লেখা কি কখনো নিজের হয়? পরের লেখাকে, নিজের বলে চালিয়ে নেওয়ার পারদর্শিতাকেও, কখনো কখনো দক্ষতা বলে ধরা হয়। অক্ষর যখন ছড়িয়ে পড়ে, ব্যাপ্তি তার সীমা ধরে না। কতদূর গিয়ে শেষ হয়, তার পরিধি কে মাপতে যায় ?
পরিমাপের একক কি? ভৌতবিজ্ঞান যে একক শেখায়, তাই কি যথার্থ? সেইটাই কি পরিমাপের চূড়ান্ত মান। তাই যদি হয়, তাহলে অল্পতে খুশি থাকিনা কেনো? প্রশ্নচিহ্ন টা থেকেই যায়। উত্তরের খোঁজ, শত আলোকবর্ষ পেরিয়ে, অন্য সৌরজগতের পথে মুখ লুকায়।
জীবন কত কি শেখায়। ছোটবেলায় শালগাছের জঙ্গল বুকের মধ্যে কত রোমান্টিকতার জাল বুনতো। কেন জানিনা ভালো লাগতো, হয়তো মন নিষ্পাপ ছিল তাই! শালপাতার জঙ্গলে, ডাক তোলা, কাকে খুঁজতাম? আদৌ কি, কাউকে খুঁজতাম? সরু পথে, হারিয়ে যেতে মন চাইতো। কিন্তু হারাতাম তো না! আজকে হারাতে ভয় করে। কেন! সেই পথটা নেই বলে, নাকি মনের মধ্যে পাপ ঢুকেছে? মন যে বড় হয়েছে, পরিমাপে বেড়েছে। পরিমাপের এককটা যেন কি? প্রশ্নচিহ্নটা থেকেই যায়…
জঙ্গলে কি নদী থাকে? যেখানে জলপরীরা নেমে আসে। ধূর! লালমাটির জঙ্গলে নদীই নেই, তো জলপরী। সাইকেলে নাকি কেউ, ফুল লাগায় না। ফুলতো মাথায় লাগায় ! লালমাটির জঙ্গলে, শালগাছের ফুল! সেতো ঘূর্ণি, মাথায় লাগানো যায় না। শালের ফল দেখেছিস? নিষ্পাপ মন, প্রথম পাপের পাঠ, জঙ্গলের পাঠশালা, আহা! বিশুদ্ধ হাওয়া লাগে গোপনাঙ্গে। ভৌতবিজ্ঞান কি জীবন শেখায়?
এপ্রিল ফুলের গন্ধ থাকে? থাকে তো, ঠিক ফুলকপির মতো। কিন্তু কি করে মাপবি? হিরো সাইকেলে মোটর লাগালে, সেটা নাকি হিরো পুক হয়ে যায়। ওটা নিজে নিজে চলে, না ঠেলতে হয়? পিঁপড়ের সাথে বিয়ে কি শুধু ছেলেদেরই হয়। ধুস! মেয়েরা তো বিয়েই করে না। পিঁপড়ে কামড়ায়, জলট্যাঙ্কের গায়ে পাটীগনিত শেখায় সে। সাবধান! ওর পকেটে কিন্তু ব্লেড আছে। কবুতর ঠোঁটে চিঠি নিয়ে যায়, ঠিকানাটাই তো ভুল, ব্লেডের আর কি দোষ। রক্তর পরিমাপ কি?
“ভেজিটেবল হটডগ” র কোনো বাংলা নাম হয় না। রসগোল্লার বালতিতে, রসের কোনো কমতি নেয়। বিশ্বামিত্রের ঔরসে নাকি শকুন্তলার জন্ম, ঔরস না ইয়ে! সত্যি, কেন যে ভিডিও ক্যাসেটের বেল্টগুলো সব চষা হয়ে যায়, ভালো লাগে? কালীপুজোর রাতে, হিমের পরশে, ননভেজ খিচুড়ি! এবার নাকি, স্টোরের পুজোয় তাসাপার্টি আসবে? পুজো মানে তো, বিশ্বকর্মা পুজো। সত্যি, একটা ক্যাসেট ও, না আটকে চলে না।
কাল দুপুরে ঝুমুর যাবি? ক্যাকটাসের গাছে, ফুল আর ফোটে না। রেশনের লাইন, হোক না বড়ো, ইস ব্যালকনির হাতছানিতে বড় টান পড়ে, রক্তক্ষরণ হয় বুকে। দিবি নাকি একটা টান? না না, রক্তক্ষরণ হয়েই চলে, মাপাতো যায়না, ব্যালকনি ফাঁকায় পরে থাকে। জয় মা বলে, রকেট চাপা। অস্ট্রোনট নাকি, যে রকেট চাপবি? শিলিগুড়ি পৌঁছে, ফোন করিস, লালমাটি ছুরি চালায় বুকে, রক্তক্ষরণ! পরিমাপের এককটা যেন কি বললে !!!
