শনিবারের_স্বপ্ন

0
1471
Photo :EvanYolo

হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল, আজকে আবার! কি যে এক স্বপ্ন আসে! প্রতিবার ভয় ঘুম ভেঙে যায়। সারা গা ঘামে ভিজে যায়। প্রায় প্রতি শনিবার রাতেই এটা হচ্ছে, বেশ কিছুদিন হলো। এখন উইকেন্ড এলেই একটা ভয় লাগে। চাকরি সূত্রে এই ক’বছরে কতরকম বীভৎস ঘটনা তো দেখা হলো, কিন্তু এই ছোটবেলার স্বপ্নটাই কেন বার বার ফিরে ফিরে আসে কে জানে? মনোবিদ, মনরোগ বিশেষজ্ঞ, সব দেখানো হয়েছে, কেউ কোনো সুরাহা করতে পারেনি এখনো অবধি। তবু শেষবার যাকে দেখানো হলো তিনি বললেন, “আপনার মনের যা কিছু স্মৃতি আছে এব্যাপারে তা লিখে ফেলুন। হয়তো প্রকাশ করতে পারছেননা বলেই ভেতরে ভেতরে ভয়টা রয়ে যাচ্ছে।” তাই এই কলম ধরা।

আমি দুর্গা, দুর্গা সিংহ। চাকরি করি দিল্লিতে সরকারের একটা গোপন তদন্তকারী ডিপার্টমেন্টে। নিন্দুকদের মুখে ছাই দিয়ে এই তিরিশ বছরেও বিয়ে থা করা হয়ে ওঠেনি। ভেবেছিলাম এয়ারফোর্স পাইলট হব, কিন্তু চোখের সামান্য সমস্যার জন্য হলো না, শেষে আইপিএস পাস করে প্রথমে পুলিশে তারপর এই বিভাগে আসি।

আমার নামটা অদ্ভুত তাই না? না না, দুর্গা আমার আসল নাম ছিল না, অবশ্য সিংহ আমাদের পারিবারিক পদবী, যদিও লেখা হয় সিন্হা। আমি সিংহই লিখি, কারন বাবা আদর করে আমায় সিংহী ডাকেন, কেন জানেন? আমার ছোট বেলায় নাম ছিল ডলি, কারন আমার মুখটা নাকি পুতুলের মত দেখতে। কিন্তু গায়ের রঙ চাপা বলে সবাই আমায় মজা করে ডলির সাথে মিলিয়ে কালি বলতো, আমার মোটেই ভালো লাগতো না। অবশ্য আরেকটা কারণেও এই নাম হয়েছিল। আমি ছিলাম চরম ডানপিটে, মানে যেমন ডানপিটে হতে ছেলেরাও ভয় পাবে। আমাদের ঐখানে আমার থেকে বেশি ডানপিটে কোনো মেয়ে তো দূরের কথা ছেলেও ছিল না।

আমার ডানপিটে গিরির অসংখ্য গল্প আছে। ছাদে বা গাছে ওঠা বা ছেলেদের সাথে ক্রিকেট, ফুটবল, ডাংগুলি বা কাবাডি খেলা তো কিছুই নয়, আমি বাজি ফেলে মাথায় টিউবলাইট ফাটাতাম, ব্লেড দিয়ে নিজের হাত নিজেই কাটতাম। ক্লাস এইট নাইনেই বাবার মোটরসাইকেল চালাতে শিখে গেছিলাম। গয়না গাটি আমার একদম পছন্দ ছিল না, খুব ছোটবেলায় করা কানের ফুটো তাই বন্ধ হয়ে যায়। মায়ের তাড়নায় শেষে একবার বিরক্ত হয়ে নিজেই নিজের দুকান, ছুঁচ দিয়ে ফুটো করে দিলাম। মোটামুটি সাত থেকে আটবার বিভিন্ন ভাবে মাথা ফাটিয়েছি, তারপর কেউ সাথে থাকুক না থাকুক, নিজেই একহাতে মাথায় হাত দিয়ে আরেক হাতে সাইকেল চালিয়ে মেডিক্যাল সেন্টারে, ডাক্তারকাকুদের চেম্বারে পৌঁছে যেতাম, সেলাই টেলাই করিয়ে ঘরে ফেরার পর মায়ের কাছে আরেক প্রস্ত পিটুনি খেতাম। সাধারণ কাটাছেঁড়া আমি পাত্তা দিতাম না ঠিকই, কিন্তু মাসে দুমাসে একবার অন্তত বড়সড় একটা কিছুর জন্য আমাকে ডাক্তারখানায় যেতেই হত। পরপর দুতিনমাস না গেলে ডাক্তার কাকুরা বাবার কাছে খোঁজ নিতেন আমার ব্যাপারে। এই কারনেই আমাকে সবাই মা কালি বলত, পরে তা ডলির সাথে মিলিয়ে শুধু কালি হয়ে যায়। আমার ভীষণ রাগ হত, তাই স্কুল ফাইনালের সময় বাবা আমার নামটা বদলে দুর্গা করে দেন। সেই থেকেই আমি দুর্গা সিংহ লিখি। আসলে বাবা বলেন আমাদের সিংহ পরিবারে আমিই নাকি একমাত্র সিংহী।

লেখাপড়ায় মোটামুটি ছিলাম, যদিও দাদা অনেক ভালো ছিলো, কিন্তু দাদার মত আমি পরীক্ষা টরীক্ষায় ঘাবড়াতাম না। আমাকে শান্ত করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিল মা। গান আর নাচের স্কুলে দিয়েছিল, ভালো করতামও, কিন্তু আমায় টেনেছিলো অভিনয়। বাবা একটা গ্রূপে থিয়েটারের সাথে খুব অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিলেন, সেই সূত্রেই আমার এই ভালো লাগা। শুভর সাথে এই একজায়গাতেই আমার একমাত্র মিল ছিল। বাবাদের গ্রুপে একটা ছোটদের বিভাগ ছিল, তাতে আমরা দুজনেই নিয়মিত অভিনয় করতাম। শুভ খুব ভালো নাচতেও পারতো।

