুর্ঘটনায় রজনী ওর চোখদুটো হারালো। অন্ধ গৃহবধূকে বাপের বাড়ি ফিরিয়ে দিল শ্বশুর বাড়ির লোকজন।

“এসেছি আমি এসেছি           

দূর থেকে বহুদূরে পথে পথে ঘুরে ঘুরে এসেছি                         

কী আনন্দ এই বসন্ত                

আজ তোমারই এই কুঞ্জেরও পারে……”

সুরেলা কন্ঠ শুনে রজনী চঞ্চল হয়ে উঠলো। হাতড়ে ঘরের বাইরে আসতে চাইলো,”হিমু! হিমু!”
রজনীদের উড়িয়া কাজের লোকটা বলে উঠলো,” হা জগড়নাথ! স-র-ব-নাসও হই গলা রে…..।”
“কেমন আছো কাকিমা?”
“হেমন্ত তুই !”
পিঠকাটা, লাল স্লিভলেস্ হাতার ব্লাউজের ওপর দিয়ে হলুদ জর্জেটের শাড়ির আঁচলটা টেনে নিয়ে,”হেমন্ত নইগো,হৈমন্তী,” এই বলে হাত দিয়ে মুখে উড়ে আসা চুলগুলো সরিয়ে চড়া পারফিউমের গন্ধ ছড়িয়ে হেমন্ত এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো রজনীকে। এগালে ওগালে চুমু খেতে লাগলো। যে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিলো আনন্দাশ্রু।
“আমি তোকে দেখতে চাই হিমু!”
“দূর পাগলী! এই দ‍্যাখলো, আমি তোর সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”
“আমি দেখতে পাই না। আমি দেখতে পাই না হিমু”! কান্নায় ভেঙে পড়লো রজনী!

সবশুনে হেমন্ত দৌড়ে বেরিয়ে গেল। দুদিন পর সবকিছু ব‍্যবস্হা করে রজনীকে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল সেইখানে, যেখানে X+X X+Y Y+Y এর সমীকরণটা উল্টেপাল্টে দিয়ে ‘হেমন্ত’ আজ ‘হৈমন্তী’।
হয়তো রজনী চোখের জ‍্যোতি ফিরে পেয়ে দেখতে পাবে ওর হিমুকে, হৈমন্তী রূপে। হৈমন্তীর আলতো ছোঁয়ায় অনুভব করবে হেমন্তর ভালোবাসার। হয়তো দুজনে মিলে সুখের স্বর্গ রচনা করবে।।

কলমে ববিতা সরকার(গুহ রায়), বেলঘড়িয়া, পশ্চিমবঙ্গ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here