Photo: iThemes
আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী আজ। রহস্যময় মানুষটার সাথে পথচলার এক বছর পূর্ণ হলো। যা বুঝেছি এসব দিবস-টিবস নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই ওর। চাকরির সুবাদে দু’জন দু’জায়গায় থাকি, দেখা হয় সপ্তাহান্তে। এক সপ্তাহে ও খুলনা থেকে বগুড়ায় আসে, পরের সপ্তাহে আমি বগুড়া থেকে খুলনা যাই। অন্যসব দায়দায়িত্বে সমানে সমানে হলেও
যাওয়া-আসা আর আসা-যাওয়াতে অবশ্য আমরা বৈষম্য রক্ষা করি। আমিই বেশি যাই, ওর বাংলোটা আমার ভীষণ রকম পছন্দের। আব্বা-আম্মা মানে আমার শশুর-শাশুড়ি ওর সাথেই থাকেন। ঘর-গৃহস্থালী, জমি-জমা দেখাশোনার জন্য তাদেরকে মাঝেমাঝে গ্রামে যেতে হয়। তখন আমি ছুটি নিয়ে ওর কাছে চলে যাই, বাইরের খাবার একদমই খেতে পারে না ও।
নতুন ধান উঠতে শুরু করেছে, শশুর-শাশুড়ি তাই গ্রামের বাড়িতে। শীতের আমেজও টের পাওয়া যাচ্ছে ভালোই। পরশু রাতে ফোনে কথা হলো ওর সাথে। এ সপ্তাহে ও ঢাকায় ট্রেনিংয়ে থাকায় খুব কমই কথা হয়েছে। বললো ট্রেনিং শেষে বৃহস্পতিবার বিকেলের ট্রেনে গ্রামের বাড়িতে যাবে। মনে মনে আমিও প্ল্যান করে ফেললাম।
বেসরকারি চাকরি করি, ছুটি পেতে নানা রকম ঝাক্কিঝামেলা সহ্য করতে হয়। তবুও একদিন ছুটি নিয়েছি, শুক্রবার হওয়ায় পরপর দুইদিন ছুটি। আসলে চাকরিটা আমি নিজের ইচ্ছাতেই করি। একজন সৎ কর্মকর্তা হিসেবে ওর মনের ভিতটা মজবুত হলেও ঐ বেতনে শেষমেশ একতলার ভিত্তিপ্রস্তরও যে স্থাপন সম্ভব হবেনা সেটা সম্বন্ধে দুজনেই ওয়াকিবহাল। তাই আমার বেতনের পুরোটাই সেভিংস অ্যাকাউন্টে রাখি। আর খরচাপাতি হয় ওর পয়সায়! ওর স্বপ্ন হচ্ছে শেষমেশ গ্রামে থিতু হবার। গ্রামের মানুষজন যখন প্রবল উৎসাহ-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে শহরে ছুটছে, ঠিক তখন এই মানুষটা হাঁটছে স্রোতের বিপরীতে। অবশ্য ওর যুক্তি আর ইচ্ছাকে আমি দমাতে পারিনি। সত্যি বলতে কী দমানোর চেষ্টাও করিনি।
ওর আগেই আমি পৌঁছে গেলাম বাড়িতে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। প্রায় তিনমাস পর এখানে আসা। তবুও ঘরদোর সব ঝকঝকে, তকতকে। আব্বা-আম্মা দুজনেই খুব খুঁতখুঁতে, সবকিছুই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে পছন্দ করেন। ছোট্ট বাড়ি, চারটা রুম। টিনের চাল হলে কী হবে ছোটখাটো বিলাসিতার কোন কমতি নেই এখানে! কলিংবেল, ডোরবেল, ফুলের বাগান থেকে শুরু করে চমৎকার ওয়াল পেইন্টিং সবই আছে।
ভীষণ ক্লান্তি অনুভব হচ্ছে। যদিও ঘরোয়া উৎসবের আমেজের কাছে এই ক্লান্তি নিতান্তই নস্যি। আমাদের বিবাহবার্ষিকীর কথা আম্মা-আব্বাও মনে রেখেছেন! পুকুর থেকে বড় মাছ ধরা হয়েছে, অর্ডার দিয়ে স্পেশাল দই-মিষ্টি আনিয়েছেন আব্বা, উঠোনের চুলায় পিঠাপুলি তৈরির আয়োজন চলছে। এদিকে ফোনে চার্জ না থাকায় অফ হয়ে গিয়েছে। ফোনটা চার্জে দিয়ে আমি ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে অপেক্ষা করছি কখন কলিংবেলটা বাজবে। কলিংবেল বাজানোর বিশেষ একটা স্টাইল আছে ওর। সুইচ চেপে দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখে, ও আসলেই আমি বুঝতে পারি!
মাগরিবের আযান হচ্ছে, দূর আকাশে দেখছি পাখিরা সব নীড়ে ফিরছে। কেন জানি এখন ওর সাথে কথা বলতে লজ্জা করছে। সারাদিনে মাত্র তিনবার কথা হয়েছে আজ। আসতে দেরি দেখে ফোন দিতে চাইলাম। তখনই আম্মা বারান্দায় এসে উনার ফোনটা এগিয়ে দিলেন কথা বলার জন্য। সেই চেনা স্বর! জানালো অনেকবার ট্রাই করেছে আমার ফোনে, পরে আম্মাকে ফোন দিয়েছে। ওর পরের কথাতেই আমার মনটা ভেঙে গেল। বিশেষ কারণে ট্রেনিং এর সময়সীমা দুইদিন বাড়ানো হয়েছে এবং ট্রেইনার হিসেবে তাকে থাকতেই হবে আজ। এত ব্যস্ততার ভীড়ে ওর কী মনে আছে বিশেষ দিনটার কথা?
এমন ঘটনা এটাই প্রথম নয়। তিনমাস আগেও ওর জন্মদিনে আমাদের অনেক পরিকল্পনা ছিলো, আম্মা নিজ হাতে চমৎকার একটা কেক বানিয়েছিলেন। তখনো আসতে পারেনি ও। আমার ধারণা ইচ্ছে করেই তখন আসেনি। যদিও আজকের বিষয়টা ভিন্ন। বিষয়টা পরিষ্কার হবে আগামি মাসে আমার জন্মদিনে!
বিষণ্ণ মনে রাতের খাবার শেষ করলাম। ফেসবুকে একটু ঢুঁ দিলাম। ও নিজের আইডিতে তেমন সক্রিয় নয়, দাপ্তরিক আইডিতে প্রোগ্রাম-টোগ্রামের আপডেট দেয়। আমিই মাঝেমধ্যে বিভিন্ন পোস্ট, ছবিতে ওকে ট্যাগ দিই। দেখলাম ও মেসেঞ্জারে অ্যাক্টিভ নেই। ফোন মেসেজে টাইপ করলাম,”রাতে কী একটু বেশি কথা বলা যাবে আজ?”। সেন্ড না করেই কেটে দিলাম। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে বেচারা একটু বিশ্রাম নেবে সেখানে হস্তক্ষেপ করা মোটেই ঠিক হবে না।
আমাদের রুমটা একটা ছোটখাটো লাইব্রেরি তবুও কেন জানি ফাঁকাফাঁকা লাগছিলো। আম্মা তার সাথে ঘুমাতে বলেছিলেন, আমি আমাদের রুমেই শুয়ে থাকলাম। ঘুম আসছে না অথচ রাজ্যের ক্লান্তি ভর করছে। পশ্চিম দিকের বইয়ের তাকে থাকা একটা সবুজ মলাটের বইয়ে আমার চোখ আটকে গেল। খুলে দেখি সেটা বই নয়, ওর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুর দিকের ডায়েরি। আমি স্কুল, কলেজে ডায়েরি লিখতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে আর লিখিনি।
বেশ খানিকটা কৌতূহল আর ভয়ভয় মন নিয়েই পেইজ উল্টানো শুরু করলাম। ব্যক্তিগত গল্পের চেয়েও জীবনের গল্প সেখানে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে, যে কারো সে গল্পে প্রবেশাধিকার রয়েছে। মেয়েদের ইমোশন নাকি অনেক বেশি হয়, আমার ক্ষেত্রে সেটা ঠিক নয়। তবুও ডায়েরিটা পড়ে স্বল্পভাষী, নিভৃতচারী এই মানুষটা সম্পর্কে অনেক অজানা কিছু জানতে পেরেছি, আটকে রাখতে পারিনি ইমোশনকে।
আমাদের রুমে খাটের সঙ্গে যে জানালা তার ওপাশেই একটা বড় আমগাছ আর ল্যাম্পপোস্ট। রাতে যখন গাছের পাতাগুলো নড়ে ওঠে তখন ল্যাম্পপোস্টের আলোতে অদ্ভুতরকম প্রতিবিম্ব তৈরি হয়। আর শেয়াল-কুকুরের ডাক তো আছেই! আধাভৌতিক
এ বাড়িতে আসলে আমি সাধারণত জানালার পাশে ঘুমাই না, ও ই ঘুমায়। আর জেগে থাকা সময়ে মাঝেমধ্যে ওকে ডাকলে ‘হ্যাঁ’, ‘হুম’ করে পাশফিরে শোয়।