চমকে উঠলেন না? হটাৎ কোথা থেকে শুভ এলো? আসলে ছোটবেলায় আমার খেলার সাথী ছিল এই শুভ। থাকত আমাদের পাশের বাড়িতেই। একতলা সরকারি কোয়ার্টার যেমন হয়, আমার ঘর আর ওর ঘরের জানালা ছিল মুখোমুখি। আসলে এই বাড়িটা ভীষন ভাবে আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে। আমার প্ৰথম বাইশটা বছর এই বাড়ীতে আমরা কাটিয়েছি। যে টুকু সময় ঘরে থাকতাম তার বেশিরভাগ সময়ই এই বাড়ির পাঁচিল আর ছাদেই আমার অবসর কেটেছে। ছোট থেকেই আমি আর দাদা যে ঘরে থাকতাম তার উল্টো দিকের ঘরেই শুভ থাকত। দাদা আমার থেকে প্রায় দশ বছরের বড়। ওই ঘরে আগে দাদা একাই থাকত, আমি বাবা মায়ের মাঝেই শুতাম। যখন ক্লাস ফোরে উঠি তখনই দাদা ডাক্তারি পড়তে হোস্টেলে চলে যায়, তারপর উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যায় বিদেশে, ফিরে এসে দিল্লিতে চাকরি পায়। সেই থেকে আমি ঐ ঘরে একাই থাকতাম, শুধু ছুটি ছাটায় দাদা এলে ওই ঘরে থাকত।

শুভ মানে শুভ রায় ছিল আমার থেকে বছর খানেকের বড়। কিন্তু পড়তো দু ক্লাস উঁচুতে। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান, দেখতে যেন রাজপুত্র, যেমন গায়ের রং তেমনই চোখমুখ। পড়াশোনাতেও দারুন ছিল। আমার দাদার কাছে নিয়মিত পড়তে আসত, আমি তখন টো টো কোম্পানী। আমাদের দুজনেরই ওই দুই বাড়িতেই জন্ম, সুতরাং ছোট্ট থেকেই আমাদের পরিচয়, তাই আমরা ভীষন বন্ধুও ছিলাম। যদিও স্বভাব চরিত্রে শুভ আমার একদম উল্টো ছিল। শান্ত শিষ্ট তো ছিলই, বেশ ভীতুও ছিল। আমার তো ওকে ছেলে বলে মনেই হতো না, ওর হাঁটা চলা, হাব ভাব, কথা বার্তা আমার পুরো মেয়ে মেয়ে লাগতো। তার ওপর ও আমার সাথে নাচ গানের ক্লাসেও ভর্তি হয়েছিল। ভালো নাচত বলে কিনা জানিনা ও কেমন যেন তালে তালে হাঁটত, তাতে মেয়েলি ভাবটা আরো বেশি করে প্রকট হত। কাকীমাও দারুন গান গাইতেন, আমাদেরও শেখাতেন, আমি তো তার সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রী ছিলাম। এই চলা নিয়ে আমি শুভর খুব পেছনে লাগতাম। শুধু আমি নই, পাড়ার অন্যরাও ওকে মজা করে শুভা ডাকতো। অন্যরা বললে ও রেগে যেত কিন্তু কেন জানিনা আমি বললে কিছুই বলতো না। আমরা পড়তাম আলাদা আলাদা স্কুলে, আমার ছিল কো-এড, ওর ছিল ছেলেদের স্কুল। তাই হয়তো মেয়েদেরকে ভীষণ লজ্জা পেত, তা সে বড় হলেও। একমাত্র আমার সাথে নির্দ্বিধায় কথা বলত। আমিও দাদার অভাবে ওর সাথেই মনের কথা বলতাম।

অবশ্য আমি ওকে নিয়ে খুব মজাও করতাম। মাঝে মধ্যেই সেটা অতিরিক্ত হয়ে যেত। একবার কালি পুজোর সময় দুপুর বেলা ও যখন ঘরে পড়ছিল তখন ওকে চমকে দিতে, ওর খোলা জানলায় আমি একটা দোদোমা ফাটাই যার প্রথম আওয়াজে ও তো চমকে ছিলই, কিন্তু ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই দ্বিতীয় আওয়াজটা হয় ঘরের ভেতরে একদম ওর শরীরের কাছে, তাতে ও এমন লাফ দিয়েছিল যে বিছানা থেকে মাটিতে পড়ে ওর হাঁটু ছড়ে গেছিল, হাতেও লেগেছিল। অবশ্য তার জন্য আমি সে রাতে আড়ং ধোলাই খেয়েছিলাম, কিন্তু ওটা আমার রুটিনের মধ্যে পড়ত, সপ্তাহে অন্তত একবার বরাদ্দ ছিল, না খেলে বাজে লাগত।

