বিসর্জন

1
930

সারা রাত দু ‘ চোখের পাতা এক করতে পারেন নি প্রতিমাদেবী । তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নি , তার নিজের ছেলে বাবলু এ ভাবে তার সঙ্গে কথা বলতে পারে।কান্নায় চোখের পাতা ভারী হয়ে যায় , রুদ্ধ হয়ে আসে কণ্ঠ ।
অনেক দিন থেকে বৌমার ব্যবহারে আসন্ন একটা ঝড়ের ইঙ্গিত স্পষ্ট ছিল । প্রতিমাদেবী বিষয়টি নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করেন নি । কারন ছেলের প্রতি
তার বিশ্বাসের আগলটা তখন আলগা হয়ে যায় নি । কিন্তু বিচিত্র এই সমাজের বর্ণচোরা মানব মনের খবর বৃদ্ধার অজ্ঞাত ছিল ।
জানলো গতকাল । ডিনারের টেবিলে বসে , যখন তার অধ্যাপক ছেলে বললঃ- ” মা  আমদের সঙ্গে তোমাকে আর রাখা যাবে না , তোমার সঙ্গে থেকে থেকে আমার ছেলেটা বিগড়ে যাচ্ছে । তাই ঠিক করেছি ,তোমাকে ভালো একটা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবো এবং পুরানো এই বাড়িটা বেচে দিয়ে
আধুনিক ঝকঝকে একটা ফ্ল্যাট কিনবো । তোমার বউমারও তাই ইচ্ছে “।

কথা গুলো প্রতিমাদেবীর হৃদয়ে আঘাত করলো ।তিনি ধাতস্থ হতে সময় নিলেন কিছুটা , তারপর শান্ত কিন্তু তীক্ষ্ণ গলায় বললেন , -“আমি তোর ছেলেকে বিগড়ে দিচ্ছি ? ভুলে যাস না আমি এক সময় শিক্ষিকা ছিলাম, তোর বাবার মৃত্যুর পর তোকে একা হাতে মানুষ করেছি । তুই বিগড়ে যাস নি ।
শোন বাবলু , আমি মৃত্যুর আগে এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবো না । এ বাড়ীর আনাচে কানাচে তোর বাবার স্মৃতি ছড়িয়ে রয়েছে , ছড়িয়ে আছে কত ভালো লাগা “।
বাবলু -“মা ,প্লিজ এই সামান্য বিষয় নিয়ে বস্তা পচাসেন্টিমেন্ট গুলো প্রকাশ না করলে কি নয় ? আমি ইতিমধ্যে প্রোমোটারের কাছ থেকে একগাদা টাকা নিয়ে বসে আছি , এখন ‘না’ বললে তারা সহজে ছাড়বে না । তাছাড়া বৃদ্ধাশ্রমের সকল কাগজ পত্র রেডি করে এসেছি , এখন তুমি রাজী না হলে তাদের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করা হবে । ”
প্রতিমাদেবী এবারও তীব্র প্রতিবাদ করলেন , -“তুই এ সমস্ত করার আগে আমার সঙ্গে একবার আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করলি না ? তোরা আলাদা ভাবে থাকতে চাস থাক , কিন্তু এ বাড়ি আমি কিছুতেই বিক্রি করতে দেবো না। ”

এবার বাবলু হাতে পায় ধরে কান্না শুরু করলেন, -“লক্ষী মা আমার , আমি ভীষণ বিপদে পড়বো ,প্রোমোটারের লোকজন আমার হাত -পা ভেঙে দেবে । প্লিজ মা, প্লিজ ..”
বৌমার তীক্ষ্ণ তীরের ফলার মতো আঘাত হানা বাক্যবান হঠাৎ পাল্টে সুমিষ্ট বীণার ঝংকারে পরিণত হলো -“মা আপনি একবার গিয়ে দেখুন ,আশ্রমটার এত সুন্দর পরিবেশ , ঘরের কথা ভুলে যাবেন । আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি। ”
এত কষ্টের মধ্যে প্রতিমাদেবী হেসে ফেললেন । হায়রে! এ যুগের নারী, যে মহিলা তোকে মায়ের মতো ভালোবাসেন ,তাকে না তাড়ালে যেন শান্তি নেই । অবশেষে প্রতিমাদেবী বৃদ্ধাশ্রমে যেতে সম্মত হলেন । খুশিতে পুত্র ও পুত্রবধূর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো । বিজয়া দশমীর পরের দিন বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার দিন ঠিক হলো ।
বাবলু সেন ও তার স্ত্রী বুল্টি সেন পাড়ার দূর্গা পূজার মধ্যমণি, দু ‘ জনে যুগ্মভাবে এবার সভাপতির দায়িত্ব সামলাচ্ছেন । তাদের এবছরের থিম ‘ মা ‘ ।
মন্ডপের গায়ে সুচারু ভাবে রঙীন আলোক চিত্র লেপনের মাধ্যমে সন্তানের জীবনে মায়ের অবদান ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ।
এবারের সেরা ‘ শারদ সম্মান ‘ সেন দম্পতির পূজাকমিটি । মন্ডপে নেমেছে জন জোয়ার । স্বামী -স্ত্রী দু ‘ জনে ভীষণ ব্যস্ত, সঙ্গে আছে সাংবাদিকদের দল ও ক্যামেরার ঝলকানি ।
দশমীর সকাল থেকে শুরু বিসর্জনের প্রস্তুতি । আকাশে বাতাসে বিষন্নতার সুর বিদীর্ণ করছিলো পৃথিবীর বক্ষ । কাশের দলের ঘাসের উপর মুখ গুঁজে পড়া, শিউলীর মাটিতে লুটোপুটি খাওয়া সেই বিষাদকে আরো স্পষ্ট করে তুলছিল ।
প্রতিমাদেবীর ঘরের দরজা সকাল থেকে বন্ধ ছিল । ব্যস্ততার মধ্যে কেউই খেয়াল করে নি ।
বিসর্জন শেষে বাড়ি ফিরে সমস্ত ঘর অন্ধকার দেখে মায়ের দরজায় কড়া নাড়লেন বাবলু সেন । কিন্তু ভিতর থেকে কোন রূপ সাড়া না পেয়ে , দরজা ভেঙে ফেললেন ।
সকলের অগোচরে প্রতিমাদেবী রওনা হয়েগেছেন চিরন্তন আশ্রয়ে, যেখানে সকল মানুষকে একদিন যেতেই হবে। ঝাপসা চোখে সিলিং -এর দিকে চেয়ে রইলেন বাবলু সেন। পাশের মন্ডপ থেকে ভেসে আসছে বিসর্জনের করুন সুর।

 

লেখক পরিচিতি :অনুপ হালদার, কুলতলী ,দক্ষিণ ২৪পরগনা

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here