সোনার হরিণ | ছোট গল্প

0
1769
Photo: Sonar Tori - WordPress.com

১ম পর্ব,
ছোট গ্রাম সুখছড়ী। চট্টগ্রাম শহর থেকে ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে এই গ্রাম। আর এই গ্রামেই জন্ম
হয় সবুজ এর। সবুজ স্কুল ও কলেজ জীবন কাটে গ্রামেই। ছোট কালে বাবা মারা যাওয়া সবুজ পরিবার আর্থিক ভাবে সচ্ছল ছিল না। সবুজের মা অন্যদের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতেন। স্কুলে শিক্ষকরা সবুজকে বিনা খরচে পড়াতেন। ইস্কুলের সকল শিক্ষক তাকে নিজের ছেলের মতোদেখতেন। অবশ্যায় এর পেছনে একটা কারণ ছিল, আর সেই কারণটি হলো সবুজের ব্যবহার আর বুদ্ধীমত্তা। শুধু যে তার ব্যবহার ভালো তা নয় লেখা-পড়ায় ও সবুজ ছিলেন তুখোর। যেমন ভালো স্টুডেন্টস তেমন নম্র ভদ্র ব্যবহার সাধারণত কোন ছেলে করতে পারে বলে সন্দেহ আছে। শুধু যে শিক্ষকরা ভালোবাসতো তা নয় গ্রামের সবাই তাকে ভালোবাসতো। সকলের এই ভালোবাসা দেখে সবুজ আনমনে অনেক স্বপ্নের জাল বুনে। একদিন সে মানুষের মতো মানুষ হয়ে গ্রামের নাম উজ্জ্বল করবে। এই ভাবেই স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতে দিন যায় রাত যায়। এক সময় HSC পাস করে সবুজ গোল্ডেন A+ পায় সবুজ। কিন্তু সবুজ এখন কি করবে সে ভেবে পাচ্ছেনা! বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য শহরে থেকে কোচিং এর বেতন, থাকা,খাওয়া ইত্যাদি কিছুর খরচ বহন করার মতো আর্থক অবস্থা তার নেই। তবে কি তার সব স্বপ্ন মাঠে মারা যাবে?

 

২য় পর্ব,
এই সবুজ এই দিকে আয়। বজেন্দ্র জ্যাঠার ডাক শুনে সবুজ এগিয়ে যায়। বজেন্দ্র জ্যাঠা হলেন এই গ্রামের মুরব্বি। উনার ছেলে-মেয়ে, বউ সবাই শহরে থাকেন। একমাত্র উনি থাকেন গ্রামে। সবুজকে উনি খুব ভালোবাসেন কারণ সবুজের বাবা ছিলেন বজেন্দ্রবাবুর বাল্য বন্ধু আর তাছাড়া সবুজ ও ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিত।
—- সবুজ ভর্তি ফরম পূরণ করছিস?
— না জেঠামশাই পূরণ করতে পারিনি।
—কেন পূরণ করিস নাই কেন?
— জী মানে জেঠামশাই……
— ও বুঝতে পেরেছি আর জী মানে করতে হবেনা। আমি আছি তো, তুই আজকেই ফরম পূরণ করবি। পরেরটা আমি দেখব।
—- আজ্ঞে হে জেঠামশাই।
বজেন্দ্র বাবুর কথা শুনে সবুজের মনে
আশার সঞ্চার হলো। সে বাজারে গিয়ে অনলাইনে ভর্তি ফরম পূরণ করে আসলো।সবুজ জানে বজেন্দ্র বাবু চাইলে সব ব্যবস্থা করতে পারেন।

 

৩য় পর্ব,
আজকে সবুজ শহরে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম
ইউনিভার্সিটিতে ‘গ’ ইউনিটে ভর্তি হয়েছে সবুজ। সবুজের থাকা খাওয়ার সব ব্যবস্থা বজেন্দ্র জেঠাই করে দিয়েছেন। বজেন্দ্র জেঠার ৫তালা বিল্ডিং চকবাজারে আর সেখানেই থাকবে খাবে সবুজ। আর পড়া-লেখার খরচ ও কিছু কিছু দিবেন বজেন্দ্র বাদ বাকিটা যাতে সে সামলে নিতে পারে তার জন্য তাকে কিছু টিউশান ও ধরিয়ে দিয়েছেন জেঠামশাই এর ছেলে পার্থ দাদা। এখন অনেক সুখের স্বপ্ন দেখেছে সবুজ তার স্বপ্ন গুলো পূরণ হতে চলেছে। ভার্সিটি শেষ করে সে ভালো একটা চাকরী নেবে। এই ভেবেই দিন যায় মাস যায় বছর যায়।
একসময় মহিন ভর্সিটিতে ভালো রেজাল্ট করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্যে সেই সর্বাধিক নাম্বার পায়। রেজাল্ট এর পর সবুজ ভাবে এইবার তার স্বপ্ন পূরণ হতে চেলেছে।

