চোখ খুলে দেখলো, চারিদিকে অন্ধকার, কিছুই মনে পড়ছে না, আবার সে চোখ বন্ধ করলো, এবার ধীরে ধীরে তার মনে পড়লো, সামনে তার ভাইয়ের বিয়ে। কিন্তু সে কোথায়? মনে পড়ছে, হ্যাঁ, ধীরে ধীরে মনে পড়ছে। ওকে ওরা ধরে নিয়ে এসেছিল, তারপর, হ্যাঁ মনে পড়েছে, তারপর তাকে একটা জেলের কুঠুরিতে ঢোকানো হল। হ্যাঁ, সে ওদের বাধা দিয়েছিল, বোঝানোর চেষ্টা করছিল যে তার কোনো দোষ নেই, সে কিছু জানেনা, কিন্তু ওরা শুনলোনা। জোর করে বোঝাতে গিয়ে সামনের একজনকে ও ধাক্কা মেরেছিল, তারপর মাথার পেছন দিকে একটা তীব্র যন্ত্রনা অনুভব করে সে, তারপর আর কিছু মনে নেই। মাথার পেছনে হাত দিল সে, জায়গাটা ফুলে আছে! চ্যাট চ্যাট করছে! রক্ত কি?
হ্যাঁ, এবার ওর স্পষ্ট মনে পড়লো। ওর নাম ডেভিড স্মিথসন, বাবার নাম অ্যাডাম স্মিথসন, ভাইয়ের নাম ড্যানিয়েল স্মিথসন। হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়ে গেছে। ওরা থাকে পোল্যান্ডের ক্রাকাওতে, কিন্তু ওরা আসলে স্কট। ওদের পূর্বপুরুষ প্রায় চারশ বছর আগে স্কটল্যান্ডের এডিনবরা থেকে এই পোল্যান্ডের ক্রাকাওতে লৌহকারের ব্যবসা করতে এসেছিল। এখন ওরা পোল্যান্ডেরই নাগরিক। পোলিশ ভাষাই এখন ওদের মাতৃভাষা, তবে ইংরেজিও ওরা অল্পস্বল্প জানে। ও যদিও বাবার মত সেই লৌহকারের কাজই করে কিন্তু ওদের প্রত্যেক প্রজন্মের দু একজন করে পোল্যান্ডের আর্মিতে যোগ দিয়েছে। এবার ওর ছোট্ট ভাইটা ওই সৈন্যদলে চাকরি পেয়েছে। তাই বাড়িতে ভারী আনন্দ। ভাইটাকে চাকরিতে যোগ দেবার আগে ওর বংশের রীতি অনুযায়ী বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেছে। এইতো যেদিন ওকে ধরে নিয়ে এলো তার পরদিনই তো ভাইয়ের বিয়ে ছিল। কিন্তু ওকে তো ওরা ধরে নিয়ে এসেছে, ভাইয়ের কি হলো?
