অপত্য

0
965
গরমের ছুটির অলস দুপুরগুলো যেন কাটতেই চায় না। বিছানায় আধশোয়া হয়ে, একরাশ শূণ্যতা নিয়ে আনমনে বাইরে দিকে তাকিয়ে থাকে মিলি। বাইরে ঝলসানো রোদ তখন ছুমন্তর করে ছায়াদের ভ্যানিস করে দিয়েছ। নিস্তব্ধতারা ফিসফিসিয়ে ওঠে কানের কাছে। মনের গহনে রূপকথারা চুপকথা হয়ে রুপোর কাঠির ছোয়ায় কখন ঘুমিয়ে গেছে। সব সময় রিক্ত, নিঃস্ব মনে হয়ে নিজেকে। মাঝেমধ্যে স্বপ্ন দেখে মিলি, সমুদ্রের পার বরাবর একা হেঁটে যাচ্ছে ডেউ এর দিকে। সমস্ত চরাচরে কেউ কোথাও নেই। ঢেউ গুলো ক্রমশ তাকে টানছে অসীম শূণ্যতার দিকে। এই স্বপ্নটা প্রায়ই দেখে মিলি। অর্ণব বলে এধরণের স্বপ্ন গুলো মানসিক অবসাদের বার্তাবহ। অর্ণব বহুবার মিলিকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাবার জন্য বুঝিয়েছে। যাই যাই করে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি মিলির। একটা হইচই চিৎকারে চমক ভাঙে মিলির। উল্টোদিকে তাতাইদের বাড়িতে হইচই হচ্ছে। সারাক্ষণই হয়, তাতাই আর ওর মা সুপ্রিয়ার মধ্যে। সুপ্রিয়ার সঙ্গে বারান্দায় জামাকাপড় মেলতে গিয়ে দেখা হলে, সুপ্রিয়া কলকল করে একগুচ্ছ নালিশ করে তাতাইয়ের নামে। চুপ করে শোনে মিলি। বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে, চোখের কোণটাও আদ্র হয়ে আসে। কাজের অযুহাতে ঘরে চলে আসে, পাছে সুপ্রিয়ার চোখে ওর শূণ্যতা, ধরা পড়ে যায়। ওর সংসারে কোন চিৎকার নেই, হুটোপুটি নেই, হইচই নেই। আছে শুধু একরাশ ধুসর শূণ্যতায় মোড়া অপার শান্তি। চারতলার এই ফ্ল্যাটের বাতাসে শুধুই মন খারাপে মেঘ, মাঝে-মাঝেই একপশলা বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পরে।

অর্ণব আইটি সেক্টরে চাকরি করে। সকালে ব্রেকফাস্ট করে বেড়িয়ে যায়, আর ফেরে সেই রাতে। তারপর এত ক্লান্ত থাকে যে ডিনার করেই শুয়ে পড়ে। আজকাল আর খুব একটা কথাও হয়না দুজনের। মিলি খুব সকাল ওঠে।   রান্নাটা ও নিজে হাতেই করে। তারপর দুজনে ব্রেকফাস্ট করে বেড়িয়ে যায়। যাবার সময় অর্ণব মিলিকে ওর স্কুলে ড্রপ করে দিয়ে যায়। মন খারাপের মেঘটা কি অর্ণবকে ভেজায় না? নাকি মিলি আরো ভেঙে পড়বে বলে ব্যাস্ততার আবডালে অর্ণব লুকিয়ে রাখে মেঘটাকে?