প্রথম অধ্যায়
কাঁচরাপাড়া স্টেশনে নেমে রিক্সা নিতে হবে। পাক্কা পনেরো মিনিটের পথ রিক্সায়। মেয়েটি দেখতে, শুনতে মাঝারি, সবকিছুতেই মধ্যম মান। শুভাকর বাবুর ভাগ্নি। বোনের বর, ডালহৌসিতে কোন এক অফিসের কর্মচারী ছিলেন। পার্টির মিটিংয়ে, গরমের মধ্যে রাস্তাতেই সেরিব্রাল। ছেলেটা বাবার চাকরী পেয়েছে, বোনের বিয়েটা দিতে পারলেই, ঝাড়া হাত-পা, মাকে নিয়ে কোলকাতা নিবাসী হতে পারে। সবাইকে বলেও রেখেছে, যদি কেউ সন্ধান দেয়। কিন্তু মধ্যম মান ! সে যে বড় ভয়ানক।
স্থানীয় সংবাদ টা, আজকে আর মন দিয়ে শুনতে পারছে না কাশীনাথ। অনেকদিন ধরেই ভাবছে, এবার ছোট ছেলেটার বিয়ে দিতে। শুভাকর বাবু, সেদিন বলছিলেন, তাঁর ভাগ্নিটি নাকি বিবাহযোগ্যা, কিন্তু মাঝারি গরণ ও স্বল্পবুদ্ধির। তাতে কি! পরশ ও তো মধ্যমানের। বাস্তব বুদ্ধি হয়তো তার বেশি থাকতে পারে, কিন্তু পলাশের মতো মেধাবী, কোনোদিনই ছিল না পরশ। ধীর, স্থির, বিচক্ষণ পলাশ অপেক্ষা, পরশ অনেক বাস্তববাদী ও বান্ধবপ্রিয়।
পলাশ যেবার, শিবপুরের কলেজে পড়তে গেলো, সেবছরই তমসার শেষ সন্তান জন্ম নেয়। বৃহস্পতিবারের বারবেলায়, টেলিগ্রামটি যখন আসে, কাশীনাথ তখন সদ্য গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরে, দুপুরের খাবার খেতে বসেছিল। শেষ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে, তমসা আর ফিরে আসে নি। মেয়ের মৃত্যুসংবাদ, কাশীনাথ কে হতবাক ও হতাশ করে দিয়ে যায়। তমসা ও তো মধ্যমানের ই ছিলো, নাহলে নাবালিকা মেয়ের বিয়ের সময়, চোখের কোনে জল হয়তো ছিলো, কিন্তু বাপের জন্য কোনো অভিমান ছিলো না। শিবপ্রসাদ কোলিয়ারির দপ্তরে কাজ করে, বংশ ভালো, চাহিদা বেশি নেই, মেয়েকে সুখে রাখবে, এই ভরসায় গৌরীদানের পূণ্য অর্জনের লোভ ছাড়তে পারেনি, কাশীনাথ। অন্নপূর্ণার হাজারো আপত্তির বিরুদ্ধে গিয়েই, বিয়ে দিয়েছিলো তমসার। গৌরীদানের গ্লানি, আজও কুঁড়ে কুঁড়ে খায় কাশীনাথকে। তাই শুভাকর বাবু, যখন ভাগ্নির কথাটি পারলেন, কেন জানি না, শীতের সন্ধ্যায় অজান্তে তমসার মুখটা ভেসে উঠলো কাশীনাথের মনে। কোনোভাবেই কি, গৌরীদানের প্রায়শ্চিত্যটি করা যায় না? স্থানীয় সংবাদটি আজকে আর ভালো করে শোনা হলোনা তার।
টাটানগরের কারখানায়, কোনো বিপত্তির খবর, কিছু বললো না তো? শিবপুরের কলেজে লেখাপড়া শেষ করার পরে, পলাশ যে ঐখানেই কাজ করে। টাটানগরের বাসায়, কয়েকবার গিয়েও ছিলো অন্নপূর্ণা। পলাশের অনেক ইচ্ছা ছিলো, কাশীনাথ কে নিয়ে আসার, কিন্তু তার আর যাওয়া হয়ে উঠেনি। কেন জানে না, মনের মধ্যে একটু ভয় ও পেয়েছিলো সে। অন্নপূর্ণার মুখেই শুনেছে, টাটানগরের কারখানা তো, আর কারখানা নয়। নগরের চাইতেও বড়! রাতের আলোর শোভা, সে নাকি চোখ ঝলসায়। কারখানায় যাতায়াতের জন্যে, বাস আছে। বাজার-হাট, হাসপাতাল, বিদ্যালয়, সবই নাকি নগরের মধ্যে।
