কাগজে কলমে বিশ্বাস

3
918

বিশ্বাস, পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী সরঞ্জাম। যে কোনও ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে কিছু সময়েই গড়ে বা ভেঙে ফেলতে পারেন, এই ‘বিশ্বাস’ নামক অস্ত্র দিয়ে, পরাস্ত করতে পারেন তার মন ও মস্তিস্ক বা জিতে নিতে পারেন আস্থার সীমাহীন আকাশ। মানুষ মানুষকে বারবার বিশ্বাস করবে, কেউ দেখাবে প্রত্যয়জনক ব্যবহার, দেবে প্রতিশ্রুতি, কেউ আবার মিষ্টি ভাবে বুকে বসাবে বরফের তীক্ষ্ণ ছুরি।
জীবন চলবে। তবে, এটিও সত্য যে কিছু লোক আপনাকে প্রতারণা করবেই। আপনি যত ভালই না হন, আপনি অনেকবার প্রতারিত হবেন।

তা কি এই ‘বিশ্বাস’?

মনোবিদ্যাগত অর্থে বলতে গেলে বিশ্বাস এমন একটি সম্ভাবনা, যা বলে দেবে কোনও ব্যক্তি নির্দিষ্ট কি উপায়ে আচরণ করবে।বিশ্বাস হলো একটি প্রস্তাবের প্রতি একটি বিমূর্ত নির্ভরযোগ্য মানসিক মনোভাব।বিশ্বাস একটি আত্মবিশ্বাস এবং সুরক্ষার অনুভূতি।
আর বৈজ্ঞানিক অর্থে  বিশ্বাস হ’ল একটি জটিল নিউরাল প্রক্রিয়া যা বিভিন্ন উপস্থাপনা/প্রস্তাব/মনোভাব কে সংমিশ্রিত পয়েন্টারে আবদ্ধ করে আর যার মধ্যে আবেগ এর শতকরা মাত্রা সর্বাধিক।
দর্শন অনুযায়ী, বিশ্বাস সংবেদনশীল এবং যৌক্তিক কাজ। আবেগগতভাবে, এটিই সেটি, যেখানে আপনি লোকদের কাছে আপনার দুর্বলতা প্রকাশ করেন তবে বিশ্বাস করেন যে তারা আপনার উন্মুক্ততার সুযোগ নেবে না। যৌক্তিকভাবে, আপনি লাভ ও ক্ষতির সম্ভাবনাগুলিকে মূল্যায়ন করেছেন, কঠোর পারফরম্যান্স ডেটার ভিত্তিতে প্রত্যাশিত ইউটিলিটি গণনা করেছেন এবং সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে প্রশ্নে বা লক্ষ্যে থাকা ব্যক্তি অনুমানযোগ্য আচরণ করবে। অনুশীলনে, বিশ্বাস এই দুটোই। আমি আপনাকে বিশ্বাস করি কারণ আমি আপনার বিশ্বস্ততার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, কারণ মানুষের প্রকৃতিতে বিশ্বাস রয়েছে।

তবে কাগজে কলমে না গিয়ে যদি জীবন দিয়ে এর সংজ্ঞা এঁকে দেওয়া যায় , তবে
বিশ্বাস জীবনের মতোই গতিশীল, কারণ জীবন- অসংখ্য ঘটনার যৌগিক সুদ , শুধু মাত্র শব্দ এর মতো বিচ্ছিন্ন, সাধারণ সুদের হার নয়। কিছু অর্থহীন শব্দ বিশ্বাস ভেঙে দিলেও মানুষ আবার বিশ্বাস করে ফেলে তার অজান্তেই।
বিশ্বাস করা শক্ত। কাকে বিশ্বাস করতে হবে তা জানা আরও শক্ত। বিশ্বাস সত্যের সাথে শুরু হয় এবং সত্যের সাথে শেষ হয়ে যায়। বিশ্বাস কতগুলো জীবনকে জুড়ে রাখার আঠার মতো।এটি এমন একটি মূল নীতি যা সমস্ত সম্পর্ককে ধারণ করে।

প্রশ্ন হলো , বিশ্বাস নামক উপাদান ছাড়া মানুষ কি বাঁচতে পারে! এটি কি মানুষের সমস্ত সম্পর্ককে ধারণ করার একমাত্র মূল্যবান আর মৌলিক বুনিয়াদ!!! অবশ্যই।
মানুষের আদিম স্বত্বায় রয়েছে বিশ্বাস, বার বার বিশ্বাসঘাতকতার আগুনে পুড়েও মানুষ বিশ্বাস করে …

কেন বিশ্বাস করে ?

