গ্র্যাজুয়েশন পাশ করে বিভিন্নরকম চাকরির পরীক্ষার পাশাপাশি সুজিত বেশ ভালোই টিউশন করছে এখন। সুজিতের একটা বোন আছে, সে ক্লাস নাইনে পড়ে। তার বাবার ছোট মুদিখানার দোকান আর সামান্য কিছু জমি আছে। অভাবের সংসারে বাবাকে সাহায্য করতে কলেজে পড়ার সময় থেকেই সে টিউশন করছে, তবে এখন তার পসার আগের থেকে অনেক বেশি আর সংসারটাও অপেক্ষাকৃত সচ্ছল। নিজের বাড়িতে পড়ানোর সাথে কয়েকজনের বাড়িতে গিয়েও পড়াতে হয় তাকে। মাসতিনেক হলো অঞ্জনকে পড়াতে যাচ্ছে সে। অঞ্জন ক্লাস এইটে পড়ে। তাদের বাড়ি পাশের গ্রামের শেষ প্রান্তে। অঞ্জনের বাবার সাথে সুজিতের বাবার ছোট থেকেই বন্ধুত্ব। অল্প দিনের মধ্যেই অঞ্জনদের পরিবারের সাথে সুজিতও খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলো। বাড়িতে অঞ্জন ছাড়া আছে আরও চারজন সদস্য – তার বাবা,মা, বোন আর তার ঠাম্মা। অঞ্জনের বাবার নাম দেবব্রত বেরা। তিনি স্কুল- শিক্ষক। অঞ্জনের বাবাকে দেবুকাকা বলেই ডাকে সুজিত।
সুজিতদের গ্রামে সকলেরই কম-বেশি জমি- জায়গা আছে। মূলত ধান-জমির উপর এখানকার সমাজ-অর্থনীতি দাঁড়িয়ে, তবে বর্তমান সময়ে জীবন – জীবিকার জন্য মানুষজনের ভিন রাজ্যে পাড়ি দেওয়ার ঝোঁকই বেশি। গ্রামের শান্ত,মুক্ত পরিবেশ, বিস্তৃত মাঠ, খোলা আকাশ, ঋতু পরিবর্তনের সাথে-সাথে সবুজ প্রকৃতির রূপ – রঙের বিচিত্র খেলা, নানারকম পাখির আনাগোনা এই ব্যাপক বিশ্বায়নের রুক্ষ ব্যস্ততার যুগে সুজিতকে বেশ আরাম দেয়। ভবিষ্যতে কর্মসূত্রে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার কথা ভেবে কষ্ট হয় সুজিতের। কিন্তু এটাই জীবন! সুজিত খুব প্রাণবন্ত প্রকৃতির ছেলে, তবে সম্প্রতি একটা বীভৎস অভিজ্ঞতা খুব আঘাত দিয়েছে তাকে। স্বাভাবিক সজীবতা হারিয়ে সে যেন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছে সর্বক্ষণ।
অঞ্জনরা এখন যে বাড়িতে থাকে, সেটা তাদের মূল ভিটে বাড়ি থেকে বেশ কয়েকটা বাড়ি পরে। অঞ্জনের বাবা চাকরি পাওয়ার পর এই জায়গায় বাড়িটা করে একটু নিরিবিলিতে থাকার জন্য। বাড়ির পিছনটাতে দিগন্ত বিস্তৃত ধান-ক্ষেত, ঘরগুলোয় বেশ আলো – বাতাস খেলে। বাড়ির সামনেও বেশ কিছুটা ফাঁকা জমি। এখানে অঞ্জনরা মাঝেমধ্যে খেলাধুলা করে আর এক পাশে কিছুটা জায়গায় অঞ্জনের মা বিভিন্নরকম সবজি চাষ করে। তাদের বাড়ি সীমানা বরাবর বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা ও সামনে একটা শিকল দেওয়া দরজাও আছে যাতায়াতের জন্য। বেশ ছিমছাম বাড়ি। অঞ্জনের কাকা – জ্যাঠারা মূল বাড়িটাতেই থাকে, তাঁদের সাথে অঞ্জনদের সম্পর্ক ভালো, আসা – যাওয়াও আছে। অঞ্জন আর তার বোন তাদের তুতো ভাইবোনদের সাথে খেলাধুলা, সময় কাটানোর জন্য প্রায়ই ও – বাড়িতেই থাকে। সুজিত পড়াতে গেলে বেশিরভাগ দিনই অঞ্জনকে ও – বাড়ি থেকে ডেকে আনতে হয়। অঞ্জনের ঠাম্মা বেশ প্রাণখোলা, হাসি – খুশি মনের মানুষ। বয়স আশির উপরে। সুজিতকে তিনি নিজের নাতির মতোই ভালোবাসেন, পড়াতে ঢুকলেই সুজিতকে আদর করে তিনি কাঁপা – কাঁপা গলায় তাঁর বৌমার উদ্দেশ্য বলেন, ‘বড়ো ভাই চলে এলো যে বৌমা, কচি ভাইকে ডাক দাও এবার।’ সুজিতও মুচকি হেসে ব্যাপারটা উপভোগ করে। বার্ধক্যজনিত নানা অসুখ তাঁর ছিল বটে, তবে হঠাৎই কয়েক সপ্তাহ অসুস্থতায় শয্যাশায়ী হয়ে ভুগলেন তিনি আর সুজিতের জীবনেও ঘটে গেল এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা।
গত শুক্রবার অঞ্জনকে পড়ানো ছিল সুজিতের। অঞ্জনকে সে সপ্তাহে তিনদিন পড়াতে যায় সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টার সময়। একমাস পুজোর ছুটির পর একসপ্তা’ হয়ে গেছে স্কুল খুলেছে। আর কিছুদিন পরেই স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা। অঞ্জন ছাত্র হিসাবে খারাপ না। তাই, তাকে ঘিরে সুজিতের আগ্রহ, প্রত্যাশাও ভালোই।
হেমন্তের শুরু। সামনে শীত আসন্ন। এখন থেকেই কেমন ঝপ্ করে সন্ধ্যাটা নেমে যায় আর কিছুটা ঠান্ডাও পড়ে। একটা বিশেষ কাজের জন্য বুধবার সুজিত পড়াতে যেতে পারেনি অঞ্জনকে। এদিকে আবার বুধবার থেকে শুরু হয়েছে ঘোর নিম্নচাপের অকাল – বর্ষা। একটানা বৃষ্টি চলছে; কখনো বাড়ছে, কখনো কমছে; সাথে আছে রণহুংকার দেওয়া মেঘের গর্জন আর ঠান্ডা ঝোড়ো বাতাস। চারিদিকে ঘনঘোর কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশ, কেমন যেন পৃথিবীর সব দুঃখ একসাথে ঝরে পড়ছে আর সব রহস্য এক জায়গায় এসে ঘনীভূত হয়েছে! আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বারবার বলা হচ্ছে, এই বৃষ্টি আগামী পাঁচ – ছ’ দিন ধরে চলবে।
বুধবারের পর বৃহস্পতিবার পেরিয়ে শুক্রবার উপস্থিত হল। মাঝের দিনটাতেও যথারীতি সমান তালে বৃষ্টি চললো। শুক্রবার সকালে ঘুম থেকে উঠে সুজিত দেখল, আকাশের মুখ আগের মতোই ভার; তবে বৃষ্টিটা আগের থেকে অনেকটা কমেছে। কিছুটা আশ্বস্ত হলো সুজিত, অসময়ের এই একঘেয়ে বৃষ্টি সত্যি তার ভালো লাগছে না আর! তবে এমন পরিবেশে সুজিতের যেটা বরাবরের প্রিয়, তা হলো- গরম-গরম খিচুড়ি-বেগুন ভাজা আর রোমহর্ষক রহস্য-রোমাঞ্চ গল্প। সুজিত তার মা’কে বললো, ‘আজ দুপুরে খিচুড়ি রাঁধো মা, জমিয়ে খাওয়া যাবে। তোমার হাতের খিচুড়ি কতদিন যে খাই না! বেগুন তো ভাজবেই, সাথে ডিম-ও ভেজো একটু।’
দুপুরে তৃপ্তি করে খিচুড়ি খেয়ে সুজিত বিছানায় শরীরটাকে এলিয়ে দিলো। হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নিয়ে একটা গল্প চালিয়ে দিল সে। চিত হয়ে শুয়ে সুজিত মনে মনে বললো, ‘আহ্….!এই আরামটুকুর জন্যই এত পরিশ্রম।’ গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেছিল সুজিত। কিছুসময় পর জেগে উঠে সে দেখল বৃষ্টি আবার স্বমহিমায় আবির্ভূত হয়েছে। যতই বিকেল গড়াতে লাগলো, বৃষ্টির প্রাবল্য ততই বাড়তে লাগলো। সুজিতকে আজ পড়াতে যেতেই হবে। সামনে অঞ্জনের পরীক্ষা, গত দিন যাওয়াও হয় নি, এমন আবহাওয়া! – সব কিছু নিয়ে সুজিত বেশ উদ্বিগ্ন। তারউপর, সুজিতদের গ্রামে এই এক উপদ্রব! লোডশেডিং হলে আর আসতেই চায় না ইলেকট্রিক, তায় আবার এই ঘোর দুর্যোগ! সুজিত শেষমেশ মা’র বারণ অগ্রাহ্য করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো সওয়া ছ’টা নাগাদ।
বাইরে বেরিয়ে দুর্যোগের আধিক্য আরও বেশি করে বুঝতে পারলো সুজিত। পথে ঘন অন্ধকার, সাথে চলছে ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির দাপট। ফুল – হাতা জামার উপর থেকেও ঠান্ডা বাতাস যেন তীক্ষ্ণ ফলার মতো বিঁধতে লাগলো সুজিতের গায়ে। চারদিকটা শুনশান। রাস্তায় লোকজন চোখে পড়ছে না সুজিতের, দোকানপাটও সব বন্ধ, কে-ই বা থাকবে এই বৃষ্টিতে! ব্যাঙ আর ঝিঁঝির সমবেত কলরবে এখনই তার মনে হচ্ছে গভীর রাত। মাথায় ছাতা টাঙিয়ে, হাতে টর্চ ধরে ঝোড়ো হাওয়ার বিপরীতে সাইকেল চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল সুজিতের। তাই সে সাইকেল থেকে নেমে, সেটার হ্যান্ডেলটা ধরে দ্রুত পা চালাতে লাগলো তার গন্তব্যের দিকে। সুজিত যেন ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল আদিম অন্ধকারের গর্ভে।
অঞ্জনদের পাড়ায় ঢুকেও একইরকম চিত্র চোখে পড়ল সুজিতের। সুজিতের মনে হলো, কোনো বিশ্বব্যাপী শোকে সারা পৃথিবীর মানুষ যেন একসাথে নীরবতা পালন করছে। বৃষ্টি ও ঝড় আগের থেকে অনেকটা কমে এসেছে এখন। যাইহোক, অঞ্জনদের বাড়ি যেতে গেলে রাস্তার ডান দিকে একটা বাঁক নিতে হয়, সেখানে মোড় নিতে গিয়ে সুজিত দেখল, তার সামনে কোত্থেকে একটা কালো রঙের কুকুর এসে গা ঝাড়া দিয়ে শূন্যে মুখ তুলে কু-ডাক ডাকছে। সুজিত কুকুরটার দিকে টর্চ ঘুরিয়ে হুস্ – হুস্ বলে তাকে সরিয়ে দিল। সামনে এগিয়ে যাওয়ার সময় সুজিত পিছন থেকে আবারও শুনতে পেল কুকুরটার সেই বিকৃত কু – ডাক। আর পাত্তা দিল না সুজিত। কিছুটা দেরি হয়ে গেছে। সে জোরে পা চালালো। সামনে আর কয়েক পা গেলেই অঞ্জনদের বাড়ি।
বাঁ হাত দিয়ে সামনের দরজাটা ঠেলে সাইকেল নিয়ে ঢুকতে – ঢুকতে সুজিত বেশ অবাক হলো। বাড়ির আর কাউকেই চোখে পড়ছে না তার, ঘরে ঢোকার সিঁড়ির মুখে শুধু অঞ্জনের ঠাম্মা একা চুপচাপ বসে আছেন, তবে তাঁর চোখে- মুখে আগের মতোই বেশ সতেজ ভাব; সুস্থ থাকলে তিনি এইভাবেই বসে থাকেন এখানে। পাশে একটা হারিকেন জ্বলছে, হারিকেনের পাশে রাখা আছে তাঁর লাঠিটা। সুজিত মনে-মনে বললো, ‘গত ক’দিন আগে ঠাম্মাকে অসুস্থ-শয্যাশায়ী দেখলাম – এ – বাড়ি, ও – বাড়ি থেকে লোকজন আসছে – পাড়া – প্রতিবেশীরা দেখতে আসছে – সেবা- শুশ্রূষা করছে – এসব দেখে গেলাম… আর আজ কেউ নেই! এত তাড়াতাড়ি উনি সুস্থ হয়ে উঠলেন! যদিও আমি তো মাঝে একদিন আসিনি, এ- ক’দিনের মধ্যে হয়তো উনি সুস্থ হয়ে উঠেছেন, আমিই ভুল ভাবছি।’ সুজিত সাইকেলটা রেখে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে অঞ্জনের ঠাম্মাকে একসাথে কয়েকটা প্রশ্ন করলো, ‘এখন কেমন আছ ঠাম্মা? বাড়ির আর সবাই কই? অঞ্জন গেল কোথায়? কাকা স্কুল থেকে ফিরেছে?’ পরিচিত কাঁপা- কাঁপা গলায় হেসে – হেসে এক এক করে সুজিতের সব কথারই জবাব দিলেন অঞ্জনের ঠাম্মা। বললেন, ‘ভাইরে,আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ। শুয়ে থাকা লোক না আমি। একসময় একা হাতেই ধান ঝাড়াই – মাড়াই – সিদ্ধ করা – রোদ দেওয়া – বাগান দেখা – ছেলেপুলে মানুষ করা – সবই করেছি। তোর কাকিমা পাশের বাড়ি গেছে একটু দরকারে, তোর কাকা ফেরেনি এখনো। আর কচি ভাইতো ও- বাড়িতে, খুব দুষ্টু হয়েছে আজকাল, পড়ার কথা খেয়ালই থাকে না! তুই ঘরে উঠে বোস, গামছা মেলানো আছে দেখ, মাথা – হাত – পা মুছে নে। আমি গিয়ে ডেকে আনছি ভাইকে।’ এই বলে অঞ্জনের ঠাম্মা জায়গা ছেড়ে উঠে পড়লেন। সুজিতও পা ধুয়ে ঘরে উঠে অঞ্জনের পড়ার ঘরে হাতের ব্যাগটা রেখে সাথেসাথেই বারান্দায় এলো হাত – পা মুছতে। মুহূর্তের হেরফের। এর মধ্যেই ঘটে গেল একটা অদ্ভুত ব্যাপার।অঞ্জনের ঠাম্মাকে দেখতে পেল না সুজিত। অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে সুজিত নিজের মনে বলে উঠলো, ‘কেমন হলো! পা ধুয়ে উপরে ওঠার সময়ও তো ঠাম্মা এখানে দাঁড়িয়েছিল। আমি তো ঘরে ঢুকেছি আর বেরিয়েছি, তার মধ্যেই কোথায় গেল ঠাম্মা! একজন সুস্থ – সবল – জোয়ান মানুষও তো এত তাড়াতাড়ি যেতে পারবে না! আর একজন সদ্য অসুস্থতা কাটিয়ে ওঠা বয়স্ক মহিলা….! ছাতা , টর্চ – ও তো নিতে দেখলাম না ঠাম্মাকে!’ এরপরেও সুজিত কিছুক্ষণ আপন মনে বিড়বিড় করে ঘরে ঢুকে এলো। ঘরে ঢুকে নিজের টর্চটা জ্বালিয়ে বিছানায় বসতে গিয়ে আবারও বিস্মিত হলো সুজিত। সে দেখল, অঞ্জনের খাটে এ – মাথা ও – মাথা জুড়ে পুরোটা সাদা ধবধবে বেডকভার পাতা, খাটটা যেন কোনো শবের মতোই পড়ে আছে। অঞ্জন মিকি মাউস পছন্দ করে খুব। তার বিছানায় সবসময় মিকি মাউসের ছবি দেওয়া বিভিন্ন বেডকভার পাতা থাকে। তিনমাসে এমন ছবি কোনোদিন দেখেনি সুজিত। খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বিছানায় বসে পড়লো সে।
পড়াশোনায় ভালো হলেও অঞ্জনের এই দায়িত্বহীন, সময়- খেলাপি আচরণ খুব বিরক্ত করে সুজিতকে। অনেকভাবে বুঝিয়েও তাকে খুব অল্পদিনই সময় মতো পাওয়া যায়। সুজিত মনে মনে বললো, ‘না…! কাকার সাথে এবার কথা বলতে হবে, প্রতিদিন এমন আচরণ সহ্য করা যায় না।’ সুজিত অনুভব করলো ঘরে ঠান্ডা বাতাস আসছে।চোখ ঘোরাতে সে দেখতে পেল তার মাথার পিছন দিকের জানালাটা খোলা। সুজিত অবাক হলো, ‘এই ঠান্ডায় জানালাটা খোলা! অন্যান্য দিন তো লাগানোই থাকে সন্ধ্যার পর মশা ঢোকে বলে।’ সুজিত হাত বাড়িয়ে লাগিয়ে দিল জানালাটা। সুজিত হঠাৎ খেয়াল করলো খাটের উপর অঞ্জনের ব্যাগ – বই – খাতাপত্র নেই, অথচ প্রতিদিনই অঞ্জনের প্রতিনিধি হয়ে সেগুলো সময় মতোই উপস্থিত থাকে। মোবাইলের বোতাম টিপে সুজিত দেখল, তার আসার পর থেকে আরও সতেরো মিনিট কেটে গেছে। সুজিতের বড্ড অস্বস্তি লাগলো, ‘ গেল কোথায় সব? কাকিমাও ফিরছে না কেন এখনো? অন্যান্য দিন এতক্ষণে কাকিমা তো চা দিয়ে দেয় আমায়; ঠাম্মাও গেল তা আসার নাম নেই এখনো! অঞ্জনেরও বলিহারি কান্ডজ্ঞান!’
দুর্যোগে অনেকটা পথ এসে ক্লান্ত ছিল সুজিত। তারউপর এখানের এই পরিস্থিতিতে বেজায় চটে গেল সে। রাগে, বিরক্তিতে সে ব্যাগটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়ালো। বারান্দায় আসার পর আরেকটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো সুজিতের। বারবার তার নাকে ভেসে আসতে লাগলো ধূপ আর ফুল মেশানো একটা উৎকট গন্ধ। এবার সুজিতের কেমন যেন একটু গা শিউরে উঠলো। সুজিত আর অপেক্ষা করলো না। সামনের সিঁড়ি থেকে নেমে এসে সাইকেলটা নিয়ে সোজা গেট থেকে বেরিয়ে সুজিত প্যাডেল ঘোরালো অঞ্জনদের ও – বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, ঠান্ডা বাতাসও বইছে। যেতে যেতে অঞ্জনের উদ্দেশ্যে সুজিত বললো, ‘ ব্যাটাকে আজ কড়া শাসানি দিতে হবে।’
অঞ্জনদের মূল ভিটে বাড়ির কাছে এসেও সুজিত দেখল বাড়িটা কেমন ফাঁকা – ফাঁকা। সামনে এগিয়ে এসে বাইরের দরজায় টর্চ ফেলতেই সুজিত দেখলো, দরজাটা ভিতর থেকে তালা বন্ধ। চোখ উঁচু করতেই সুজিত দেখল বাড়ির সামনের বারান্দায় অঞ্জনদের একজন প্রতিবেশী মহিলা তাঁর শিশু-সন্তানকে নিয়ে বসে আছেন। পাশে একটা টেমি – লন্ঠন জ্বলছে। মহিলার মুখ চেনা সুজিতের, তবে কথা হয়নি কোনোদিন। ঠাম্মার অসুস্থতার সময় অঞ্জনদের নতুন বাড়িতে তাঁকে অনেকবার দেখেছে সুজিত। সুজিত বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। সে সন্দিগ্ধ মনে ভাবলো – ‘আমি তো ঠিক জায়গাতেই এসছি, ইনি এখন এখানে…! কেন?’ এরপর সুজিত ঠাম্মার প্রসঙ্গটা তুলতে গিয়েও তুললো না; সেই মহিলার উদ্দেশ্যে সে শুধু বললো, ‘ অঞ্জন কই? পড়তে যাবে না ও? আমি তো অনেক্ষণ এসে অপেক্ষা করছি।’ সুজিতের প্রশ্ন করার পর মহিলার উত্তর দেওয়ার আগেই ঘরের ভিতর থেকে ভেসে এলো একটা পুরুষ কন্ঠস্বর – ‘ কে গো?’ কথাটা বলেই উত্তরের প্রত্যাশা না করে ভিতরের ঘর থেকে সামনের বারান্দায় এসে উপস্থিত হলেন মহিলাটির স্বামী। সুজিত একটু লজ্জিত হয়ে আবারও সন্দিগ্ধ মনে তাঁদের দুজনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘ আমি অঞ্জনকে ডাকতে এসছি…. আজ ওর পড়া আছে তো , তাই…’
সুজিতের কথা শুনে স্বামী- স্ত্রী পরস্পরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে, কিছুক্ষণ চুপ থেকে সুজিতকে বললো – ‘আপনি… জানেন না! ওরা কিছু বলেনি আপনাকে?’ সুজিত অবাক হয়ে বললো, ‘ কেন…? কি? কিছু কি সমস্যা হয়েছে?’