বাসার পিছনে, ফুল আর সব্জির বাগান করেছে ছেলেটা, অন্নপূর্ণা ই বলেছিলো, কাশীনাথ কে। ছোটো থেকেই, গাছ আর পাখি খুব ভালোবাসে সে। হয়তো তাদের মধ্যেই, মুখচোরা ছেলেটা, নিজেকে ভালো করে মেলে ধরতে পারে। আজকে আর শরীরটা ভালো ঠেকছে না, কাশীনাথের। রাতে আর কিছু খেলে না। অন্নপূর্ণা কে বলে, তাড়াতাড়ি মশারী টা খাটিয়ে, শুয়েই পড়লো।
সকাল ৮:২৫ র শান্তিপুর লোকালটা, আজকে একটু দেরীতে চলছে। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে, সাইকেলের চাকাটা যে, এইভাবে ধোঁকা দেবে, ভাবেনি অনিন্দ্য। ভাগ্যিস ট্রেনটা লেট্ আছে, নাহলে চাঁদমারীর মোড়ে, গোলোকদার ক্লিনিক থেকে , রক্তের স্যাম্পল গুলো নিয়ে, আজকে আর গাড়ী ধরা সম্ভব হতো না। কলকাতার ক্লিনিকে স্যাম্পল গুলো সকাল সকাল জমা দিতে পারলে, ফেরার গাড়িতে রিপোর্ট নিয়ে, রাত্রিবেলায় দাদার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আস্তে পারে। বিনিময়ে, কিছু অতিরিক্ত উপার্জনের, এই পন্থাটা মন্দ নয়। বাবা হঠাৎ করে মারা যাওয়ার পরে, চাকরি টা পেয়ে, বিপদ এড়ালেও, সাচ্ছল্য তাদের জীবণে কোনোদিনই ছিলো না। গোলোকদা যখন বললেন, তখন আর দ্বিতীয় বার ভাবেনি অনিন্দ্য।
“দাদা, শুধু মল-মূত্রে র শিশি গুলো দিয়োনা। ওটি পারবো না। গা টা একটু ঘিনিয়ে উঠে।” – অনিন্দ্য জানে, লোকটা ব্যবসা করলেও, ব্যবসায়ী নয়।
“ভাই, ব্যাগটা কি আপনার? আর একটু হলেই তো, ভুলে মেরে দিচ্ছিলেন?” পাশের লোকটার কথায়, ঘোর ভাঙে তার। স্যাম্পলের ব্যাগটা আজ ট্রেনে ভুলে আসছিলো। কয়েকদিন ধরে, বোনের বিয়ের চিন্তাটা ভাবাচ্ছে। বড়মামা যদিও একটা পাত্রের সন্ধান দিয়েছেন, কিন্তু সে যে বড় পাড়া গাঁ। বাবা র অনেক ইচ্ছা ছিলো, সে W.B.C.S পরীক্ষায় বসে। ভর্তিও হয়েছিল একটা কোচিং ক্লাসে কিন্তু বাবার হঠাৎ করে, চলে যাওয়ায় অনেক কিছুর মতন, সেই ইচ্ছাতেও লাগাম টেনে দেয়। বোনটার বিয়ে দিতে পারলে, ইচ্ছা আছে আবার শুরু করার।
“অনি, বড়মামা খবর পাঠিয়েছে, শনিবার বিকেলে আসবে। রোববার ভোর ভোর তোকে নিয়ে যাবে দুবরাজপুর। সুমি র একটা ভালো শাড়ী পড়া ছবি চায়।”
“সে যে, বড় দূরদেশ মা। কাঁচরাপাড়া থেকে দুবরাজপুর। তাওতো শুনছিলাম, আরো বেশ কিছুটা ভিতরে যেতে হয়। এই সম্বন্ধটাই, না এগোলেই কি নয়?”
