অপরিপক্ব

0
1133
Photo : kisspng.com

সপ্তম শ্রেণীতে পড়িতাম। প্রতিদিন দ্বি-চক্রজানে চড়িয়া বিদ্যালয়ে গমন করিতাম। যে রাস্তা দিয়ে বিদ্যালয়ে গমন করিতাম সেই রাস্তায় প্রায়স’ই একটা বালিকা কে বই হাতে বিদ্যালয়ে গমনরত অবস্থায় দেখিতে পাইতাম। কেন জানিনা, কোন প্রকার কারণ ব্যতীত’ই সেই বালিকার জন্য আমার মনে ভালোবাসা’র এক পরিপূর্ণ সূর্যের উদয় হইয়াছিলো। বালিকা আমাদের বিদ্যালয়ের’ই দশম শ্রেণিতে পড়িতো। বিদ্যালয়ে যাইবার সময় বালিকা’কে যেইদিন দেখিতে পাইতাম না সেইদিন রাস্তায় দাঁড়াইয়া শুধু শুধু আমার দ্বিচক্রজানে’র শৃকল খানা নাড়াচাড়া করিয়া বালিকা’র জন্য অপেক্ষমান থাকিতাম। আর মনে মনে ভাবিতাম আজকে না বালিকা আমি আসিবার পূর্বে’ই বিদ্যালয়ে পৌছিয়া গিয়াছে, না’হয় বালিকা এখনো বাড়ি হইতে বিদ্যালয়ে’র উদ্দেশ্যে বাহির হয় নাই। যেইদিন বালিকা’কে বিদ্যালয়ে দেখিতে পাইতাম না সেইদিন কোন ভাবে’ই নিজের মনকে বিদ্যালয়ে’র গন্ডি’র ভিতর আটকাইয়া রাখিতে পারিতাম না। কাচা বয়সে নিজের বয়সে’র বড় একটা বালিকা আমার ছোট্ট মনে বিরাট জায়গা জুড়ে অবস্থান নিয়াছিলো ইহা নিজে নিজে একা একা ভাবিতাম। লোকে’র বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরে শুনিয়াছিলাম কিন্তু কাচা বয়সে নিজের বয়সের বড় একজনে’র প্রতি কারো ভীমরতি ধরিতে পারে ইহা’র প্রমাণ স্বরূপ নিজেকেই নিজে’র কাছে হাজার বার উপস্থাপন করিতাম। প্রতি রাতে’ই সৃষ্টি কর্তার কাছে সেই রাতটা যাহাতে ছোট্ট একখানা রাত হয় সেই প্রার্থনা করিয়া ঘুমাইতে যাইতাম। পড়ার চৌকা, বিদ্যালয়ে’র বারান্দা, খেলার মাঠ যেখানে’ই যাইতাম সেইখানে’ই বালিকা’র মায়াভরা মুখ খানা আমায় বড্ড বেশী জ্বালাতন করিতো। বিদ্যালয়ে যাইবার সময় প্রায়ইস’ই বালিকার সাথে আমার হালকা-পাতলা চোখা-চোখি হয়তো। একদিন বিদ্যালয়ে যাইবার পর বন্ধুদের সহিত ঝালমুড়ির দোকানে গিয়ে দাঁড়ায়াছি এমন সময় দেখিলাম বালিকা তাহার কিছু বান্ধবী সহিত ঠিক আমার দিক বড়বড় আগমন করিতেছে। ইহা দেখিয়া, উত্তেজনায় আমার প্রাণ ভোমরা উষ্ঠাগতো হইবার পর্যায়ে চলিয়া গিয়াছিলো প্রায়। সেখানে আসিবার পর বালিকা আমার দিকে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি জ্ঞাপন করিয়া আমার কাছে আসিয়া মাথায় হাত বুলাইয়া বলিলো কি গো আমার বান্ধবীদের সাথে নিয়ে আসিলাম কিছু খাওয়াইবা না!