সমস্যার আঁচ কয়েক দিন ধরেই পাওয়া যাচ্ছিল। গত মাসের আগের মাসের শুরুতে পাশের দেশ জার্মানি, পোল্যান্ড আক্রমণ করে। যুদ্ধ হলো, কিন্তু নামেই, ওই মাসেই রাজধানী ওয়ারস দখল করে জার্মানরা। আর গত মাসের শেষে ক্রাকাও জার্মান অঞ্চল বলে ঘোষিত হলো। কিন্তু ওদের কোনো সমস্যা হয়নি। জার্মানরা শুধু পোলিশ আর ইহুদিদের ধরছে। পোল্যান্ডের স্কটিশ সৈন্যদেরকেই এখন অসামরিক শান্তিরক্ষার কাজে লাগানো হচ্ছে, তাই ভাইয়ের চাকরিটা বোধহয় বহাল থাকবে।
আসলে ওরা তো খ্রিস্চান, তাও আবার ক্যালভিনিস্ট প্রটেস্টান্ট ওদের সাথে জার্মান এভানগালিকাল প্রটেস্টান্টদের ধর্মীয় সম্পর্ক ভালোই। তাই জার্মানরা ওদেরকে কিছু বলে না, বরং সাধারণ কাজকর্ম করতে দিচ্ছে। অবশ্য অনেক স্কটিশই জার্মানির কাছে যুদ্ধে হারতেই পোল্যান্ড থেকে চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, ইয়ুগোস্লাভিয়া, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড হয়ে ঘুর পথে স্কটল্যান্ডে পালিয়ে গেছে, আরো প্রচুর পোলিশও পোলিশ-করিডোর দিয়েই সমুদ্রপথে সুইডেন, ডেনমার্ক হয়ে স্কটল্যান্ডে পালিয়ে গেছে। কারন পোল্যান্ডের সাথে স্কটল্যান্ডের কয়েকশ বছরের রাজনৈতিক সখ্যতা রয়েছে।
কিন্তু, সেদিন কি যে হলো! গত মাসেই এক প্রৌঢ় পোলিশ স্বামিস্ত্রী ওর দোতলা বাড়ির নিচের তলাটা ভাড়া নিয়েছে। সামনে ভাইয়ের বিয়ে, ভাড়ার জন্য ভালো কিছু টাকা তো হাতে আসবে! ভালো মনে করেই তো ওই দম্পতিকে ঘরটায় ও থাকতে দিলো। ওর স্ত্রীও আপত্তি করেনি, যখন ভালো ভাড়া দেবে তখন আপত্তি কিসের? ইস্-স্ যখন বেশি ভাড়ায় থাকতে এককথায় ওই লোকটা রাজি হলো, আর দুমাসের ভাড়া অগ্রিম দিয়ে দিল, তখন যদি একটু সন্দেহ করতো যে লোকটা শিক্ষক পরিচয় দিলেও আসলে পোলিশ রেজিস্ট্যান্সের নেতা, তাহলে কি আর টাকার লোভ করতো?
পরদিন বাড়িতে বিয়ে, তাই সাজো সাজো রব চলছে বাড়িতে, বাবার অবর্তমানে সেই বাড়ির কর্তা। ভাই অনেক ছোট, তার ছেলে মেয়ে তো স্কুলে পড়ে। ভাইকেও সে নিজের ছেলেই ভাবে। তাই কোনো বাবার মত ভাইয়ের বিয়ের সময় তারও অনেক দায়িত্ব, সেই বর কর্তা। বাড়িতে বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনদের যাতায়াত চলছে। চার্চের পাদ্রিকে খবর দেওয়া হয়েছে। ওদিকে স্ত্রী পরদিনের রান্নার তদারকি করছে। ভাই গেছে ব্যাচেলার পার্টিতে। এমন সময় বিকেলবেলা ওরা এলো। হ্যাঁ, ওই জার্মান সৈন্যরা। ওদের দাবি তার নিচতলার ভাড়াটে কোথায়? কিন্তু অনেক খুঁজেও ওরা সেই দুজনকে পেলোনা। তালাবন্ধ দরজা ওরা ভেঙে ফেললো। কিন্তু ঘরে আসবাবপত্র ছাড়া কিছুই পাওয়া গেলোনা, দুজন যেন ভোজবাজির মত উবে গেছে। জার্মানরা তো আর ছাড়বার পাত্র নয়। প্রথমে জিজ্ঞাসাবাদ করলো, তারপর সবার সামনে থেকে ওকে তুলে নিয়ে এলো। কেউ কিছু বলতেও সাহস পেলোনা।