“এতো করে যখন বলছে, হয়তো ওঁরা ভালো ঘর হবে। মামা র কথা ফেলিস না, বাবা। দুঃখ পাবে লোকটা।”
বোনের সম্মন্ধের জন্য, অনেককেই বলে রেখেছে। অফিসের কলিগ, এই সেদিনও যাদেরকে কাকু বলতো, বাবার বন্ধুর সুবাদে, তাদেরকেই বলেছে, যদি কারোর কোনো চেনা-জানা থাকে। গতমাসে বড়মামা, তাঁর কোন এক বন্ধুর পরিচিতির ছেলের সম্মন্ধ নিয়ে এসেছে। মানুষটি পোস্ট-অফিসে কাজ করতেন, অবসর নেওয়ার পর, গ্রামের বাড়িতেই থাকেন। আর মাঝে মাঝে অন্যের পলিসির কাগজ-পত্র নিয়ে, দুবরাজপুরে জমা দিতে আসেন। মধ্যবিত্ত সংসার, গ্রামে ছটাক জমি আর ঘরে কূলদেবতা। ছোটোছেলের বিবাহের জন্য সম্মন্ধ দেখছেন। ছেলেটি নাকি, বক্রেশ্বরের থার্মাল প্রজেক্টে, অস্থায়ী কর্মচারী হিসেবে আছে এখন, পরে স্থায়ী হয়ে যাবে।
“সুমি, তাহলে তো সাহেবের, গায়ে রক্ত কম। কি বলিস?” – কয়েকদিন আগে খবরের কাগজে , দিয়েছিলো তো, জাপান সরকার পয়সা দেওয়া বন্ধ করায়, মূখ্যমন্ত্রী রক্ত দিয়ে বক্রেশ্বর গড়ার হুমকি দিয়েছেন। নিজের মনেই হাসে অনিন্দ্য। আর যে কত প্যারাসাইট আছে, আমাদের সমাজে।
বড়মামা সমন্ধে, অনিন্দ্যর অভিমত, ভদ্রলোক নিশ্চিত ছাতার দোকানে কাজ করেন। নাহলে যখনি জল পরে তাদের মাথায়, ঠিক ছাতা নিয়ে হাজির হয়ে যায়, অকৃতদার এই লোকটি। বড় বিশ্বাসের জায়গা তার। কিন্তু সমাপ্তি, ভাবতেও অনিন্দ্যর নিজেকে স্বার্থপর মনে হয়। তিন বছরের ছোটো, জেদী, একটু কম বোঝে, অবস্থার মাঝে পরে, কলেজের পড়া শেষ করতে না পারা, বোনটাকে নিজের ঘাড় থেকে নামানোর জন্য বেশি ব্যাস্ত হয়ে পড়ছে নাতো?
না না ! দরকার নেই এতো তাড়াতাড়ি আর এতো দূরে বিয়ে দিয়ে। শনিবার রাত্রিতে, সাহস করে বলেই দেবে, বড়মামাকে। “দরকার নেই, দুবরাজপুর। রাঁড়বঙ্গ, সে যে বড়ো দূরদেশ”।
[ক্রমশঃ]
লেখক পরিচিতি : প্রসূন কুমার চট্টরাজ, রেডমন্ড, ওয়াশিংটন …
বিঃ দ্রঃ লেখাটি ফেব্রুয়ারী ,২০২০, “মাসিক জনপ্রিয় লেখনী” প্রতিযোগিতার অন্তর্ভুক্ত।