ইহা শুনিয়া আমার বুকের গহীনে আচমকা বিদ্যুৎ খেলিয়া গেলো। মনে মনে আমি তো ইহায় চাইতেছিলাম। বালিকা’র এবং তাহার বান্ধবীদে’র উদর পূর্তি’র জন্য ঢের ঝালমমুড়ি এবং পাশের দোকান হইতে নাড়ু কিনিয়া দিয়াছিলাম। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগিলো – বালিকা কি আমার চোখ দেখিয়া বকের গহীনে যে কথা বাহিরে নির্গত হইবার উদ্দেশ্যে ক্রন্দন করিতেছে তাহা বুঝিতে পারিয়াছে? তা না হইলে বালিকা’র এমন আচরণ! ইহা আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিতে পারি নাই। বুঝতে পারিলাম বালিকা আমার চোখ দেখিয়া বুকের ভাষা বুঝিয়াছে। তারপরেও সব সময় আকু-পাকু করিতাম যে কিভাবে বলিবো বালিকা আপনাকে আমি বড্ড ভালোবাসিয়া ফেলিয়াছি। যদি আপনার মনে কিন্ঞ্চিত যায়গা পাইতাম তাহলে সেইাখানে ঠাই দাঁড়ায়া সৃষ্টিকর্তা’র দেয়া জীবন খানা নিশ্চিন্তে কাটায়া দিতাম। একদিন বিদ্যালয়ে যাইবার পথে বালিকা’কে একা পাইয়া বুকে সাহস লইয়া, আকাশ-বাতাস স্বাক্ষী রাখিয়া, আমি তোমাকে ভালোবাসি বলিয়া’ই বিদ্যালয় অভিমুখে দ্বিচক্রজান ভো টান দিয়াছিলাম। সেই দিন খুব ভয়ে ছিলাম কি হয় – কিয়, এই ভাবিয়া। আমাদের গণিত পাঠদান চলা কালিন সময় দেখিলাম বালিকা তাহার বন্ধবীদের সহিত পাঠদান কক্ষে’র দিকে আসিতেছে। । ভয়ে আমার শরীর খানা ঘামে ভিজিয়া উঠিলো। স্কুল হয়তে বহিষ্কার হওয়াটা হয়তো আর কেহই আটকাইয়া রাখিতে পারিবে না ? বালিকা মাষ্টার মশাই কে আমাকে দেখিয়া দিয়া বাহিরে পাঠাইবার অনুরোধ করিলো। ভাবিলাম এইবার হয়তো সর্ব সম্মুখে অপমানো কেহ আটকাইয়া রাখিতে পারিবে না। মাষ্টার মশাইয়ের নির্দেশ মানিয়া বাহিরে অপেক্ষমান বালিকা গণের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। সকলে সম্মলিত ভাবে আমাকে একখানা খালি কক্ষে নিয়া আসিলো। তাহারা সকলে চৌকা’র উপর বসিলো আমি তাহাদের সামনে অপরাধীর মতো দাঁড়ায়াছিলাম। ব্যাপারখানা এমন যেন আমি একজন রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করিয়াছি আর বিজ্ঞ বিচারিকা গণ আমার এহেন কার্যকলাপে বিচার কার্জ সম্পাদনের উদ্দেশ্যে আমার সম্মুখ মন্ঞ্চে উপবিষ্ট হইয়াছেন। বালিকা আমাকে প্রশ্ন করিলো কিরে পুঁচকে আমাকে ভালোবাসিয়া ফেলিয়াছিস?