আরেকবার, ঠিক করলাম সবাই যখন আমায় কালি বলে তখন মা কালিই সাজব। যেই ভাবা সেই কাজ। প্রথমে একটা কালো শাড়ি জোগাড় করলাম, আর বাগানের গাছ কাটার জন্য একটা বিশাল দা ছিল, সেটা নিলাম। এরপর উঠোন ঘষার জন্য রাখা কতগুলো নারকেলের মালার ফুটো দিয়ে দড়ি লাগিয়ে একটা মুন্ডমালার মত বানালাম। তারপর একটা শক্ত কাগজ জিভের মত কেটে তাতে লাল রঙ করলাম। আমার ছিল একঢাল কোমর পর্যন্ত লম্বা চুল, ভালো করে শ্যাম্পু করে তা আরো ফুলিয়ে নিলাম। এইবার ওই কালো শাড়ি পড়ে, চুল খুলে গলায় নারকেলের মালা পড়ে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কপালে একটা চোখ আঁকলাম। কিন্তু হাতে দা নিয়ে আর দাঁতে ওই নকল লাল জিভ ধরেও ঠিক মন মত হলো না। তখন চলে গেলাম কাছের বস্তিতে থাকা এক সাপুড়ের কাছে। এই বস্তির লোকেরা সব আমার খুব চেনা ছিল ওদের ছেলেমেয়েরা সবাই আমার খেলার সাথী ছিল। ওই সাপুড়ের কাছ থেকে একটা জ্যান্ত কিন্তু বিষহীন বড় সাপ নিলাম। তারপর ওটা গলায় জড়িয়ে, কপালে চোখ এঁকে, হাতে দা নিয়ে, চুল খুলে, দাঁতে নকল জিভ ধরে মাকালী সেজে ভর সন্ধেবেলা সোজা ঢুকে গেলাম শুভর ঘরে। সে বেচারা সেদিন পরীক্ষা শেষ হয়েছে বলে দেরি করে ঘুমচ্ছিলো, চোখ খুলে আমায় দেখে এমন ভিরমি খেলো যে চোখ উল্টে অজ্ঞান হয়ে একেবারে যা তা কান্ড, চোখে মুখে জল ছিটিয়ে তবে ওকে সুস্থ করা যায়। নেহাৎ ওর মা আমাকে ভীষন ভালোবাসত, তাই সে যাত্রায় শুধু আমার মায়ের বেতের মারের ওপর দিয়েই আমার বিপদ কাটলো। অন্য কেউ হলে নিশ্চয়ই আমাকে পুলিশে দিত। দুই বাবা অবশ্য আমার সাজ দেখে হেসেই গড়া গড়ি দিয়েছিল। যদিও সাপটা জ্যান্ত বোঝার পর ওদের চোখ মুখের অবস্থাও দেখার মত হয়েছিল।

ওই অঞ্চলে থাকার পুরো সময়টাই আমরা পাশাপাশি ছিলাম। বাবার রিটায়ার করা অবধি। শুভর বাবা আমার বাবার থেকে বয়সে কিছু ছোট ছিল কিন্তু দুই পরিবারে খুব মিল ছিল। বাটি দেওয়া নেওয়া কোনোদিন ঘটি ছো‍ঁড়াছুঁড়িতে পরিবর্তিত হবার অবকাশ পায়নি। শুভ তাদের একটু বেশি বয়সের সন্তান তাই হয়তো ভালোই আদুরে ছিল। আমাকে কিন্তু শুভর বাবা মা দুজনেই ভীষন ভালোবাসত দুটো বিপরীত কারনে। কাকিমার ছিল মেয়ের শখ, তাই শুভকে ছোটবেলায় মেয়েদের মত করে সাজাত, আর আমাকে নিজের মেয়ের মতোই দেখত, যেন আমি তার মেয়ের অভাব পূরণ করছি। কিন্তু কাকু একদম উল্টো, কাকিমার এই ছেলেকে মেয়ে সাজানো কাকুর একদম পছন্দ ছিল না, আবার আমি যেহেতু ছেলেদের থেকেও বেশি ডানপিটে ছিলাম, তাই আমাকে নিজের ছেলেই মনে করত। কাকু বলতো, “ওর বাবা মায়ের কাছে ও মেয়ে হতে পারে কিন্তু আমার কাছে ও আমার ছেলে। মেয়েদের এমনই হওয়া উচিৎ।” আমাকেও বলতো, “তুই ওসব মেয়েলি পোশাক পারবিনা, ছেলেদের পোশাক পড়বি তাতে কাজও ভালো করা যায়, তোর যত দুস্টুমিও ভালো করা যায়।” আমি অবশ্য মেয়েদের পোশাক পড়তামই না, দাদার জামা প্যান্টেই আমার চলে যেত। যখন স্কুলফাইনাল পাস করি শুভ তখন হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে বাইরে চলে যায়। দুজনেরই রেসাল্ট বেরোবার আগে একটা ঘটনা ঘটে যা আমাদের দুজনের জীবনকেই পরিবর্তন করে দেয়।

আগেই বলেছি আমার সাথে আমাদের কাছের বস্তির ছেলে মেয়েদের বেশ বন্ধুত্ব ছিল। স্কুলফাইনালের পর আমাদের এই দলটা ঠিক করলো নিজেরাই নাটক করবে। যথারীতি আমিই লিডার। মহড়ার জন্য যদিও একটা ঘর পাওয়া গেলো কিন্তু সেখানে আলো পাখা কিছুই নেই, তার ওপর অন্যান্য জিনিসের জন্য টাকাও লাগবে, বাড়ী থেকে দেবার মত ক্ষমতা আমার মত দুয়েকজনেরই শুধু আছে, তাও পর্যাপ্ত হচ্ছে না, তখন ঠিক হলো আমাদের কাছের আরেক পাড়ার প্রাইমারি স্কুলে নতুন ফ্যান, লাইট লাগছে, সেখান থেকে চুরি করে আনা হবে, তারপর তার থেকে একটা দুটো ব্যবহার করে বাকি গুলো বিক্রি করে টাকা জোগাড় করা হবে, যদিও রাস্তায় চৌকিদার ঘোরে, কিন্তু ওদের চোখে ধুলো দেওয়া কোনো ব্যাপার নয়। সেই মত এক শনিবার রাতে আমরা দল বেঁধে স্কুলের পাঁচিল ডিঙিয়ে চুরি করতে ঢুকলাম। প্রথমেই একটা বাল্ব খুলে একজন কে ধরতে দিয়েছি, অন্ধকারে আরেকটা বাল্ব যখন খুলছি আমার এক সঙ্গী কিছু একটা ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, এই আওয়াজে চমকে গিয়ে যার হাতে বাল্ব ছিল সে সেটা হাত থেকে স্কুলের মেঝেতে ফেলে দিলো, ব্যাস দুম করে একটা আওয়াজ হলো, সাথে সাথে রাস্তায় থাকা চৌকিদাররা শব্দ শুনে দৌড়ে এলো। আমরা তো পরি মরি করে পাঁচিল ডিঙিয়ে হাওয়া।