হঠাৎ, ঘরে একটা ছোট্ট হলুদ বাল্ব জ্বলে উঠলো। ওর মনে হলো কে যেন ডাকছে। কয়েকবার আওয়াজ শুনল যেন, “পানি স্মিথসন, পানি স্মিথসন, পানি স্মিথসন, ওঠ” ধীরে ধীরে তার সম্বিৎ ফিরল। একটা উর্দি পড়া লোক, বোধহয় প্রহরী হবে, জার্মান উচ্চারণে তাকেই তো ডাকছে। কি অস্পর্ধা, ওরা ওকে মহিলা বলে সম্বোধন করছে। ওরা কি জানেনা পোল্যান্ডে পানি বলে মহিলাদের উদ্দেশ্যে আর প্যান্যে বলে পুরুষদেরকে, তাছাড়া উচ্চারণে ভুল হতে পারে কিন্তু কাউকে প্যান্যের পর তার পারিবারিক নাম ধরে ডাকা অসভ্যতা এটাও কি ওরা জানেনা? তাও ভদ্র ব্যবহার হত যদি প্যা্ন্যের পর ডেভিড বলতো। নাকি ইচ্ছে করেই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে? আসলে ঠিকমত ডাকা উচিত ছিল প্যান ডেভিড স্মিথসন। সত্যিই জার্মান গুলো অসভ্য।
ও ধীরে ধীরে উঠে বসলো। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। ব্যাথাও করছে। মুখ তুলে দেখলো, গড়াদের বাইরে একটা জার্মান সৈন্য, জামার হাতায় স্বস্তিকাচিহ্ন আঁকা। লোকটা জার্মান উচ্চারণে পোলিশ ভাষায় বললো, ” তোমার সাথে কথা বলতে আমাদের কর্তা হের শ্মিট্ আসছেন, উঠে দাড়াও।” কিন্তু ও উঠবে কি! মাথাটা মনে হচ্ছে ঘুরছে। সে থম মেরে বসে রইল। কিছুক্ষন পর কয়েক জোড়া মিলিটারি বুটের আওয়াজ পাওয়া গেলো।
বুটগুলোর আওয়াজ ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো, বুটের মালিকদের ও এবার দেখতে পেল, দুই জার্মান অফিসার আর খান চারেক সান্ত্রী। তার গড়াদের বাইরে দাঁড়ানো প্রহরীটা, ওদের দেখেই বুটের আওয়াজ করে ডান হাত সামনের দিকে সোজা কিন্তু একটু উঁচু করে,”হাইল হিটলার” বলে চেঁচিয়ে অভিবাদন জানালো। তার উত্তরে অন্যরা সবাই মিলে মাটিতে বুট ঠুকে এত জোরে “হাইল হিটলার” বলে প্রতিঅভিবাদন করলো যে ডেভিড স্মিথসন প্রচন্ড চমকে মুখ তুলে চাইলো।
এবার ওদের মধ্যে সামান্য হুড়ো হুড়ি পরে গেল, কোথা থেকে একটা টেবিল আর দুটো চেয়ার এনে ওই দুই অফিসারকে বসানো হলো। ওরা বসার পরে, ডেভিড শুনল, ওই দুই জার্মান অফিসারের মধ্যে যে অপেক্ষাকৃত নিচু পদের বলে ওর মনে হলো, সে জার্মান ভাষায় ওই প্রহরীকে কি যেন আদেশ করলো। ডেভিড জার্মান জানে না, তবে কদিন হলো শুনে শুনে অল্প স্বল্প আন্দাজ করতে পারে। ওর মনে হলো ওরা ওর গড়াদের দরজা খুলতে বললো। একথা মনে হতেই, ও আরো ভালো করে ওদের কথা শোনার জন্য সোজা হয়ে বসলো।
ঠিক তাই, ও ঠিকই আন্দাজ করেছে, মুক্তির আশায় ওর চোখগুলো চকচক করে উঠলো, যাক! বাড়ি ফেরা যাবে, কতটা সময় ও অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল ও বুঝতে পারছেনা, ভাইয়ের বিয়েটা কি হচ্ছে? ও কি সুষ্ঠুভাবে বিয়ে দেখতে পাবে? কে জানে? ওর পরিবারের খবর কি? এরা কি ওকে বলবে?