কম চেষ্টা তো করেনি অর্ণব। যখন যেখানে শুনেছে, সেখানেই মিলিকে নিয়ে গেছে।  ডাক্তারের প্রেসকিপশন আর রিপোর্টের পাহাড় হয়ে গেছে। ছোটখাট সার্জারী ও হয়েছে। কিন্তু মন খারাপের মেঘটাকে তাড়াতে পারেনি অর্ণব। এই যে সুপ্রিয়া কি সুন্দর তাতাইকে কখনও শাসনের বেড়াজালে আটকে রাখে, আবার কখনও স্নেহের চাদরে মুড়ে রাখে। অপত্য স্নেহে সম্পৃক্ত সুপ্রিয়ার মুখে সদা সর্বদা একটা তৃপ্তির পরশ লেগে থাকে। লুকিয়ে ওদের মা ছেলেকে দেখে মিলি। সামনে যায়না, পাছে ভূল বোঝে সুপ্রিয়া। স্কুল থেকে ফেরার সময় ও আর সোমাদি হেঁটেই ফেরে, টুকটাক গল্প হয় দু’জনের। সোমাদির দুই মেয়ে। ওদের খুনসুটি, দুষ্টুমির গল্পের মালা গেঁথে চলে সোমাদি। কতক কানে ঢোকে মিলির কতক বা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে বেড়িয়ে যায় কানের পাশ দিয়ে। হটাই সোমাদির ডাকে চমক ভাঙে মিলির। “দেখছিস মিলি  বিকলাঙ্গ পাগলীটা, কনসিভ করেছে মনে হয়। ইস্! কত বিকৃত রুচির মানুষও আমাদের সমাজে আছে। মানসিক ভারসাম্যহীন বিকলাঙ্গ  মহিলাও, পুরুষের লালসার স্বীকার হয়”। মিলি ভাবে অন্য কথা। ঐ বিকলাঙ্গ, মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলা  পেরেছে, কিন্তু মিলি পারল না। কেন? তার কি অপরাধ? এত চেষ্টা করেও কেন তার মরা গাঙে বান আসেনা? ভগবানের এ কিরকম বিচার? সোমাদির পরের কথা গুলো আর কানে ঢোকেনা মিলির। ওর কাজের বউ পুস্পও সন্তানসম্ভবা। পুস্পর আগে দুটো মেয়ে আছে। অভাবের সংসার, কটা টাকা আর চারটি ফল মিষ্টি পাওয়ার আশায় দ্বিতীয় বাচ্চাটার পরে অপারেশন করিয়ে নিয়েছিল পুষ্প। কিন্তু তাও কোন এক অজানা কারনে পুষ্প আবার সন্তানসম্ভবা হয়েছে। গ্রামসেবিকা দিদিদের কাছে জানাতে গেছিল পুষ্প। তারা নাকি বলেছে এরকম, একশটার মধ্যে একটা কেস হয়। আর সেই একটা লটারিই বেধে গেল পুষ্পর কপালে। কিন্তু এ সন্তান তাদের কাছে অবাঞ্ছিত। হাতে টাকা নেই, ডেলিভারির খরচ সামলাবে কিভাবে, তা ভেবেই মাথায় হাত ওদের। অথচ এই যে অর্ণব আর মিলি এত চেষ্টা করছে, কই ওদের কপালে তো বাধেনা লটারি। বুকের পাঁজর নিংড়ে একটা গরম দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে মিলির। সোমাদিকে বলে, দ্রুত গেট খুলে ঢোকে মিলি। মনে মনে কথাটা ভাবে মিলি। মনস্থির করে, আজ বলবেই পুষ্পকে।

