শামুক

0
1270
গত কয়েকদিন ধরেই মনটা খারাপ, অনেকটা ভাদ্রের মেঘের মতো গুমোট ধরে আছে। সামনে কফিনের মতো সারি সারি বেড সাদা চাদরে ঢাকা; হাসপাতালের বেড প্রায় সবগুলোই খালি, করোনার ভয়ে আগের রোগী যারা ছিল তারা পালিয়েছে, যারা অসুস্থ লক ডাউনের ঝামেলায় পৌঁছাতে পারছে না! পতাকার মতো ভাঙ্গা কাঁচের জানালায় উড়ছে সাদা পর্দা, মানুষের হয়ে করোনার সাথে সন্ধি চাইছে হয়তো। দরোজার ওপাশ থেকে উঁকি দিচ্ছেন সিস্টার রীনা, রীনা গোমেজ! সকালে এসেই মেজাজ গরম করে দিয়েছিল একবার, একরকম বের করে দিয়েছিলাম ঘর থেকে, তবুও এখনো উঁকি দিচ্ছে! এখানে আমার জয়েন করার দুই বছর ছুঁই ছুঁই, এই মহিলাকে কখনো টানা এক মাসও কাজ করতে দেখিনি! কিছু মানুষ আজন্ম অসুস্থতার ভাগ্য নিয়ে জন্মে, উনার ইনফ্লামেটরী বাওয়েল ডিজিস, পরিপাকতন্ত্র ছোট ছোট আলসারে ক্ষত বিক্ষত হয় মাঝেমাঝেই! খুব কষ্টের অসুখ! ছুটি প্রাপ্য অপ্রাপ্য যা ছিল সব শেষ করেছেন, এখন আবার এসেছেন! এই করোনার দিনে আমি নিয়মের বাইরে গিয়ে কিই বা করতে পারি! তার সহকর্মীরাও মানছেনা! এক কথা, দুই কথায় প্রায় তর্ক লাগাতে ঘর থেকে বের করেই দিয়েছি। অভদ্রতার একটা সীমা থাকা দরকার, ওর নামেই অভিযোগ পত্র লিখছি পরিচালকের কাছে, একটা হেস্তনেস্ত দরকার।
নিওনেটাল ওয়ার্ডে রাখা বাচ্চাটা বিকট চীৎকারে কাঁদছে। গত একমাস ধরে এই হলো আরেক জ্বালা! গভীর রাতে ভর্তি হওয়া এক মহিলা, বাচ্চা জন্মের দিন সেই ভোরেই পালিয়েছে। সরকারী হাসপাতালের এন্ট্রি খাতায় লেখা নাম ঠিকানায় খোঁজ লাগিয়ে কিছু পাওয়া যায়নি। কয়েকদিন টিভির চ্যানেল আর পত্রিকায় খুব হইচই হলো, পর পর কয়েকদিন সাংবাদিকরা এসে শাসিয়ে গেলো, বাচ্চার কিছু হলে মিডিয়ায় ঝড় উঠবে! কিন্তু, একসময় সবাই ভুলে গেলো, পুলিশ ও রাস্তাঘাট লকডাউন সামলে কূল পাচ্ছেনা, কিই বা করার! সমাজ কল্যাণ অফিসারের সাথে সুসম্পর্কের সুবাদে, উনি দত্তক পরিবার খোঁজার ব্যবস্থা করেছেন। আজ আসবেন মিস্টার ও মিসেস বসুনিয়া, দেখা যাক বেচারার কোন গতি হয় কিনা! বাচ্চাটার প্রতি সবার মায়া পরে গিয়েছে, সেটাই প্রকৃতির নিয়ম, বুড়ি আয়া রাশেদা আপা, যে কিনা কোমর ব্যাথায় হাঁটতেও পারেন না, এসে বলছেন- ‘আপা বাচ্চাটা আমারে দেন, এতোদিন কোলে নিলাম, খাওয়াইলাম, আমিই দত্তক নিমু!’ স্নেহ আসলে ঘন কুয়াশার মতো বাস্তবতাকে ঢেকে ফেলে! তাই স্নেহের বশে সব সিদ্ধান্ত নিলে চলেনা। অনেক কিছুই এক কানে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিতে হয়!