 

৪র্থ পর্ব,
সবুজ এই পর্যন্ত ২০টার ও অধীক চাকরীর ইন্টারভিউ দিয়েছে। কিন্তু এতো ভালো নাম্বার থাকার পরেও সে টিকতে পারেনি। চাকরী হবে কি করে, সবুজের তো সেই সব নেই, যা অন্যদের আছে। সবুজের আছে শুধু সার্টিফিকেট মামা- চাচা কিছুই নেই। সবুজ এখন হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছে ভালো রেজাল্ট দিয়ে কিচ্ছু হয়না। যায় হয় তা শুধু টাকা আর রেফারেঞ্চ। সবুজ একবার ভাবলো বজেন্দ্র জেঠাকে বলবে কিন্তু পরক্ষনে ভাবলো বজেন্দ্র বাবুকে বলে লাভ নেই কারণ তিনি সবুজের জন্য এই পর্যন্ত অনেক কিছু করেছেন। সবুজ এইসব ভাবতে ভাবতে একটি অফিসের সামনে এসে দাড়াল আজকে তার এই
অফিসে ইন্টারভিউ দেওয়ার কথা। সবুজ ২য় তালায় উঠে অন্য পরিক্ষার্থীদের সাথে বসে পরলো। এক এক করে সবাই ভাইবা বোর্ডে চলে গেছে এখন সবুজের ডাক পরলো। সবুজ যথাবিহীত সম্মান জ্ঞীয়াপন করে বোর্ডে ডুকলেন। বোর্ড কর্মকর্তাদের দেখে সবুজ একটু ঘাবড়ে গেলেন এই কি এতো ফাহিদ! কিন্তু ফাহিদ তো SSC পাস করে কারিগরী শিক্ষা নিয়েছিল। সবুজ নিজেকে সমলে নিলেন। বোর্ড কর্মকর্তারা একে একে প্রশ্ন করলেন সবুজ সুন্দর ভাবে সবগুলো প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিলেন। কিন্তু সব শেষে যে প্রশ্নটা করলো তার কোন উত্তর দিতে পারলো না সবুজ কি উত্তর দেবে ৩লাক্ষ টাকা ঘুষ দেওয়া বা রেফারেঞ্চ দেওয়া তো সবুজের পক্ষে সম্ভব নয়।

 

৫ম পর্ব,
আজকের চাকরীটাও হলো না সবুজের। সবুজ অফিস থেকে বের হতে যাবে এমন সময় ফাহিদ ডাক দিলো
—এই সবুজ দাড়া।
—- জী বলেন স্যার।
—- এই সবুজ আমার সাথে ইয়ার্কি
মারছি? বেটা ফাজিল।
—কি করবো বলুন? আপনি তো এই অফিসের
একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তায় নয় কি?
—হুম বুজতে পারছে ফাজলামী করতে ভালো দক্ষতা অর্জন করেছিস। যাক আসল কথায় আসি, দোস্ত দেখ ওখানে ৩ লাক্ষের
কথা বলেছে। তুই একলাক্ষ মেনেজ করতে পারিস কিনে দেখ আমি সব ঠিক করে দিব
—–টাকা ছাড়া কি হয়না দোস্ত? তুই তো জানিস আমার অবস্থা।
—-নারে দোস্ত। টাকা ছাড়া কিছুই হবেনা। আমি ৫লাক্ষ দিয়ে ডুকেছি। আর দেখ আমি এখন বোর্ড মেম্বার।
— আচ্ছা দোস্ত দেখি টাকা জোগাড় করতে পারি কিনা। এই বলে সবুজ চলে এলেন। সবুজ জানে তার পক্ষে ১ লাক্ষ কি ৫০০০০ টাকা জোগাড় করাও সম্ভব নয়। এদিকে সে এই মাসে মাকে টাকা ও পাটাতে পারেনি।