বিকেলে কাজে আসলে একথা সেকথার বলে নানা ভনিতা করার পর, পুষ্পর কাছে আসল কথাটা বলে মিলি, “তোরা তো বাচ্চাটা চাস না, আমায় দিবি বাচ্চাটা। আমি লেখাপড়া করেই নেবো। বাচ্চা হওয়া, তার আগে পরের সব খরচা দেব। দে না বাচ্চাটা কে, তুই তো নষ্ট করে ফেলতে চাইছিস। পয়সার অভাবে সেটাও করতে পারছিস না, দিবি আমাকে? আমি খুব ভাল রাখবো রে তোর বাচ্চা কে! তোর চোখের সামনেই থাকবে। আমি কোন অযত্ন করি কিনা তুই দেখতেই পাবি। দিবি রে, বাচ্চাটা কে?” শেষদিকে কথাগুলো আকুতির মতো শোনায়। প্রথমে হতবাক হয়ে গেলেও পরে সামলে নয় পুষ্প। দু’হাত দিয়ে মিলির হাত দুটো জড়িয়ে বলে, “তুমি আমারে বাঁচালে গো দিদি। পটলির বাপের তো চিন্তায় টোক হয়ে যাওয়ার অবস্থা।” সেই দিনটা অনেক রং নিয়ে এসেছিল মিলির জীবনে। বারবার অর্ণব কে ফোন করে ব্যাতিব্যাস্ত করে ফেলে। মনের খুশিতে পায়েস ও রান্না করেছিল সেদিন। অর্ণব অফিস থেকে ফেরার পর হইচই আর কলকাকলিতে ভরে গেছিল ওদের ফ্ল্যাটটা। প্রথমে অর্ণব মিলিকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল, যে ব্যাপারটা অনিশ্চিত। পুষ্প পরে মত পাল্টাতেও পারে। তাছাড়া এভাবে হয়না। ব্যাপারটা আইন মাফিক করতে গেলে অনেক ঝামেলা। তার থেকে অনাথ আশ্রম থেকেই একটা বাচ্চা দত্তক নেওয়াই যায়। মিলির নাছোরবান্দা জেদের কাছে হার মানে অর্ণব। কিন্তু খুশি আর আনন্দটা বেশীদিন স্থায়ী হয়না ওদের জীবনে। কমাস পর পুষ্প মত বদলায়। বলে, “নড়তিসে গো দিদি, পেটের উপর হাতটা রাখ, দেখো কেমন খলবল করে নড়তিসে। বড্ড মায়া গো দিদি। পটলির বাপ না করে, ওরে দিতে। বলে ভাতের জোগাড় একরকম করে হবেক্ষন। আমি পারবোনা গো দিদি। ছাওয়ালটারে দিতে পারবোনা। তুমি আমারে ক্ষমা কর”। কয়েকটা মাত্র কথা, এক নিমেশে শক্তিশেল হয়ে প্রবেশ করে মিলিকে একদম ধরাশায়ী করে ফেলে। ভাগ্যিস অর্ণব সেদিন বাড়িতে ছিলো। বুকভাঙা একরাশ কান্না নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে মিলি অর্ণবের বুকে। ক’দিন আর স্কুল যেতে পারেনি। ওদিকে পুষ্প ওদের কাজটাও ছেড়ে দিল। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে অর্ণব নিজের কানে শুনেছে পুষ্প পাশের ফ্ল্যাটের কাজের মেয়েকে বলছে, “বাঁজা বউটার নজর ছিল আমার বাচ্চাটার দিকে। সেই জন্যই  তো আমি কাজটা ছাড়লাম….” কানে গরম সীসার মত এসে বিঁধেছিল। আর দাঁড়ায়নি অর্ণব। মিলিকেও বলতে পারেনি। পাছে মিলি আরও ভেঙে পড়ে। প্রচন্ড ব্যাস্ততার মধ্যেও অর্ণব দুদিন ছুটি নিয়েছিল। তারপর মিলির বাবা মা এসে পড়ায় পরিস্থিতি কিছুটা আয়ত্তে আসে। কদিন পরে আসে অর্ণবের মা বাবা। সবাই মিলে আলোচনার করে স্হির হয়, আর না, এভাবে চললে মিলির মানসিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটছে। তাই অনাথ আশ্রম থেকে একটা শিশুকে দত্তক নেবে ওরা। অর্ণবের বাবার এক বন্ধুর সুত্রে প্রয়োজনীয় কাগজ পত্রও দ্রুত রেডি হয়। একটা ভাল দিন দেখে এখন শুধু  যাওয়ার অপেক্ষা।