ঠিক সেই সময়ই অন্যদিকে আমাদের শুভ কোনো এক বন্ধুর বাড়ি থেকে হেঁটে ফিরছিল ওই স্কুলের পাশ দিয়ে। হঠাৎ আওয়াজ আর চেঁচামেচি শুনে ও ভয় পেয়ে দৌড় দেয় আমাদের পেছন পেছনেই, কিন্তু ওই পাড়ার কিছু লোকের হাতে ধরা পড়ে যায়, আর ওকে ওরা চোরের দলের লোক ভেবে বেশ কয়েক ঘা চড় চাপড় দিয়ে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয়। ওর কোনো কথাই ওরা শোনেনি। অনেক রাতে যখন আমাদের কাছে খবর আসে তখন আমি রাতের খাবার খেয়ে নিশ্চিন্তে টিভি দেখছি। খবর পেয়েই বাবারা পাড়ার কাকুদের নিয়ে দৌড়ে গিয়ে দ্যাখে, পুলিশও ওকে বেশ মেরেছে, তারপর হাতপা বেঁধে বসিয়ে রেখেছে। তখনও কোনো কেস দেয়নি। বাবাদের কথায় ওকে ছাড়া হলো ঠিকই কিন্তু মুচলেকা দিয়ে যে আর কোনোদিন ওই পাড়ায় যাবে না।

এই ঘটনার পরেই শুভ কেমন যেন বদলে যায়। পুরো চুপচাপ হয়ে যায়। আমার মা ওকে খুব ভালোবাসত, আমার মায়ের হাতের পায়েস ও অমৃত বলত। কিন্তু সেদিনের পর থেকে ও আমার মায়ের সাথেও কথা বন্ধ করে দিলো, নিজের মা বাবার সাথেও কথা বলতো না। কেন জানিনা একমাত্র আমার সাথেই যা একটু কথা বলত তাও আমি বললে তবেই। কিন্তু অনুশোচনায় আমি ওর সাথে কথা বলতেই পারতাম না। কেউ না জানুক, আমি তো জানি কার দোষে আজ ওর এই অবস্থা। নিজেকে ওর কাছে অপরাধী মনে হত। এরপর থেকে আমিও কেমন যেন শান্ত হয়ে গিয়েছিলাম, পাড়ায় কারো জন্য ডাক্তার হসপিটাল দৌড়নো ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে জড়াতাম না।

ইতিমধ্যে, সেই বছরের জয়েন্টের রেসাল্ট বের হলো, দেখা গেল শুভ র‍্যাঙ্ক করেছে, ও দুর্গাপুরে পড়তে চলে গেল, ক্যাম্পাসে হোস্টেলও পেয়ে গেল। আমরাও ভাবলাম হয়তো বাড়ী থেকে দূরে গেলে ধীরে ধীরে সব ভুলে যাবে। যাবার আগে শুভ আমার সাথে দেখা করতে এলো। বাড়িতে তখন কেউ নেই। ও আমার সামনে বসে কেঁদে ফেললো। আমি ওর হাত ধরলাম, সান্তনা দিলাম, তারপর ওর চোখের জল মুছিয়ে দিলাম। ওর কান্না থামল। কিছুক্ষন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমি, ওকে সান্তনা দেবার জন্য ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ও কি ভাবলো জানিনা, মুখটা এগিয়ে এনে আমার ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকাল। এরকম অভিজ্ঞতা আমার সারা জীবনে হয় নি। আমার শরীরের মধ্যে দিয়ে যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। আমি এতটাই শিহরিত হয়ে গেলাম যে কোনো রকম বাঁধা দিলাম না। আমরা কতক্ষন এইভাবে ছিলাম জানিনা, হঠাৎ ও উঠে গিয়ে দৌড়ে চলে গেল। আর আমি একটা অপূর্ব অভিজ্ঞতার রেশ নিয়ে বসে রইলাম।

হোস্টেলে যাবার কয়েকমাস পরেই শুভ বাড়ি ফিরে আসে। নিজে আসেনি, আমাদের দুজনের বাবারা গিয়ে ওকে নিয়ে আসে। ওখানে নাকি ওর ভীষন রকম র‍্যাগিঙের নামে অত্যাচার হয়েছে। ও একটু অন্যরকম বলে আরো বেশি হয়েছে। দুর্গাপুরের শীতে নগ্ন করে পিটিয়েছে, তারপর ঠান্ডা চৌবাচ্চার জলে চুবিয়ে রেখেছিল। পরদিন যখন বাবারা যায় তখন ওর ধুম জ্বর, বাড়ী আসার পর জানা যায় ওটা নিউমোনিয়া। অনেক কষ্টে সেবার ওকে বাঁচানো যায়। আমি প্রায় সারাদিন ওর পাশেই বসে থাকতাম, জল পট্টি দিতাম, ওষুধ খাওয়াতাম। কাকিমা কোনো পুলিশ কেস করতে দিলেননা ওর ভবিষ্যতের কথা ভেবে। তারপর ওকে আবার বুঝিয়ে সুঝিয়ে কলেজে পাঠানো হয়। এবার পেইং গেস্ট হিসেবে একজনের বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা হয়। কিন্তু শুভর আর পড়াশোনায় মন বসেনি। বার বার ফিরে আসত, এবং প্রতিবারই ওকে বুঝিয়ে পাঠানো হতো। এরমধ্যে আমিও হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে, সায়েন্স নিয়ে লোকাল কলেজে ভর্তি হই। এদিকে শুভকে ফার্স্ট ইয়ারে রি অ্যাডমিশান নিতে হয়, তবুও ও দ্বিতীয় বছরের মাঝামাঝি সময়ে পাকাপাকি ভাবে ফিরে আসে। তারপর আমাদের কলেজেই ওকে অনেক অনুরোধ উপরোধ করে বছরের মাঝামাঝি সময় ভর্তি করা হয়, সায়েন্স বিভাগে আমার সাথেই।