বাচ্চাটার কান্না মাত্রা ছাড়া হয়ে গিয়েছে, কানে লাগছে। দত্তক নিতে লোক আসবে শুনে সবাই কি হঠাত ওর কথা ভুলে গেলো! কি জানি, মানুষের মন কখন বদলায়! সিস্টার রীনা এখনো উঁকি দিচ্ছে, ঘাড় তো ব্যাথা হয়ে যাওয়ার কথা মহিলার এতোক্ষণে! সিস্টার ভেতরে আসুন বলতেই চলে এলো সে।
বললাম- ‘বাচ্চাটাকে একটু সামলান, মা ছেড়ে পালিয়েছে ওর, একটু দেখুন প্লিজ!’
-‘ম্যাডাম আমি অসুস্থ মানুষ! পারবোনা!’
আরে আপনাকে তো কঠিন কিছু করতে বলি নাই, এটা মানবিক ব্যাপার তাইনা! এখানে অজুহাতের কি হলো?
-‘ম্যাডাম অজুহাত নয়, আমি অসুস্থ, ওটাকে কোলে তুলে নাড়ানোর মত জোর থাকলে তো ছুটি নিতে আসতাম না! আর বাচ্চারা খুব নোংরা, আমার শরীর ঘিনঘিন করে পারবোনা!’
এক নিঃশ্বাসে সবটুকু বলে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বের হয়ে গেলো। আমার ধৈর্য্যের বাঁধ সত্যি ভেঙ্গে পড়েছে আজ। আয়া রাশেদাকে ডাকতেই সে বাচ্চাটাকে নিতে গেলো। সরকারী সিলটা নিয়ে অভিযোগপত্র লিখতে বসলাম, আজকেই পাঠাতে হবে।
দুপুরের দিকে সস্ত্রীক বসুনিয়া এলেন। কালো কোটের উপর সোনার কাজ করা বোতাম, চেহারাটা এমনিতেই অভিজাত, বানানো নয়। মিসেস বসুনিয়া খুবই সাধারণ বেশের মহিলা, চোখে একটা দুঃখী ভাব, হয়তো মাতৃত্বের অভাব! বসুনিয়া সাহেব বেশি কথা বাড়ালেন না-‘তাহলে ম্যাডাম! বাচ্চাটা দুজন মিলে একবার দেখে আসি!’
আমি চেয়ার থেকে উঠতেই থামিয়ে দিলেন। ধূর্ত চোখে স্মিত হাসি হেসে বললেন-‘একটু নিজেরা নিজেদের মতো করে দেখব প্লিজ!’
অসুবিধার কিছু নেই, তাতো অবশ্যই দেখতে পারেন তারা, সারাজীবনের যখন দায়িত্ব, সেটাই স্বাভাবিক। অনেক সময় পার হলো, তাও প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট! বসুনিয়া দম্পতি দ্রুত পা ফেলে আসছেন, তাদের উত্তেজিত মনে হচ্ছে! মিস্টার বসুনিয়া উত্তেজিত অবস্থায় টেবিলে চাপড় দিলেন- ‘ডক্টর ইউ আর অ্যা লায়ার! একটা হার্টে ফুটোওয়ালা বাচ্চা গছিয়ে দিচ্ছিলেন! নীতি নৈতিকতার মাথা খেয়েছেন? রাবিশ কোথাকার!’
-‘মিস্টার বসুনিয়া কি বলছেন এসব? কে বলেছে ওর হার্টে ফুটো?’
