কে প্রতিবন্ধী!!

9
3433

দিবস উদযাপনের ভীড়ে আজ সকালে নেট অন করতেই মৌলির নজরে পড়ে সায়ন্তনীর প্রতিবন্ধী দিবস নিয়ে একটা সুন্দর পোস্ট। একটা মানসিক প্রতিবন্ধী স্কুলের ছেলেমেয়েরা কি সুন্দর কাগজ কেটে হাতের কাজ বানাচ্ছে ।বাসে সিট না পেয়ে হেলান দিয়ে মোবাইলে পোস্ট টা দেখছিল হটাৎ পশ্চাতে জোর ধাক্কা ! সিট না থাকলেও দাঁড়ানোর অফুরন্ত জায়গা তাই ফাঁকা বাসটার এক সাইডে দাঁড়িয়ে মৌলি,কাঁধে দুটো ব্যাগ ।

নার্সিংহোম থেকে মা’কে আজ ছুটি দেবেন বলে কাল রাতেই, ডক্টর মুখার্জির ফোন।ইচ্ছে ছিলো মেয়েকে স্কুল পাঠিয়ে ধীরে সুস্থে সকাল করেই নার্সিংহোম পৌঁছাবে মৌলি। এই উদ্দেশ্যে স্বামী রথিন কে অফিস ক্যান্টিনে খেয়ে নেবার কথা বলতেই,এমন বিশ্রী ভাবে তেলে বেগুনে জ্বলে কিছু বাজে কথা শুনিয়ে দিলো যে মন টাই খিঁচড়ে গেল!কি সব রথিনের কথা ,”ভাইতো দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে অস্ট্রেলিয়াতে থাকে,আর তোমাকেই এত দায়িত্ব নিতে হবে কেন” শুনে খুব রাগ হয়ে গেছিলো মৌলির। বাবার মৃত্যুর পর,ওই বড়ো বাড়িতে মা একই থাকে,পাছে মেয়ের ওপর চাপ পড়ে যায় কিন্তু তাবলে হটাৎ অসুস্থ হওয়া মা কে, মেয়ে যদি একটু খেয়াল না নিলো বিপদে আপদে তবে আর মা মেয়ের কিসের সম্পর্ক!

যাই হোক ভেবেছিল জলদি নার্সিংহোম থেকে মাকে বাড়ি ফিরিয়ে ,মেয়েকে স্কুল বাস থেকে নামিয়ে,যাহোক ভাত ডাল ফুটিয়ে নেবে দুপুরের।সেটা যখন হলো না,উল্টে আপন জনের কাছ থেকে অপবাদ জুটলো। এগুলো ভাবতে ভাবতে এক বুক কষ্ট নিয়ে, মোবাইলটা দেখছিল মৌলি। অমনি হিরো গোছের এক নওজোয়ান ইচ্ছাকৃতভাবেই ধাক্কা দিয়ে চলে গেল পেছন টায়!

ইচ্ছাকৃত শব্দটা এই কারণেই ব্যবহার করা হলো কারণ ভিড় হোক আর ফাঁকা বাস,রাস্তা ঘাট ভর্তি বা খালি, সুযোগ সন্ধানী কিছু পুরুষদের ছুঁক ছুঁক হাত যেন মহিলাদের শরীর ,বিশেষ বিশেষ অংশে স্পর্শ করার একটা প্রবণতায় আজও ঘুরে বেড়ায়। মেয়ে দেখলেই যেন লক লক করে ওঠে তাদের কামনা,বাসনার আগুন। অন্য সময় হলে হয়তো মৌলি জোর চিৎকার করে প্রতিবাদ করতো কিন্তু মৌলি দেখেছে ইতিমধ্যে যারা বিষয়টা জানতো না তারাও টের পেয়ে হয় মুখ টিপে হাসবে ,কেউ কেউ কল্পনায় শরীরী মাপ নেবার খেলায় আনন্দ পাবে।

মিনিবাসটা ততক্ষনে শ্যামবাজার পেরিয়ে ধীরগতিতে চলছে ।প্রতিবন্ধী সিটে,কানে হেডফোন গুঁজে এক যুবক ঘুমিয়ে পড়েছে বা গানের মাধুর্যতা উপলব্ধি করছে বোঝা গেল না!একজন প্রতিবন্ধি খোঁড়া ছেলে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সামনে।দুবার বলার পড়ো সিট আঁকড়ে ধরা থাকা নবাব পুত্তুরের বিরক্ত মুখে উঠে দাঁড়ানো দেখলো সবাই।