আমাদের কলেজে ভর্তি হবার পর প্রথম প্রথম ওকে আমি আমার বন্ধুদের সাথে মেলাবার চেষ্টা করতাম কিন্তু বুঝতে পারলাম ও আমাকে ছাড়া কাউকেই পছন্দ করছে না, সে ছেলে মেয়ে যেই হোক। ধীরে ধীরে বুঝলাম ও এক ধরনের মানসিক রোগে ভুগছে। মেয়েলি ভাবটা যেন আরো বেড়ে গেছে, হাঁটাচলাতেও বোঝা যাচ্ছিল। হয়তো এই জন্যেই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে টিকতে পারলো না। ভীষন বিড়ি সিগারেট খাওয়াও শুরু করেছে। কাউকেই পাত্তা দিচ্ছে না। আমি এ ব্যাপারে মা বাবাকে বললাম। মা বাবাও ব্যাপারটা ধরেছিল। আমার বাবা, যখন শুভর বাবামাকে আমাদের বাড়িতে ডেকে এনে ব্যাপারটা বললো তখন কাকুও মানলেন, কিন্তু শুভর মা কিছুতেই মানলেননা। আমরা তাকে অনেক বোঝালাম যে শুভর চিকিৎসার প্রয়োজন, কিন্তু উনি কিছুতেই রাজি হলেননা। উল্টে যা জীবনে ভাবিনি তাই করলেন, আমাকেই যা নয় তাই বলে বসলেন। ব্যাস, আমারও খুব অভিমান হয়ে গেল, কখনও যা হয়নি সেই চোখে জল এসে গেল। কাকু পরে আমাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু আমি আর সেই টানটা অনুভব করছিলাম না। এমনকি শুভর থেকেও দূরত্ব তৈরি করতে থাকলাম।

ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বাড়িতে ফিরে আসার পর শুভকে দেখতাম প্রায়ই নিজের জানলায় দাঁড়িয়ে আমার জানলার দিকে চেয়ে থাকতো। আমাকে দেখতে পেলে চোখ সরিয়ে নিত। প্রথম প্রথম আমার ভালোই লাগতো, কিন্তু সেদিন কাকিমার কথা শোনার পর থেকে আমি জানলাটা বন্ধই রাখতাম। খুললেও পর্দা টেনে রাখতাম। বুঝতে পারছিলামনা একজন চিকিৎসা না হওয়া মানসিক রুগির সাথে সম্পর্ক রাখবো কিভাবে। বন্ধুত্ব তবু চলে, কিন্তু যেমন সম্পর্কের ইঙ্গিত আমি ওর কাছ থেকে পাচ্ছিলাম তা বহন করার মত মানসিক সম্মতি আমার আসছিলোই না। সম্পর্কটা তৈরি করার জন্য কোনো যুক্তিই দাঁড় করাতে পারছিলাম না। আমি যথাসম্ভব ওকে এড়িয়ে চলতে থাকলাম। বুঝতে পারছিলাম ও আমাকেই আঁকড়ে ধরতে চাইছে কিন্তু আমি তখন অসহায়।

এমনই একদিন সন্ধেবেলা, বাবা মা বাড়িতে নেই। দরজা খোলাই ছিল, আমি বাইরের ঘরে সোফায় বসে ছিলাম, কেন জানি মনটা ভালো ছিলোনা, গান গাইতে ইচ্ছে করলো। প্রথমে “পুরানো সেই দিনের কথা” গাইলাম, তারপর একটা ঠুমরি গাইতে ইচ্ছে করলো, “ইয়াদ পিয়া কি আয়ি” ধরলাম, গানের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিলাম। গান শেষ হতে সম্বিৎ ফিরল, তীব্র পোড়া তামাক আর মদের গন্ধে ঘরটা যেন ভরে গেছে। কি খেয়াল হতে হঠাৎ পেছন ফিরে দেখলাম কখন শুভ পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। বিড়ির ব্যাপারটা জানতাম, মদের গন্ধে অবাক হয়ে গেলাম। সারা মুখ খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে ভর্তি, চোখ দুটো কেমন ঢুলু ঢুলু, জামাপ্যান্ট নোংরা অবিন্যস্ত। শুভ কোথায় যাচ্ছে! রেগে গিয়ে ওকে এরকম নিঃশব্দে আসার কারন জিজ্ঞেস করলাম। বললো, “কেন? তুইও তো কতবার নিঃশব্দে এসে আমাকে ঘাবড়ে দিয়েছিস। আমি করলেই দোষ?” শুনে চমকে গেলাম, শুভ আমাদের পুরনো ঘটনার রেশ ধরে কাছে আসতে চাইছে। কিন্তু ওকে এই অধঃপতিত অবস্থায় আমি তো কিছুতেই মানতে পারছিনা। এরমধ্যেই হঠাৎ, শুভ আমার সামনে এসে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লো, তারপর আমার দুই হাঁটু দুহাত দিয়ে ধরে আমার কাছে ভিক্ষে চাওয়ার ভঙ্গিতে বললো, “তোকে ছাড়া আমি বাঁচবোনা ডলি, তুই আমার সব, আমি তোকে ভালোবাসি।” শুনে আমার কেন জানি একটুও আবেগ এলো না, বললাম, “তুই আগে তোর চিকিৎসা করা, তুই অসুস্থ। তুই সুস্থ হলে তোকে নিয়ে ভাববো। দরকার হলে তোর সুস্থ না হওয়া অবধি আমি অপেক্ষা করবো। কিন্তু তোর এই অবস্থায় আমি তোর সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতে পারবোনা।” আমি আশা করেছিলাম ও হয়তো আমার কথার একটু হলেও গুরুত্ব দেবে। যতই হোক যদি আমায় সত্যি ভালোবাসে তবে আমার জন্য চিকিৎসাটা করাতে রাজি হবে। কিন্তু ও প্রচন্ড রেগে গিয়ে আমার হাঁটু দুটো চেপে ধরে আমার মুখের কাছে মুখটা নিয়ে এসে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,”আমার কিছুই হয়নি, আমাকে বিনা দোষে সবাই মেরেছে। আমি জানি সেদিন রাতে স্কুলে তুই ছিলি, আমি দেখেছিলাম। তোর নাম কাউকে কোনোদিন বলিনি, বলবোও না। তোর জন্য আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি। তুই আমার হ, তাহলেই আমি শান্তি পাবো। নয়তো আমি কি করবো তুই ভাবতেই পারবিনা।”