বারবার ফোনটা হাতে নিয়ে রেখে দিচ্ছি, ভীষণ পরিচিত নম্বরটা টাইপ করে মুছে ফেলছি বারবার, ফোন দেবার সাহস হচ্ছে না। দরজা চাপিয়ে দিয়ে বিছানায় চুপচাপ শুয়ে আছি। ভাবছি, মানুষটার কথা,আমার কথা, আমাদের কথা…।
তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি কখন বুঝতে পারিনি। ফজরের আযানের সময় ঘুম ভেঙে গেল। আম্মাও উঠে পড়েছেন। হালকা কুয়াশা পড়ছে। আমগাছের পাতায় কুয়াশা ফোঁটা ফোঁটা হয়ে আছড়ে পড়ছে টিনের চালায়। আম্মাকে বলে আমি বাইরে বের হলাম একটু হাঁটাহাটি করতে। আম্মা তার গায়ের চাদরটা আমার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে দিলেন।
বাড়ির পাশের রাস্তাটা সদর রাস্তা থেকে শুরু হয়ে একদম মাঠে গিয়ে মিশেছে। দেখছি কর্মব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে, কৃষকরা মাঠপানে ছুটছে। আমি কিছুদূর সামনে গিয়ে আবার বাড়ির দিকে হাঁটছি। হঠাৎ পেছন থেকে পরিচিত স্বরে কেউ একজন ডাকলো, স্বপ্নের মতো মনে হলেও আবছা কুয়াশা ভেদ করে মানুষটাকে চিনে নিতে কোন কষ্টই হলো না। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল ও আসবে যেভাবেই হোক। সহযোগী ট্রেইনার জয়েন করায় ঊর্ধতন স্যারকে ম্যানেজ করেই রাতের ট্রেনে চেপে বসেছে।
আমার হাতে একটা প্যাকেট এবং একটা বড়সড় খামহীন চিঠি ধরিয়ে দিয়ে সবিস্তারে বললো সে কাহিনী। প্যাকেটে ছিলো আমার জন্য চমৎকার একটা সারপ্রাইজ, আমার ভীষণ পছন্দের একটা বস্তু। কী ছিলো সেটা না হয় পরে বলবো, ওর এরকম আগমনই যে সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ ছিলো সেটা কী ও জানে?
ট্রেনে আসার সময় ওর ফোনটা চুরি হয়ে গেছে। আমি মনে মনে ভাবলাম, রাতে ফোন দিয়ে ওকে না পেলে মনে মনে কত কষ্টই না পেতাম! ভাবতাম, কাটখোট্টা মানুষটা এমন দিনেও ফোন অফ করে ঘুমায়। আহা বেচারা! যাইহোক ওর সম্পর্কে আরো খানিকটা জানতে আমার জন্মদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতেও হলো না। ততক্ষণে আম্মা-আব্বাও বাড়ির বাইরে রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমরা হেঁটে হেঁটে এগোচ্ছি…বহুদূরের পথে…।
লেখক পরিচিতি : মোঃ জুবায়ের ইবনে কামাল (স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী,বয়স ২৩ বছর, বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখি-জীবনের গান গাই) . ৩৪২/ এফ, শহীদ নাজমুল আহসান হল, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ।Warning: Attempt to read property "roles" on bool in /home3/weavesdi/public_html/www.monomousumi.com/bengali/wp-content/themes/morenews/inc/template-functions.php on line 941