আবারও কিছুক্ষণ চুপ থেকে লোকটি বললো, ‘আজ দুপুরে অঞ্জনের ঠাম্মা মারা গেছেন। ওরা তো কলকাতায় গেছে দাহ করতে। আমাদেরকে এখানে থাকতে বলে গেছে। বিকেল থেকে তাই আমরা এখানে আছি।’
লোকটার কথা শোনার পর, ঠান্ডা রক্তের প্রবাহ বাঁধ ভাঙা স্রোতের মতো সুজিতের হৃৎপিন্ডে এসে আছড়ে পড়লো। তার সারা শরীরে যেন বাজ পড়লো। গায়ের রোম খাড়া হয়ে উঠলো। চারদিকের অন্ধকার যেন গোগ্রাসে গিলতে এলো তাকে। সে আর একটা কথাও না বলে বিদ্যুৎবেগে সাইকেল চালালো বাড়ির উদ্দেশ্যে। ঠান্ডা বাতাস সাঁ – সাঁ করে তার কান ঘেঁষে যেতে থাকলো; তার মনে হলো, কোনো বিকৃত স্বর তার কানের কাছে এসে প্রবলভাবে বিদ্রূপ করছে তাকে। চারিদিকের দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া আরও বিভীষিকাময় হয়ে উঠলো তার কাছে।
আর অল্প কিছুটা পথ, তারপরেই বাড়ি। সুজিতের সাথে তার সাইকেলটাও যেন হাঁপাচ্ছে। এমনসময় সুজিতের প্যান্টের পকেটে তার মোবাইলটা বেজে উঠলো। নিজের ফোনের পরিচিত রিং – টোনটা শুনেও তার বুকটা যেন ছ্যাঁৎ করে উঠলো। সে ভয়ার্ত মনে বললো, ‘বাজছে… বাজুক। একেবারে বাড়ি ঢুকেই ফোন দেখব।’ বলেই সে আরও জোরে প্যাডেল ঘোরালো।
একেবারে বাড়ির উঠোনে এসে সাইকেল থেকে নামলো সুজিত। প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখলো – ওয়ান মিসড্ কল-দেবুকাকা।
সে কলব্যাক করতেই ও – প্রান্ত থেকে দুঃখিত স্বরে ভেসে এলো – ‘ কিছু মনে কোরো না সুজিত। আসলে এতটাই ভারাক্রান্ত ও ব্যস্ত ছিলাম যে, তোমাকে বলা হয় নি। তুমি মনে হয় পড়াতে এসে ফিরে গেছ। দুপুরে মা মারা গেল। আমরা নিমতলায় এসেছি দাহ করতে।’ কথাগুলো শুনে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে সুজিতও দুঃখ ও সান্ত্বনার স্বরে বললো, ‘না- না…. ঠিক আছে কাকা, আমি কিছু মনে করিনি। তুমি ব্যস্ত হয়ো না, তোমরা ভালোভাবে কাজ মিটিয়ে বাড়ি এসো।এখন রাখছি তাহলে।’ আর কোনো কথা না বাড়িয়ে সুজিত কেটে দিল ফোনটা।
লেখক পরিচিত: – প্রসেনজিৎ মন্ডল