আমি বালিকার প্রশ্নো ইচ্ছাকৃত ভাবে উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে ঠাই দাঁড়ায়াছিলাম। বালিকা’র বান্ধবীগণ সকলে গাল টিপা টিপি করিয়া হাসিতেছিলো। এমন মহুর্তে না কিছু ভাবিবার ছিলো না কিছু করিবার ছিলো। দ্বিতীয় বার বালিকা কোন প্রকার প্রশ্ন না সাধিয়া সরাসরি কানে ধরিতে বলিলো। কিছু সময় অতিবাহিতো হয়তে না হয়তেই বালিকা পুনঃরায় কানে ধরিতে বলিলো – না হয় হেড মাষ্টারের নিকট আমার নামে নালিশ করিয়া আমাকে বিদ্যালয় হইতে বাহির করিবার ভীতি প্রদর্শন করিলো। উপায়ন্তর দেখিয়া বালিকার কথা মানিয়া দশবার কানে ধরিয়া উঠবস করিলাম। বালিকা গণে’র বিচার কার্জ সম্পাদনের পর যখন বাহিরে আসিবো তখন বালিকা পেছন হইতে ডাকিয়া বলিলো, এই শোন – আমি পেছনে ফিরিবার পর বালিকা কিন্ঞ্চিত হাসিয়া বলিলো আমায় ভালোবাসিয়া ফেলিয়াছিস, ভালোবাসিতে থাকিস তবে একজন বোন হিসেবে। তুই এবং তোর ভালোবাসা এখনো বড্ড অপরিপক্ব রে! আমাকে ভালোবাসিয়া বিয়ে করিবার মতো মরদ তো এখনো হস’নি। আমাকে বুবু বলিয়া ডাকিস। কথাখানা শোনার পর মনে মনে সৃষ্টি কর্তার নিকট নালিশ করিলাম, হে মহামহিম সৃষ্টকর্তা কেন উক্ত বালিকা’কে আমার পূর্বে দুনিয়া’তে প্রেরণ করিয়াছো- আর কেনো’ই বা সে বালিকা’কে আমার দৃষ্টি’র সীমানায় রাখিয়াছো? পরক্ষণে ভাবিলাম বালিকা’র নিকট আমি এবং আমার ভালোবাসা অপরিপক্ব হইতে পারে কিন্তু বালিকা’র জন্য এই অপরিপক্ব পুঁচকে’র ভালোবাসা পুরোদমে পরিপক্ব ছিলো, ইহাই মহাসত্য। মনোজগৎ হয়তে ফিরিয়া বালিকা’র প্রতি মুচকি হাসিয়া ‘আচ্ছা’ বলিয়া চলিয়া আসিলাম।

তারপর হইতে বালিকার সহিত প্রত্যেকদিন’ই কথা হইতো। তবে ভালোবাসিবার মানুষ হিসেবে নহে একজন পুঁচকে ভাই হিসেবে। ভিতরে ভিতরে বালিকা আমার অন্তরে’র মানুষ হইলেও উপরে উপরে ভাই সাজিয়া থাকিতাম। মনে কিন্ঞ্চিত কষ্ট লাগিতো,
কিন্তু কিছু করিবার ছিলো না। দুধের সাধ অন্ততপক্ষে ঘোলে মিটিতো, ইহাই আমার সান্ত্বনা। এই ভাবে দিন গুলো কাটিয়া যায়তেছিলো। একদিন বিদ্যালয়ের বাড়ান্দাই দাড়াইয়াছি হঠাৎ দেখিলাম বালিকা আমার দিকে আগমন করিতেছে। কাছে আসিয়া’ই বালিকা যাহা বলিলো উহা শুনিবার জন্য নিজের মনকে আগে হইতে প্রস্তুত করিয়া রাখা’র বড্ড বেশী প্রয়োজন ছিলো। বালিকা’র বিবাহ।
আর তাহারই নিমন্ত্রণ করিতে আসিয়াছে আমার নিকট। ইহা শুনিয়া ভিতরটা দুমড়ে-মুচড়ে গেলোও বাহিরে তাহা প্রকাশ করিতে পাড়িলাম না। বাধ সাজিবার জন্য সাহস আটিতে পারিলাম না কারণ বালিকা আগে’ই জানায়াছিলো আমি আর আমার ভালোবাসা তাহার তুলনাই বড্ড বেশী অপরিপক্ব।
তারপর নির্দিষ্ট দিনে বালিকার বিবাহ সংগঠিতো হইলো। নিজের সামনে, নীরবে – নিভৃতে একজন অপরিপক্ব পুঁচকে’র পরিপক্ব ভালোবাসা’র শলীল সমাধী ঘটিলো।

