“ক্রিজে নামতে বিলম্ব হলেও ময়দানে নেমেই ঝোড়ো ব্যাটিং শুরু করল শীত। উত্তুরে হাওয়ার জেরে রাজ্যে কমছে তাপমাত্রার পারদ। বড়দিন এবং নিউ ইয়ারের আগে তাপমাত্রা আরও নামতে পারে বলে ,জানাচ্ছে আলিপুর আবহাওয়া দফতর। শুক্রবারই ছিল মরশুমের শীতলতম দিন, কলকাতার ন্যূনতম তাপমাত্রা ১২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জাঁকিয়ে শীতের পরিস্থিতি মঙ্গলবার পর্যন্ত। তারপর ধীরে ধীরে বাড়বে তাপমাত্রা। ২৫ শে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৫ ডিগ্রির কাছাকাছি থাকবে কলকাতার তাপমাত্রা।জেলায় জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা দশের নীচে । এই মরশুমে প্রথম আজ কলকাতার তাপমাত্রার পারদ নামল ১৪ র নীচে। আলিপুর আবহাওয়া দফতর সূত্রে খবর, সকালের দিকে শহরের আকাশ থাকতে পারে কুয়াশাছন্ন। এর দরুন কমবে দৃশ্যমানতা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ পরিষ্কার হবে।” – ঘড়িতে তখন সাড়ে ন’টা। মাথায় টুপি, পায়ে মোজা, সোয়েটারের উপর একটা চাদর মুড়ি দিয়ে সোফায় বসে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে খবর শুনছিল বছর পঁয়ত্রিশের নীলেশ। কাপের কফি শেষ হতেই ঘরের ভিতর থেকে চেঁচিয়ে বলল–”আর এককাপ কফি কিংবা চা দাও না।”
নীলেশের কথা শেষ হতেই রান্নাঘর থেকে সুপ্রিয়া চিৎকার করে বলল–” আর চা-কফি কিছুই হবে না…সোফায় বসে বসে অর্ডার করতে মজা লাগছে।” কথা গুলো বলতে বলতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে শোবার ঘরের ভেজানো দরজা ঠিলে ঘরে ঢুকে সুপ্রিয়া, নীলেশের দিকে তাকিয়ে বলল,– ঘড়িতে কটা বাজল– অফিস নেই আজ?
–হ্যাঁ আছে।
–আছে! ও আমি ভাবলাম নেই।
–কেন, থাকবে না কেন? কেন মনে হলো যে আমার অফিস নেই শুনি।
–মনে হবে না কেন! যেভাবে খবর শুনছো,কফি খাচ্ছ, চায়ের অর্ডার করছ। তাই ভাবলাম হয়তো অফিস নেই। তা অফিস যখন আছে তখন ঘড়িটার দিকে একবার তাকাও। কটা বাজছে দেখ। সকালে বললে,দু’দিন স্নান করোনি আজ স্নান করবে। তা আজ স্নান করবে, না আজও–
–না ,না, আজ স্নান করব।
–ও করবে! তাহলে যাও। বাথরুমে গরম জল দিয়েছি দেখো গা। তাড়াতাড়ি যাও। ঠাণ্ডা হলে কিন্তু আর দিতে পারব না।
–আজ খুব ঠাণ্ডা। আর এক কাপ চা দাও না। সুপ্রিয়ার হাতটা কাছে টেনে নিয়ে সোহাগের সুরে বলল নীলেশ।
সুপ্রিয়া হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,–বললাম তো আর চা হবে না। আমি তো সকালে উঠে স্নান সেরে ভিজে মাথায় কাজ করে চলেছি। সকাল থেকেই জলের কাজ করছি। কই আমার তো এতো ঠাণ্ডা লাগছে না। তোমার মতো অতো গুলো টুপি সোয়েটার চাদরও পরে নেই। তুমি এতো গুলো পরে আছো তাও যে কী করে ঠাণ্ডা লাগে কে জানে? তোমার বয়স হয়ে গেছে বুঝলে।
–তা ঠিকই বলেছ। সত্যিই বয়স হয়ে গেছে আমার।আমি কি আর তোমার মতো ইয়াং আছি?
–জানি তো। বুড়ো হয়ে গেছ। আর বয়স শুধু তোমার না, তোমার ওই সোয়েটারটারও কম বয়স হলো না। তোমার সোয়েটারটা পুরোনো হওয়ায় পাতলা হয়ে গেছে। তাই ঠাণ্ডা ভাঙছে না। ছ’বছর বিয়ে হলো। বিয়ের পর থেকেই তোমার এই সোয়েটারটা দেখছি। এবার এটা ছাড়ো।
–ঠিকই বলেছ। সোয়েটারটা বিয়েরও তিন বছর আগে কেনা।
–মানে এটার বয়স ন’বছর হলো! এবার এটার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তুমি এটার মায়া ছাড়তে পারবে না। আমাকেই ব্যবস্থা করতে হবে।
অফিস থেকে ফিরে এসে সারা ঘর তন্নতন্ন করে সোয়েটারটা খুঁজে না পেয়ে সুপ্রিয়া কে জিজ্ঞাসা করতেই সুপ্রিয়া বলল– আমি ওটার ব্যবস্থা করে দিয়েছি।
–মানে?
–মানে– তুমি অফিস যাওয়ার পর পাড়ার মোড়ের ওই ভিখারি বুড়িটা এসে বলল,–মা এই ঠাণ্ডায় আমার স্বামী খুব কষ্ট পাচ্ছে। একটা পুরোনো চাদর বা বাবুর একটা পুরোনো সোয়েটার দাও না। –আমি তখন আমার পুরোনো একটা চাদর আর তোমার ওই সোয়েটারটা ওকে দিয়ে দিলাম।
–খুব ভালো করেছ। ওটার সাথে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে জানো? রাগে গজগজ করতে করতে কথা গুলো বলল নীলেশ।
রাত 11টা পর্যন্ত টিভি না দেখলে যে নীলেশের ঘুম আসে না, সে আজ রাত 9টায় শুয়ে পড়ল– না কিছু খেল, না সুপ্রিয়ার সঙ্গে কোনো কথা বলল। সুপ্রিয়া খাবার জন্য ডাকতে এলে গম্ভীরভাবে “খিদে নেই বলে” –লেপটা মুখ পর্যন্ত ঢাকা নিয়ে নিল।
আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস মতো পরদিন ঠাণ্ডাটা আরও জাঁকিয়ে পড়ে। অফিস থেকে ফেরার পথে “বাবু ও বাবু” ডাক শুনে নীলেশ থমকে দাঁড়ায়। দেখে সেই বুড়ি চোখে জল নিয়ে নীলেশকে নমস্কার করে বলল, –বাবু, কাল মা, একটা চাদর আর তোমার একটা সোয়েটার দিয়েছিল বলে এই ঠাণ্ডার হাত থেকে আমরা বুড়ো-বুড়ি বেঁচেছি। অনেকে চেয়েছিলাম বাবু,কেউ দেয়নি। মা লক্ষ্মীর মন অনেক বড়ো–ও দিল। বুড়ো বলছিল সোয়েটারটা খুব গরম। সোয়েটার পরে কাল রাতে ও ভালো ঘুমিয়েছে। ভগবান তোমাদের মঙ্গল করুক। তোমারা বেঁচে থাক। বুড়ির কথাটা শুনে নীলেশের মাথাটা ঠাণ্ডা হল। চোখটা জলে ভরে এল।
কলমে-বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
Write and Win: Participate in Creative writing Contest & International Essay Contest and win fabulous prizes.