ওর মুখের বিশ্রী গন্ধে তখন আমার যেন বমি এসে যাচ্ছিল। আমি ওর উপস্থিতিই সহ্য করতে পারছিলাম না। ওর কথায় কোনো ভয় আমি পাইনি, ভয় আমার ধাতে নেই। বরং আমার তখন ওর প্রতি একটা তীব্র বিতৃষ্ণা হচ্ছে, ভাবছিলাম, ও কি মাতাল হয়ে এসে আমাকে ব্ল্যাকমেল করে আমার ভালোবাসা চাইছে? এসব কথা যখন আমার মনের মধ্যে ঝড় তুলেছে, তখন লক্ষ্য করলাম ওর মুখটা আমার শার্টের বুকের কাছে যেখানে অখেয়ালে বোতাম খোলা ছিল সেই অংশের দিকে এগিয়ে আসছে। এটা বুঝতেই আমি ঘেন্নায় ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম, তারপর আমিও চেঁচিয়ে উঠলাম, “তুই বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা তুই, তোকে আমি সহ্য করতে পারছিনা। তোর সাথে আমি কোনো সম্পর্ক রাখতে চাইনা। তুই যা খুশি করতে পারিস।” শুভ কয়েক মুহূর্ত গুম হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর টলতে টলতে বেরিয়ে গেল। আমি ছুটে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। এরপর থেকে ওর খোঁজ রাখাই বন্ধ করে দিলাম। লক্ষ করলাম কলেজে আসাও ও বন্ধ করে দিয়েছে। কাকু মাঝে মাঝেই বাবার কাছে এসে দুঃখ করত। মায়ের সামনেই একদিন আমার মাথায় হাত দিয়ে কেঁদে ফেলেছিল। কিন্তু আমরা অসহায়। কাকিমা কেমন যেন জেদ ধরে বসে ছিল, তার ছেলের নাকি কিছুই হয়নি। কাকিমা গান করাও ছেড়ে দিয়েছিলেন।

এর কয়েকদিন পর এক রাতে প্রায় দুটো নাগাদ বাবা মা ঘুমোচ্ছে, আমি রাত জেগে টিভি দেখছি এমন সময় হঠাৎ ওদের বাড়ির থেকে কেমন যেন একটা অদ্ভুত গোঙানো কান্নার আওয়াজ পেলাম, জানলার কাছে গিয়ে দেখলাম শুভর ঘরে আলো জ্বলছে। আর ভেতরে যেন ছোটাছুটি হচ্ছে। মনটা কি যেন এক অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠলো। তাড়াতাড়ি বাবা মাকে ডেকে ওদের বাড়ি দৌড়লাম। দরজা ধাক্কাতে কাকিমা এসে খুলে দিল। কাকিমার মুখটা যেন কাগজের মত সাদা, আমি দৌড়ে শুভর ঘরে গিয়ে যে দৃশ্য দেখলাম তা আমি জীবনে ভুলবোনা। ছোটবেলায় দাদার সাথে তার বন্ধুর বাবার শেষকৃত্যে প্রথম শ্মশানে যাই, তখন আমাদের ওখানে ইলেক্ট্রিক চুল্লি ছিল না, তারপর থেকে বহুবার শশ্মানে গেছি স্মশান যাত্রী হয়ে। দু একবার কবরে মাটি দিতেও গেছি। আমি মেয়ে বলে বহু রকম কথাও আমাকে শুনতে হয়েছে, কিন্তু আমি পিছিয়ে যাই নি। তাই শব দেখা শুধু নয়, শব ধরাও আমার কাছে নতুন কিছু নয়।

কিন্তু এখানে শুভর দেহটা দেখলাম ফ্যানের থেকে ঝুলে আছে, আর কাকু তাকে নিচের থেকে উঁচু করে ধরে আছে, আর কাঁদতে কাঁদতে বলে চলেছে, “তোর কিছু হবেনা, তোর কিছু হবেনা।” আমি এক লাফে ওদের রান্নাঘর থেকে একটা বঁটি নিয়ে এসে সোজা খাটের ওপর উঠে ফ্যান থেকে বাঁধা দড়িটা কেটে দিলাম। তারপর বঁটিটা ছুঁড়ে ফেলে ওকে জড়িয়ে ধরে নামাতে থাকলাম। এর মাঝে বাবাও এসে ধরলো। ওকে ধীরে ধীরে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া গেল। বুঝতে পারছিলাম, হালকা শ্বাস পড়ছে, কিন্তু জ্ঞান নেই। লক্ষ্য করলাম গলায় একটা কালসিটের দাগ। শরীর কিন্তু ছেড়ে দিয়েছে। মূল মূত্রে জামাকাপড় একেবারে মাখামাখি। দাদার কাছে শিখেছিলাম কিছু তাৎক্ষণিক প্রাণ রক্ষার বিদ্যা, এনসিসিতেও কিছু শিখেছিলাম, তাছাড়া সিভিল ডিফেন্সের ট্রেনিংও নেওয়া ছিল। সেগুলো কাজে লাগলাম। তারপর পাল্স দেখলাম, চলছে তবে খুব ধীর গতিতে। ততক্ষনে আমার মায়ের ডাকে পাড়ার সব লোক এসে জড় হয়েছে, বস্তির ছেলেগুলোও চলে এসেছে। ইতিমধ্যে শুভর জ্ঞান ফিরে আসার সাথে সাথেই ও কেমন যেন খাঁচায় বন্দি পশুর মত হাত পা ছুড়তে লাগলো। পাঁচ ছয়জন মিলে ওকে ধরে রাখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষন এমন চলার পর ও আবার অজ্ঞান হয়ে গেল। আমি বাকিদের ওকে ধরতে বলে, কাকুর গাড়ির চাবি নিয়ে সেটা বার করতে চলে গেলাম। এই গাড়িটা কাকুই আমাকে চালাতে শিখিয়েছিল, শুভ ভয়ের চোটে শিখতে পারেনি, তাই আমিই দরকার পড়লে ওটা চালাতাম। গাড়ি আনার পর ওকে সবাই মিলে ধরাধরি করে গাড়িতে উঠিয়ে, কাছের সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। সে যাত্রায় শুভ বেশ বেগ দিলেও শেষ পর্যন্ত বেঁচে গেল।