এরপর বহুবছর কাটিয়া গিয়াছে। পিতার ব্যবসালয়ে মহা ব্যাস্ত সময় পারকরিতে ছিলাম। একদিন পিতার অনুপস্থিতি’তে ব্যবসালয়ে হিসাব নিকাশে’র কার্জ সম্পাদন করিতেছি, এমন সময় আমার সম্মুখ হয়তে ছোট্ট শিশু’র ক্রন্দন শুনিতে পাইলাম। মাথা তুলিয়া সামনে তাকাতে’ই নিজের পা হইতে মাথা অবধি বিজলী খেলিয়া গেলো। এ’কি অবস্থা বালিকার? একখানা ছেড়া কাপড়, উস্কো চুল,ঠোটের পাশে ঘা আর কোলে পুষ্টি হীন একখানা শিশু নিয়ে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকাইয়া আছে। আমাকে তাহার দিক মুখ করিতে দেখিয়া’ই কোলে’র বাচ্চা নামাইয়া দৌড়ে আসিয়া আমাকে জরায়া ধরিলো। এক নাগারে অনেক্ষন কাদিলো।
আমি বলিলাম কি হইয়াছে বুবু?
বালিকা কহিলো এক বৎসর হইয়াছে তাহার স্বামী জুয়া খেলিয়া উহার সমস্ত সম্পত্তি বিনষ্ট করিয়াছে। পিতালয় হয়তে বালিকা যাহা নিয়া গিয়াছিলো উহাও উধাও করিয়া ফেলিয়াছে। সর্বশেষ বালিকার অজান্তে নতুন আরেক খানা বিবাহ করিয়া জীবন সাজায়াছে। বালিকার কথা শুনিবার পর আমি কোন কথা বলিতে পারতেছিলাম না। পান্ঞ্জাবী’র পকেট হয়তে যতোটা সম্ভব টাকা বাহির করিয়া বালিকার হাতে ধরায়া বলিলাম আবারো কখনো প্রয়োজন হইলে কোন রকম লজ্জা-শরম না পাইয়া যেনো আমার নিকট আসে। বালিকা চলিয়া যাইবার পর দৌড়ায়া নদীর ধারে আসিলাম। বালিকার এহেন অবস্থা এবং তাহার কথা শুনিবার পর বুকের ভিতরে যে অশ্রুবন্যা হইতে ছিলো তাহা চোখ দিয়া বিসর্জন দিলাম। শৈশবে’র অপরিপক্ব’তা এখন আর নাই বটে । তবে সমাজের নিয়ম ভাঙ্গিয়া, নিজের পরিবারিক সম্মানের মাথা কটিবার মতো সাহস আমার নাই। মিছে বালিকা সে-সময় নিজের জন্য পরিপক্ব কাউকে খুজিয়াছে। অপরিপক্ব কেউ এক সময় পরিপক্ব’তাই পরিণতো হয় ইহা বালিকা’র মাথায় তখন উদয় হইলে এহেন পরিস্থিতি ঘটিতো না বোধয়। বালিকার নিকট আমি এবং আমার অপরিপক্ব ভালোবাসা এখন পরিপক্ব হইলেও – ঢের দেরী হইয়া গিয়াছে। সময় বরাবার’ই দুইজনার সহিত বিড়ম্বনা করিলো। সময়ের আর যথা সময়ে – সময় হয়ে উঠা হইলো না। বুকের বাম পাশে হাত রাখিয়া, চোখের জ্বল নিংড়াই’য়া প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইলাম- যতোদিন বাঁচিবো ততোদিন’ই বালিকা’কে আমার যথা সময়ে’র অপরিপক্বতা এবং অপরিপক্ব ভালোবাসার প্রতিদান দিয়া যাইবো…।

 

লেখক পরিচিতি : মিসবা তুহিন ; জামালপুর,দেওয়াগন্ঞ্জবাংলাদেশ গল্প লিখি। অব্যক্ত যন্ত্রণাহাসিকান্না,প্রেমবিরহ,বাস্তবতার আলোকে কথামালা গাঁথি। ভালো লিখি কিনা মোটেও ভাবিনা। সাহিত্যিক হবো কিনা জানি না। তবে লিখে যাবো আমৃত্যু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here