এবার মুখ খুললেন মিসেস বসুনিয়া, অনেকটা শীতল কন্ঠে চাবিয়ে চাবিয়ে বললেন-‘ওই যে শুকনো, হ্যাংলা, পাতলা সিস্টার, গলায় ক্রস ঝোলানো, খ্রিস্টান সম্ভবত! আমাদের সব বলেছে! ঘাড় থেকে বোঝা নামানোর জন্য এতো বড় মিথ্যা আর কাউকে বলবেন না প্লিজ!’
সিস্টার রীনা বলেছে! রীনা গোমেজ! মিস্টার বসুনিয়া আরো রিয়াক্ট করতেন হয়তো, তার মিসেস সুযোগ দিলেন না, হাত ধরে টেনে বের করে নিয়ে গেলেন। আমি ক্ষুব্ধ নাকি স্তম্ভিত বুঝতে পারছিনা! এক ছুটে চলে গেলাম নিওনেটাল ওয়ার্ডে, শোক সভার মতো বাচ্চার বিছানাকে ঘিরে ফিসফিস করছে আয়া নার্সরা! ‘এই কি হয়েছে?’ বলে চেঁচাতেই সবাই তাকালো আমার দিকে। পিনপতন নিঃস্তব্ধতা ভেঙ্গে সিস্টার বিলকিস বললেন-‘বাচ্চাটা পাওয়া যাচ্ছেনা ম্যাডাম! কেউ নিয়ে চলে গিয়েছে!’
কে নিল! কিভাবে নিল! এখন এই প্রেস পুলিশ কে সামলাবে!
চেঁচিয়ে বললাম-‘থানায় ফোন দিচ্ছি আমি, আপনাদের ও তো জেরা করবে, এতো মানুষ থাকতে হারিয়ে গেলো বাচ্চাটা? রীনা কোথায়? ওইতো শেষ পর্যন্ত ছিল!’
সিস্টার বিলকিস অনুনয়ের স্বরে বলল-‘ম্যাডাম একান্তে কিছু কথা বলতে পারি?’ কথার কাতরতা দেখে অনুমতি দিলাম।
বৃষ্টি আসবে বলে মনে হচ্ছে, দমকা বাতাস জানালা দিয়ে মুখে এসে লাগছে। মাথার উপরে ফ্যানটা সা সা করে ঘুরছে। সামনের চেয়ারে অস্বস্তি নিয়ে বসে আছেন সিস্টার বিলকিস। কথা শুরু করার ইঙ্গিত দিতে শুরু করলো সে-‘ম্যাডাম রীনা গোমেজ আমার ব্যাচমেট! এখন যা বলবো প্লিজ আনঅফিসিয়ালি নিবেন!’
খানিক ক্ষণ তার মুখে দিকে তাকিয়ে সম্মতি দিলে বলল- ‘বাচ্চাটা রীনার, আমাদের কয়েকজনের সাহায্যে এখানে প্রসব হয়েছিল। ওর সাথে প্রতারণা হয়েছিল বলতে পারেন। অসুস্থ মানুষ প্রথমে বুঝতে পারে নাই, যখন বুঝল তখন অনেক দূর গড়িয়েছে! ওর অসুস্থতা জেনে……………’
আমি হাত তুলে থামিয়ে দিলাম। যেটুকু আমার জন্য জানা দরকার জেনেছি! সব গল্প সবখানে আনফিসিয়ালি শেষ করা যায়না, অফিসিয়ালিও সমাপ্তি টানতে হয়!
-‘ওকে একবার বাচ্চা সহ আসতে বলবেন। অফিসিয়ালি যেন দত্তক নেয়! আমি সমাজ কল্যাণ দপ্তর আর থানায় কথা বলে ব্যাবস্থা করে রাখব’
কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে চলে গেলেন বিলকিস। আমি রীনা গোমেজের নামে লিখা অভিযোগপত্র টা ছিড়ে ঝুড়িতে ফেলে দিলাম। এবারের মতো মাফ পাক না হয়!
লেখক পরিচিতি :সৌবর্ণ রায়, মেডিকেল অফিসার, ঢাকা, বাংলাদেশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here