ডাক্তাররা ইঙ্গিত করায়, পরে ওর খাটের নিচ থেকে অনেকগুলো দেশি মদের বোতল পাওয়া গিয়েছিল। এইবার সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের কথায় কাকিমার জেদ ভেঙে গেল, ছেলের ওপর ভরসা চলে গেল। এরপর ওরা ওকে মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে নিয়ে গেছিল, কিন্তু ডাক্তাররা জানালো অনেকটাই নাকি দেরি হয়ে গেছে। এখন শুধু ওষুধ খেয়ে যতদিন ভালো থাকার থাকবে। তবে ওকে নজরে রাখতেই হবে কারন ওর মানসিক রোগটা সুইসাইডাল টেন্ডেন্সিতে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। ও নাকি আবারও চেষ্টা করবে। শুভ কিন্তু এরপর থেকে সুযোগ পেলেই প্রায়ই বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় চলে যেত। কখনো হয়তো নিজেই ফিরত, কখনো বা কেউ ধরে নিয়ে আসত। বেশিরভাগ সময়ই ওকে ঘরে বন্ধ করে রাখা হত।

ডাক্তাররা যা বলেছিল ঠিক তাই ঘটলো, ওই ঘটনার কয়েকমাস পরেই একদিন দুপুরবেলা, সেদিন আমি কলেজ যাইনি, বাবারা সব অফিসে। এমন সময় কাকিমার ডাক শুনলাম, মা আর আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি শুভ চালু ফ্রিজের পেছনের ইলেকট্রিক কেবেল টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে। শক খেয়েছে কিন্তু বেশি নয়, তবে কেমন জন্তুর মত রেগে ফোঁস ফোঁস করছিল। মা তো ভয় পেয়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি মেনটা অফ করে ওকে টেনে আনলাম তারপর এক বালতি জল এনে ওর মাথায় ঢেলে দিলাম। ও কেমন শান্ত হয়ে গেল। তার কিছুক্ষন পর নিজেই উঠে গিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। সেদিনও কাকু আমাদের বাড়িতে এসে কেঁদেছিল। এইবার আমিও বাধ্য হয়ে ওর সাথে আমার শেষ কি কি কথা হয়েছিল তা মা বাবাকে বলে দিলাম। আর চেপে রাখতে পারছিলামনা। ওঁরা শুনে তো ভয় পেয়ে গেলেন, কিন্তু আমি আশ্বস্ত করলাম যে আমার কোন ক্ষতি করার ক্ষমতা বা ইচ্ছে বোধহয় ওর নেই, থাকলে ও এর আগেই তা করতো।

আরো কিছু মাস পর সেই ঘটনাটা ঘটলো যা আজও আমার স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে। এই ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা আমি আজ পর্যন্ত পাইনি। কয়েক মাস আগে একটা তদন্ত করতে গিয়ে বহুদিন পর আমার সেই ঘটনাটা নতুন করে মনে পড়ে যায়। তারপর থেকেই আমার ওই শনিবার রাতে স্বপ্ন দেখা শুরু। ডাক্তাররা বলছেন যে এ একধরনের হ্যালুসিনেশন, কিন্তু তারা ব্যাপারটার কোনো যুক্তি দিতে পারেননি। তবে দুটো ঘটনা প্রায় একই রকমের যদিও প্রথমটা আমি চাক্ষুস করিনি।

তখন আমার ফাইনাল ইয়ার। সেদিন ছিল শনিবার, গরমকাল, জানলা খুলে পর্দা টেনে আমি মশারি টানিয়ে খাটে ঘুমোচ্ছি। বাইরে হওয়া দিচ্ছে, জানলা খোলা বলে ঘরটা বেশ ঠান্ডা। হঠাৎ,খুব গুমোট লাগলো, ঘুমটা ভেঙে গেল। চোখ খুলে অবাক হয়ে দেখলাম, শুভ যেন আমার ওপর ঝুঁকে রয়েছে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। মশারীটা নেই, জানালা বন্ধ। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। সেই প্রথম নিজের অজান্তেই আমি ছোটবেলায় গান করতে গিয়ে শখ করে শেখা গায়ত্রী মন্ত্র জপ করে ফেললাম। শুনেছি এই মন্ত্র নাকি বিপদ থেকে রক্ষা করে। তবে যাই করুক, ওটা জপ করার সাথে সাথেই শুভ কোথায় হারিয়ে গেল। তখন দেখলাম মশারি যেমন থাকার তেমনই আছে। জানালাও খোলা, যেমন হাওয়ায় পর্দা উড়ছিল তেমনই উড়ছে। আমি তড়াক করে বিছানা থেকে উঠে মাকে ডাকলাম, জিজ্ঞেস করলাম কেউ ঢুকেছে কিনা? মা বাবা তাড়াতাড়ি উঠে এলো, কিন্তু তারা কিছুই টের পাননি। আমিও আর পরিষ্কার করে বললাম না কি দেখেছি বা কাকে দেখেছি। ঘড়ি দেখলাম তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা বাজে, সূর্য উঠতে তখনো কিছু দেরি আছে। তাই আবার শুয়ে পড়লাম। মা বাবাও শুতে চলে গেল।