কন্ডাক্টরের মাঝে মাঝে হাঁক ছেড়ে “ভেতরে চলুন, খালি আছে পেছনটা”বলার স্বগোক্তি কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ,গেটের মুখে ছেলে-ছোকরারা ভিড় করেছে,সামনের স্টপেজে কলেজ ছাত্র-ছাত্রীদের উঠানামায় দুর্দান্ত শরীর স্পর্শের সুযোগ!মৌলি দেখেছে কখনো কেমন কিছু ছেলে এমন পরিবেশে অসম্ভব অমায়িক হয়ে সাইড দেয় কিন্তু ভিড়ের মাঝে ঝোপ বুঝে কোপ মারতেও কেউ কেউ সিদ্ধ হস্ত।

কলেজে পড়ার সময় একবার অনিন্দিতা আর মৌলি পরীক্ষা দিতে বর্ধমান গিয়েছিল কোন এক ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ভিড় ঠাসা ট্রেনে।ভেতরে জায়গা না পেয়ে,কোন রকমে বাথরুমের সামনে দুজনা দাঁড়ালেও কিছু ছেলের ধাক্কাধাক্কি তে আলাদা হয়ে পড়ে।ট্রেন থেকে নেমে অনিন্দিতার হাউ হাউ সে কান্না এখনো কানে বাজে মৌলির। দুজন ছেলে এতই ডেসপারেট ছিল,যে ভিড়ে ওর জামার ভেতর হাত ভরে শ্লীলতাহানি করে প্রকাশ্যে।

ততক্ষনে বাসটা জ্যাম ছাড়িয়ে ভিড়ের মধ্যে এগিয়ে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলছে।ভিড় টা আবার বেড়েছে।এক মধ্য বয়সী কাকু অন্যমনস্ক হয়েও কনুই টা উঁচু করে এমন ভাবে রেখেছে মৌলি দূর থেকে দেখছে,পাশে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া স্কুল ছাত্রী টি বারংবার অস্বস্তিতে পড়ছে।

পাশের সিটটা খালি হতেই কিশোরী মেয়েটিকে হেঁকে ডাক দিয়ে বসতে সুযোগ দিলে পাশের ভদ্রলোকটি মনে হয় কিছু বার্তা পেলেন।কথায় আছে কেউ অন্যায় সুযোগ নিচ্ছে সেটা অন্যজন যদি বুঝে যায় ,খুব অপ্রস্তুত পরিস্থিতিতে পড়ে যায় সুযোগ নেওয়া ব্যক্তি।আর এটা তো ওনার চরমতম ঘৃণ্য অপরাধ,ওনার মেয়ের থেকে ছোট বয়সী মেয়েকে রীতিমতো বিরক্ত করা! কি শিক্ষা পাবে এই বাচ্ছারা,কি করে অপরিচিত বড়দের প্রতি এদের শ্রদ্ধা আসবে ভেবে পায় না মৌলি। তখনও অবশ্য লোকটি অপছন্দের মুখ নিয়ে মৌলিকে দুচার বার দেখেই চলেছে,কে জানে মৌলির সুন্দর গড়ন দেখে উনি কল্পনার স্রোতে সুখ ভেলা বইয়ে দিয়েছেন কিনা ততক্ষনে।

নার্সিংহোম থেকে আর একবার ফোন আসতেই হ্যা এখুনি যাচ্ছি বলে বারংবার ঘড়ি দেখছে মৌলি।আবার বাস টা জ্যামে ফেঁসেছে দেখে বিরক্তি হলেও কিছু করার নেই।মা কে নিয়ে অমন বাঁকা মন্তব্যের পর রথীন কে বলতে ইচ্ছে হয় নি গাড়িটা নিয়ে বেরুবো।কিন্তু খুব আশা করেছিল অন্তত রথীন নিজে থেকে বলবে মৌলি কে। কিন্তু না ,কিছুই রা কাটে নি ।কোন ভোর থেকে উঠে নিজের অমন প্রতিবন্ধী মেয়েকে রেডি করে স্কুল পাঠিয়ে,রথিনের রান্না,টিফিন করে তবে ফুরসৎ পেয়ে মৌলি বাসে করে নার্সিংহোম যাচ্ছে,মাঝে মাঝে মনে হয়,সংসার চালনা করা কি কেবল বাড়ির মহিলাদের দায়,অথচ সামান্য এদিক ওদিক হলেই মুখ বেজার।নেহাত মা কে আনতে যাওয়া,তাই আর কথা বাড়ায় নি সকালে,না হলে হয়তো আর এক হাত ঝগড়া হয়েই যেত রথিনের সাথে।