প্রায় একমাস পরে………,  আজ রবিবার আর মাত্র দুদিন বাকি, আকাঙ্খিত সেই দিনটা আসতে। উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে মিলি। কদিন ধরেই মনটা খুশিখুশি। এর মধ্যেই দেশের পরিস্থিতি করোনা নিয়ে উদ্বেগের হয়ে উঠেছে। সবটাই জানে মিলি। টিভিতে রোজ দেখেও, কিন্তু গত দুদিন আর দেখা হয়নি। ও তখন নতুন অতিথির জন্য আনা, নতুন বালিশ বিছানা, জামা, খেলনা দিয়ে ঘর গোছাতেই ব্যাস্ত ছিল। সব কাজ মোটামুটি সারা, কাল থেকে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়েছে মিলি, অর্ণব দুজনেই। কি জানি! নতুন অতিথির জন্য কখন কি প্রয়োজন হয়! রাতে অন্যদিনের থেকে তাড়াতাড়ি ডিনার করতে বসে দুজন। খেতে খেতে টিভি দেখা অর্ণবের চিরকালের অভ্যাস। রোজকার মত টিভিটা খুলে খেতে বসে অর্ণব। হটাৎ ওকি ! সংবাদ পাঠিকা মেয়েটি কি বলছে? মিলির শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নামে। অর্ণবের মুখটাও থমথমে হয়ে যায়। সংবাদ পাঠিকা মহিলা তখন একনাগাড়ে বলে চলেছে, ” আগামীকাল বিকেল পাঁচটা থেকে ‘লকডাউন’ শুরু হবে, চলবে চোদ্দই এপ্রিল অবধি….…”  আর শুনতে পারল না মিলি। তাহলে এবারও হবেনা? কাল বাদে পরশুদিনই তো তার আসার কথা। এ যাত্রাতেও মা হওয়া হল না, তার মানে আর কোনদিনই হয়তো কোন ভাবেই মা হওয়া, তার হবেনা। হটাৎ একটা আওয়াজে চমকে অর্ণব ঘুরে তাকায় মিলির দিকে। মিলির শরীরটা তখন এলিয়ে পড়েছে চেয়ারের গায়ে। ওর একটা হাত লেগে কাঁচের বাটিটা পড়ে ভেঙে গেছে। তারই আওয়াজ হয়েছে। ঘটনার আকষ্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পরে অর্ণব। মিলির গ্লাসের জলটাই ওর চোখেমুখে ছিটিয়ে দেয়। দু’এক সেকেন্ড পরে আস্তে আস্তে চোখ মেলে মিলি। ইশারায় ও কি বলতে চাইছে? বুঝতে পেরে অর্ণব তাড়াতাড়ি বেসিনের কাছে নিয়ে যায় মিলিকে। শুধু নিয়ে যাওয়াটা অপেক্ষা। বেসিনের সামনে পৌছে হড় হড় করে বমি করে মিলি। দুপুরের ভাত তরকারি সব বেড়িয়ে আসে। বমিটা হওয়ার পর একটু স্বাভাবিক হয় মিলি। অর্ণবের মাথায় তখন অন্য চিন্তা। এক্ষুনি একটা ডাক্তারের সঙ্গে কনসাল্ট করা দরকার। কিন্তু আজ যে জনতা কার্ফু। ডাক্টার কোথায় পাবে? হটাৎ মনে পড়ে, তাদের পাড়ার মোড়েই একটা নতুন নার্সিংহোম হয়েছে। সেইখানেই তো নিয়ে যাওয়া যেতে পারে মিলিকে।

নার্সিংহোমের রিসেপশনে বসে সাতপাঁচ ভেবে চলে অর্ণব। কি জানি কি হল মিলির? বেশতো ছিল। লকডাউনের খবরটাই নিতে পারেনি মনে হয়। বড্ড নরম মন মেয়েটার। হটাৎ চমক ভাঙে রিসেপশনিস্ট এর সম্বোধনে,  “আপনি ভেতরে যান, ডাক্তারবাবু আপনাকে ডাকছে”। ধরমর করে উঠে পড়ে অর্ণব। ডাক্তারের চেম্বারে মিলির মুখোমুখি বোসে একজন বয়স্ক ডাক্তারবাবু খসখস করে প্রেসকিপশন লিখছেন। অর্ণব ঘরে ঢুকতেই, ইশারায় সামনের চেয়ারে বসতে বলেন। চেয়ারটা টেনে নিঃশব্দে বসে অর্নব। এক নিমেষে মিলির চোখে চোখ পড়ে যায়। ওর চোখটা কি অন্য দিনের থেকে একটু বেশী চকচকে লাগছে ? গলা খ্যাকারি দিয়ে ডাক্তার বাবু বললেন, “আপনি পেশেন্টর কে হন”?
….”হাসবেন্ড” ভয়ে ভয়ে উত্তর দেয় অর্ণব।
…..” আপনারা এতটা ইরেসপন্সেবল কি করে হন বুঝতে পারিনা। পেশেন্ট প্রায় তিন মাসের প্রেগন্যান্ট। আমরা ইনস্টান্ট কীটে টেস্ট করে নিয়েছি…….. ”
পরের কথা গুলো আর কান দিয়ে ঢুকলো না অর্ণবের। চোখ পড়ল মিলির চোখে। মিলির  চোখে জল। দু’জোড়া চোখ পরষ্পরকে আশ্রয় করে বাঁচার খড়কুটো খুঁজে নেয়। অর্ণব ভাবে ভাগ্যিস লকডাউনের ঘোষনা হল, তা না হলে তো কাল বাদ পরশুই অনাথাশ্রমে চলে যেত ওরা…। আর ভাবতে পারেনা। মিলি একটা হাত বাড়িয়ে অর্ণবের হাতটা ধরে। অর্ণবও শক্ত মুঠোয় ওর হাতটা চেপে ধরে।।

লেখিকা পরিচিতি : চন্দনা রায় চক্রবর্তী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here