পরদিন রবিবার রাস্তার চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙল। উঠে গিয়ে জানালা দিয়ে দেখলাম শুভদের বাড়ির সামনে বেশ বড় একটা জটলা। মনে কু ডাকলো। কাকিমার কান্না শুনতে পাচ্ছিলাম। তাড়াতাড়ি বের হতে গিয়ে দেখি সদর দরজা বাইরে থেকে বন্ধ, তারপর খেয়াল করলাম বাবা মা ঘরে নেই। খুব চিন্তায় পড়লাম। ব্যাপারটা কি? আমাকে আটকে রেখে বাবা মা কোথায় গেল। ভাবতে ভাবতেই মা দেখলাম কাঁদতে কাঁদতে এসে দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো। আমি জিজ্ঞেস করায় বললো, শুভ নাকি ভোর বেলার একটা থ্রু ট্রেনে কাটা পড়েছে। শুনে আমি যেন চোখে অন্ধকার দেখলাম। তবে কি?! ধাতস্থ হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, কখন, কিভাবে? মা বললো যে শুভ নাকি গভীর রাতে বাড়ি থেকে কি করে বেরিয়ে গেছিল। স্টেশনে গিয়ে বসেছিল। কয়েকজন ভোরের হকার ওকে দেখেছে। তারপর হঠাৎ প্রথম যে থ্রু মেল ট্রেনটা পাস করে সেটা প্লাটফর্মের কাছাকাছি আসতেই ও চটি খুলে নিচে নেমে পড়ে, তারপর প্রণাম করে ট্রেনটার সামনে দাঁড়িয়ে যায়। ব্যাস! সব শেষ। পকেটে নাকি কলেজের আই কার্ডটা ছিল তাই দেখে পুলিশ এই একটু আগে বডিটা নিয়ে এসেছে। আমি যাতে ঘুম থেকে উঠেই ওই দৃশ্য দেখতে না যাই, তাই জন্য মা আমাকে দরজা বন্ধ করে গেছিল। মাও নাকি তাকাতে পারেনি। আমি সাথে সাথে যেতে চাইলাম কিন্তু মা আমাকে জোর করে আটকে দিলো। এরমধ্যেই পুলিশ বডি নিয়ে পোস্টমর্টেম করাতে চলে গেল। এরপর বাবাও ফিরে এসে বললো আমার যাওয়ার দরকার নেই। বস্তির ছেলেরা আর বাবাদের অফিসের কলিগরাই সামলে নেবে। ওরা বাবাকেও যেতে মানা করেছে।

এই দ্বিতীয় বার আমি কেঁদে ফেললাম, একদম আমার স্বভাব বিরুদ্ধ, হাউ হাউ করে। কাঁদতে কাঁদতে মা বাবাকে রাতের ঘটনাটা বললাম। বাবা অবাক হয়ে বললো, “তা কি করে হয়? ওই সময় তো ও স্টেশনে ছিল। ট্রেনটা নাকি পাস করেছে সাড়ে পাঁচটাতেই।” এবার আমার মনে প্রশ্ন জাগলো, তাহলে রাতে আমি কাকে দেখলাম? মা আমাকে হাতমুখ ধুয়ে স্নান করে নিতে বললো। আর বললো এই ঘটনা নিয়ে বেশি চিন্তা না করতে। এই বলে মা আবার চলে গেল কাকিমাকে শান্ত করতে। বেশ কিছুক্ষণ পর যখন আর কাকিমার কান্না শোনা যাচ্ছিল না, তখন মা ফিরে এলো। এবার বাবা গেল ওই বাড়িতে। ওরা যেন আমাকে কিছুতেই সেদিন বাড়ির বাইরে বের হতে দেবেই না ঠিক করেছে। প্রথমে আমার ভীষণ রাগ হলো। বেশ কিছুক্ষন চেঁচামেচি করলাম, তারপর নিজেই চুপ করে গেলাম। ভাবলাম কি হবে গিয়ে? যার জন্য দৌড়ে যেতাম সেই তো নেই। সেদিন রাতে আমি বহু বছর পর সেই ছোটবেলার মত মা বাবার মাঝখানে শুয়েছিলাম। মা মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিল, “দ্যাখ, ও তোকে ভালোবাসত এটা তো ঠিক? তাছাড়া তুই ওকে দু বার প্রাণে বাঁচিয়েছিলি, এটাও ঠিক। হয়তো যাবার আগে ও একবার তোকে শেষ দেখা দিয়ে গেল। হয়তো বুঝিয়ে গেল যে তুই ওকে আর ধরতে পারবিনা।” এর কিছুদিন পরেই বাবা রিটায়ার করে, আর আমরা দিল্লিতে দাদার কাছে চলে আসি।

এবারে আমার দেখা ঘটনাটা ঠিক যেন ওই শুভর মৃত্যুরই পুনরাবৃত্তি। এই ছেলেটিও ঠিক ঐভাবেই ঐরকম সময়েই ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যায়, যদিও এটাকে খুন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, কিন্তু আমি যেন সেদিন এই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে সেই প্রায় দশ বছর আগের আমার না দেখা ঘটনাটাকেই চোখের সামনে দেখলাম। সেই থেকেই প্রতি শনিবার রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমার মনে হয়, যেন কেউ আমার ওপর ঝুঁকে পড়ে আমাকে কিছু বলতে চাইছে। জানিনা আমার এই সমস্যা কবে যাবে, কতই তো চিকিৎসা করলাম। দেখি ডাক্তারের কথা মত এই লেখাটা শেষ করার পর কি হয়। তবে লেখাটা শেষ হবার পর মনটা অনেক হালকা লাগছে।

ইতি।
দুর্গা সিংহ

পুনঃ:- ওই লেখাটা লেখার পর প্রায় মাস তিনেক কেটে গেছে, আমার শনিবার শনিবার ওই স্বপ্নটা দেখা বন্ধ হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে ওই ছেলেটি যে খুন হয়েছিল তাও প্রমান হয়েছে। এমনকি খুনিও ধরা পড়েছে। তাই দুটো ঘটনার মধ্যে মিল বিশেষ নেই। ডাক্তার বলেছেন এখন আমি সুস্থ। একটা ব্যাপার শিখলাম, মনের কোনো গোপন ভয় বা কষ্ট কখনো চেপে রাখতে নেই, যত মন খুলে তা প্রকাশ করা যাবে, তত মানসিক সমস্যা কম হবে।

 

 

Writer Amitava Banerjee

— লেখক অমিতাভ ব্যানার্জী Durgapur Steel Plant এর SAIL এ কর্মরত একজন অফিসার। ছোটবেলায় দুর্গাপুরের কল্লোল থিয়েটার গ্রূপের সাথে যুক্ত ছিলেন ।একজন Voracious reader।সিনেমা পাগল মানুষ। জন্ম 1971এর 28 February মানে 47টা শীত পার হয়ে গেছে ।লেখালেখির বয়স খুব বেশি হলে এক বছর।

 

 

 

 

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here