 

৬ষ্ট পর্ব,
সবুজ বুঝতে পেরে গেছে ভালো চাকরী নামক সেই সোনার হরিণ সে স্বপ্নে যত সহজে ধরে ফেলতে পারত বাস্তবে সেটা অনেক দ্রুত গতিতে চলে। দোড় করে সেই সোনার হরিণ ধরা যায় না। তাকে ধরতে হলে তীর ধনুর প্রয়োজন যেটা সবুজের কাছে নেই। সবুজ বুঝতে পারছে সার্টিফিকেট এর মূল্য শুধু তাদের আছে, যাদের কাছে অর্থ আছে। অর্থ ছাড়া সার্টিফিকেট মূল্যহীন।

 

৭ম পর্ব,
বালিশের পাসে মোবাইলটা বেজেই চলেছে। সবুজ মোবাইল নিয়ে দেখলো রবিন এর ফোন।
…..হেল্লো রবিন এই সকালে ফোন দিলি যে কিছু বলবি?
….. হে দোস্ত, তুমি যত তারাতারি পারিস বাড়িতে চলে আয়। তোর মা এর খুব অসুখ। কালকে তোমার সাথে কথা বলার পর থেকে অসুস্থ হয়ে গেছে। আমি হাসপাতালে ভর্তি করেছি। তুই চলে আয়।
……….. দোস্ত মাকে একটু দেখে রাখ। আমি এখনি গাড়িতে উঠছি।

রবিন এর কল কেটে সবুজ নতুনব্রীজ থেকে গাড়িতে উঠে পড়ল। গাড়ি চলেছে তার আপন গতিতে কিন্তু রবিন এর মন চলে গেছে বাড়িতে মায়ের কাছে। সবুজের বুক ফেটে কান্নাঁ আসছে। সে বুঝতে পারছে তার মায়ের শরীর খারাপ হয়েছে অনেক আগে কিন্তু সবুজকে বলেনি কারণ সবুজ যে টিউশানের টাকায় চলতে হিমসিম খাচ্ছে সেটা সবুজের মা খুব ভালো করে বুঝতে পারে।

 

৮ম পর্ব,
সবুজের মা মারা গেছে আজকে ১ মাস হতে চলেছে। সবুজ পাগল প্রায় হয়ে গেছে। সারাক্ষণ কাদঁছে আর চিৎকার করে বলছে হে ঈশ্বর তুমি তোমার আমার কিছুই রাখলেনা। আমার ভাই নেই,বোন নেই বাবা নেই সহায় সম্পত্তি, চাকরী অর্থ কিছুই নেই কিন্তু আমি তো তোমার কাছে কখনো কোন অভিযোগ করিনি। তুমি আমার মাকে কেনো কেড়েঁ নিলে? আমি কি পাপ করেছিলাম?
সবুজ আজ কাদেঁ আর সবাইকে বলে লেখা-পড়া করিসনা, সর্টিফিকেট এর কোন মূল্য নেই। সবাইকে এই কথা বলে আর কাদেঁ। সবুজের এই রকম অবস্থা দেখে পুরো গ্রাম কাদঁছে আজ। সবুজের এই পাগল অবস্থা সবাইকে মর্মাহত করে দিচ্ছে। সকলের এখন একটি কামনা সবুজ আবার সাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক।

 

লেখক:- কাঞ্চন চক্রবর্তী(স্বাধীন)
পরিচিতি:-লেখক কাঞ্চন চক্রবর্তী চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া থানার সুখছড়ী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।১৯৯৬ সালে ১২ই জুন .

SOURCEKanchan Chakroborty
Previous articleস্মৃতির দাম
Next articleলেখায়
Avatar
Disclaimer: Monomousumi is not responsible for any wrong facts presented in the articles by the authors. The opinion, facts, grammatical issues or issues related sentence framing etc. are personal to the respective authors. We have not edited the article. All attempts were taken to prohibit copyright infringement, plagiarism and wrong information. We are strongly against copyright violation. In case of any copyright infringement issues, please write to us. লেখার মন্তব্য এবং ভাবনা, লেখকের নিজস্ব - কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত..................

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here