  • মানুষ সব সময় ভবিষ্যতের কথা বর্তমানে ভাবে, মনে মনে প্রস্তুত হয় ভবিষ্যতে কি ভাবে এগোবে। এই মানসিকতা যেমন মানুষকে আগামীকে জয় করার ক্ষমতা দেয় তেমন নিজেকে করে তোলে দৃঢ়, শক্তিশালী। আর এখানেই সূত্রপাত বিশ্বাসের। বিশ্বাস না করলে মানুষ স্বপ্ন দেখবে কি করে , আর এই বিশ্বাসে ভর করে মানুষ ভেবে নেয় অন্যেরা কে কি ভাবছে, পৃথিবী ঠিক কি হতে চলেছে আগামীতে।বিশ্বাস মানেই স্বপ্ন
  • মানুষের জীবন দাঁড়িয়ে আছে বিনিময়ের দাঁড়িপাল্লায়। তুমি দাও আমি দেব। যে জিনিস কেনা যায় , যে জিনিসের মূল্য নির্ধারণ করা যায়, সে জিনিস বিনিময় অনেক সহজ। কারণ কিছু টাকার মূল্যে যেমন আমরা কিছু কিনতে পারি , তেমনি আমাদের দেশ বিদেশে সব ব্যবসা দাঁড়িয়েই আছে এই বিনিময়ে , সমস্ত দেশের অর্থনীতি বিনিময় সাপেক্ষ। দান -প্রতিদানের এই নীতিটিই সমাজকে একত্রিত করে রেখেছে। কিন্তু সব কিছুর কি বিনিময় মূল্য হয়! যেমন বাবা মা তার শিশুটিকে বড় করছে, তাদের কি কিছু প্রতিদানের দরকার! না !! সে ভাবে কোনো মূল্যে সে প্রতিদান সম্ভব নয়। সেই প্রতিদানের নামই বিশ্বাস।
    তাই মানুষ বিশ্বাস করে। তাই বিশ্বাস হলো সেই মান বিনিময় ,যেখানে মানুষ জানেনা সে যা পাচ্ছে বা পেতে চলেছে , তা আদৌ সে চেয়েছিলো নাকি ?
  • বিশ্বাস করতে বর্তমানে সে অনেক সময় বাধ্যও হয়। ভবিষ্যতে, অনির্দিষ্ট সময়সীমার পর সম্ভবত কিছু পাওয়ার প্রত্যাশায়।কিন্তু সব সময় তাও সঠিক নয়। মানুষ যে সব সময় কিছু পাওয়ার আশায় বিশ্বাস করে তাও ঠিক নয়। আর এর সূত্রেই মানুষ অন্যকে নিজের দুর্বলতার সুযোগ নিতে সক্ষম করে , যদিও তারা আশা করে যে অপর ব্যক্তি এটি করবেন না।

এবার ভাবা যেতে পারে আমরা কি সবাই শুধু বিশ্বাসই করে যাবো !না , তা একেবারেই নয়। অনেকে জন্মগত বা জীনগতভাবে অবিশ্বাস এর ভ্রুন নিয়ে পৃথিবীর আলো দেখেন। তাদের যুক্তিতে যদি ভেবে দেখেন তবে কেন বিশ্বাস করবেন না, তাও বেশ কৌতূহলোদ্দীপক।

কেন বিশ্বাস করবেন না ?

বিশ্বাস না করার খুব সহজ দুটি উপায়, ঠিক সংখ্যায়ন পদ্ধতির শুন্য আর একের মতো। এক হলো ‘আপনি তাকে চেনেন যে সে ঠিক কেমন মানুষ , তাই বিশ্বাস করবেন না’ আর শুন্যতে ‘আপনি তাকে আদৌ চেনেন না’। বলা হয়ে থাকে আপনি যদি এমন কোনও ব্যক্তির প্রতি আস্থা রাখেন যিনি সেই আস্থার একেবারেই যোগ্য নন, তাহলে আপনি আসলে তাকে নিজেকে ধ্বংস করার শক্তি দিয়ে দেন। কাউকে আপনার দুর্বলতা জানতে দেওয়া, মানেই তাদেরকে সেই আস্থা দিয়ে দেওয়া। কথা কেন কর্মেও বিশ্বাস সেই অর্থে ভয়ংকরী, কারণ লোকেরা এত ভাল মিথ্যা বলতে পারেন যে আপনি কখনই জানতে পারবেন না, আসল আর নকলতা ঠিক কি ছিল। ঠিক যেমন লেখাটা পড়তে পড়তে আপনি ভাবতে পারেন লেখাটিতে লেখক ঠিক কোন পক্ষে, বিশ্বাস না অবিশ্বাসের !!!চোখ বন্ধ বা চোখ খুলেও বিশ্বাস করা যায় না , কারণ চোখ খুলে অনেক সময় নুনকেও চিনি মনে হয়। তাই বিশ্বাস করে ঠকে যাওয়ার থেকে এই শ্রেণীর মানুষ মনে করেন বিশ্বাস না করে নিরাপদ থাকায় অনেকটা শ্রেয়।

কাগজে কলমে বিশ্বাসকে সংজ্ঞায়িত করা সোজা হলেও বিশ্বাসের ঠিক কোন পক্ষে থাকাটা যুক্তিগত ভাবে ঠিক তা জানা বেশ কঠিন। ঠিক এই এই আলোচনার সিদ্ধান্তের মতোই। তবে এটুকু বলা যায় বিশ্বাসে অনেক লাভ, অবিশ্বাসে ক্ষতি ছাড়া আর কিছু নেই। বিশ্বাসের পরিবর্তে বিশ্বাসে, মানুষ নিজের পৃথিবী দিয়ে দিতে পারে, আর অবিশ্বাসে সে তোমাকে তোমার জীবনের শেষ সীমানায় টেনে এনে ঠেলে ফেলে দিতে পারে অন্ধকারে। আমাদের বিশ্বাস রয়েছে সাহচর্য, বন্ধুত্ব, প্রেম, চুক্তি, সান্ত্বনাতে । অবিশ্বাসে রয়েছে চাটুকটা, ঘেন্না, মনখারাপের কাহিনীরা, কিছু মুছে যাওয়া মুখ।

আমাদের বিশ্বাস অবিশ্বাসে। আমরা বিশ্বাসে বেঁচে থাকি আর বিশ্বাসেই মরে যায়।

 

 

Mousumi Kundu

আলোচনায় মৌসুমী কুন্ডু

3 COMMENTS

  1. অসাধারণ হয়েছে
    লেখাটা ,সত্যিই বিশ্বাস করে ই মানুষ আজ ও ঠকে ,আবার বিশ্বাস করেই গড়ে ওঠে ।খুব ই যুক্তিপূর্ণ ,সাবলীল লেখা ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here