নার্সিংহোমে হন্ত দন্ত ভাবে পৌঁছাতেই মায়ের অপেক্ষরত অসহায় মুখ যেন মৌলির জন্যই।খুব খারাপ লাগলেও কিছু তো করার নেই,অথচ রথীন কিন্তু দিব্যি আসতে পারতো,একটু অন্তত মনোবল পেতো মৌলি।দুজন কে বলে কয়ে স্ট্রেচার জোগাড় করে বিল সেকশনে গিয়ে বিল মিটিয়ে মায়ের কাছে আসতেই আবার এক বিশ্রী ভাবে পুরুষ লোলুপতার নজির দেখতেই মাথাটা হটাৎ যেন গরম হয়ে গেল।স্ট্রেচারে অসুস্থ মা শুয়ে,গায়ের চাদর টা খানিক টা ফর্সা পা থেকে বেখেয়ালে সরে গেছে আর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ড্রাইভারটা খৈনি ডলতে ডলতে হাঁ করে,যেন গিলে খেতে চাইছে। কি যে পরিবেশ রেখে যাচ্ছি আমরা ছোট বাচ্ছা আজকের ছাত্রছাত্রীদের সামনে,ভাবতে ভাবতে গাড়ি বুক করে মায়ের শুকনো মুখটা দেখে একটু ঝেড়ে মেরে উঠলো মৌলি।মায়ের মাথায় সযত্নে হাত বুলিয়ে প্রেসক্রিপশন গুলো ভালো করে বুঝে নিলো গাড়িতে।ফেরার পথে প্রতিবন্ধী দিবসের রেলি তে কিছু প্রতিবন্ধী ছাত্র ছাত্রীর নিষ্পাপ উদাস চাহনি দেখতে দেখতে খুব মন উচাটন হয়ে গেল।ফেরার পথে মেয়ের স্কুলে মেয়েকে ছুটির পর নিয়ে বাড়ি মুখো।নাতনি কে সামনে পেয়ে দিদার চোখ আনন্দে চক চক করে উঠলো।মৌলি তার মানসিক প্রতিবন্ধী আদরের কন্যাকে আদরে জড়িয়ে ভাবতে লাগলো,এরাই হয়তো প্রকৃত সুস্থ,কারুর ক্ষতি সাধন করে না আর চারদিকে সুস্থ, সবল মানুষ গুলোর মানসিক অসুস্থতা দেখে সত্যিই প্রশ্ন ওঠে,কে আসল প্রতিবন্ধী!

 

লেখক পরিচিতি :রাণা চ্যাটার্জী, বিবেকানন্দ কলেজ মোড়,বড় বালি ডাঙা,পোস্ট-শ্রী পল্লী,বর্ধমান(পূর্ব) .
ছোটবেলা থেকেই কবিতা,ছড়া, সৃজনশীলতার ওপর আত্মিক টান বর্ধমান শহর নিবাসী রাণা চ্যাটার্জীর।প্রতিভা,সারল্যের মেলবন্ধন ও অনুভূতিপ্রবণতায় অবিরাম সৃষ্টি করে চলেছেন কবিতা,ছোটগল্প,বাচ্ছাদের জন্য ছড়া, নিবন্ধ,কার্টুন। নক্ষত্রানি সম্মান,কবির “মেঘ বালিকা তোমায়”,”ছন্দ ছড়ায় জীবন” কাব্যগ্রন্থ ও নিয়মিত পত্র পত্রিকায় লেখা প্রকাশ রাণা চ্যাটার্জী’র আগামী উজ্জ্বল করুক।

 

বিঃ দ্রঃ লেখাটি মন_ও_মৌসুমী র #ত্রিমাসিক_লেখা_প্রতিযোগিতার (জানুয়ারি ,২০১৯) এর একটি Entry .
ফলপ্রকাশ জানুয়ারি ,২০১৯ এর দ্বিতীয় সপ্তাহ , পড়তে থাকুন -যোগাযোগ বজায় রাখুন #মন_ও_মৌসুমী র ওয়েবসাইট এর সাথে।

9 COMMENTS

  1. একদম বাস্তব চিত্র লেখাটায় ফুটে উঠেছে।

  2. প্রতিবন্ধী আমাদের সমাজের সুস্থ শিক্ষিত কিছু ভূ্দ্রবেশী মুখোশ পরা কিছু শ্রেণী। মুখোশের আড়ালে যাদের রয়েছে একটা নোংরা কামুক মন, যা নিজের মেয়ের বয়সী মেয়েদেরকেও নিজেদের লোলুপতার আকাঙ্খা থেকে বাদ দিতে পারেনা। এরা কি মানুষিক ভাবে সুস্থ? আমার তো মনে এদেরেই সবচেয়ে আগে মনোবিদদের পরামর্শ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।

  3. অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও জীব-বাস্তবতায়
    পূর্ণ কাহিনী।

  4. পড়লাম
    আজ কাল মানুষের মুখে মুখোশ, বেশিরভাগই মানসিক প্রতিবন্ধী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here