কিন্তু, দরজা তো ওরা খুলে দিল ঠিকই, তারপর এটা কেমন হলো!? ওরা ওকে না বার করে নিজেরাই ভেতরে ঢুকে এলো, তারপর ওর হাতদুটোতে হাতকড়া পড়ালো। অবশ্য তারপর ওকে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে ঠেলে কুঠুরির বাইরে আনলো। তবে কি ওরা ওকে ছাড়বে না? ধ্যাৎ! ওদের কথা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
ডেভিড কে ওই দুই অফিসারের সামনে দাঁড় করানো হলো। ওর মাথার পেছনটা তখনো যন্ত্রনায় দপ দপ করছে। মাথার ভেতর ঝিম ঝিম একটা ভাব নিয়ে ও কোনো মতে সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করলো। এতক্ষন দুজন সান্ত্রী ওকে ধরে ছিল, এবার ওরা ওকে ছেড়ে দিলো, আর সাথে সাথে ও ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল।
সঙ্গে সঙ্গেই ডেভিড শুনল ওই বড় অফিসারটা কাদের যেন খুব জোরে ধমক দিলো। সাথে সাথেই তাকে ওই সান্ত্রী দুজন আবার তুলে দাঁড় করালো। এবার ওই বড় অফিসারটা কি একটা নির্দেশ দিল, তখনই আর একটা চেয়ার এনে হাত বাঁধা অবস্থাতেই ওকে তার ওপর বসানো হলো। আরো কি নির্দেশ এলো এবার কেউ একজন ওর সামনে একটা জলের গ্লাস ধরলো। ও মুখ তুলতেই ওর ঠোঁটের ফাঁকে গ্লাসটা ঢুকিয়ে দিলো। ঢক ঢক করে ও গ্লাসের জলটা খাবার চেষ্টা করলো। অনেকটাই গলায় গেল, বাকিটা ওর দুদিকের কশ বেয়ে নেমে এসে ওর স্ট্রোযে লুডো মানে, গায়ের জামা আর পাজামা ভিজিয়ে দিলো, ইসস! এটা ভাইয়ের বিয়ের জন্য অনেক দাম দিয়ে নতুন বানানো, কাল থেকে মাটিতে শুয়ে এটার কি অবস্থা হয়েছে! জল খেতেই ওর পেটটা খিদের চোটে গোলাতে শুরু করলো।
এবার ছোট অফিসারটা ওকেই উদ্দেশ্য করে কথা বললো, লোকটার কথায় জার্মান টান আছে ঠিকই কিন্তু পোলিশ ভাষাটা ভালোই শিখেছে। অফিসারটা ওকে বললো, “তুমি কি প্যান ডেভিড স্মিথসন?” ডেভিড মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। এবার ওই অফিসারটাই বললো, ” আমি লয়ত্ন্যান্ট(লেফটেন্যান্ট) মুল্যা আর ইনি হাওপ্ট(মেজর) শ্মিট্। হের শ্মিট্ তোমাকে কিছু বলবেন।”
হের হাওপ্ট শ্মিটের বয়স ডেভিডের মতোই, মোটামুটি চল্লিশের আসে পাশেই হবে, চেহারা দেখে বেশ উঁচু ঘরানার লোক বলেই মনে হয়, এ কিন্তু একদম স্পষ্ট পোলিশ ভাষায় বললো, “শুনুন প্যান স্মিথসন, আমাদের কাছে নির্দিষ্ট খবর এসেছে যে আপনি কিছুই জানেন না ওই পোলিশ রেজিস্ট্যান্স নেতার সম্বন্ধে, আপনাকে ওরা ঠকিয়েছিলো। আপনার ভাই যেহেতু জার্মান সরকারের চাকরি করে, তাই তার লিখিত অনুরোধে ক্রাকাও ক্রাইস (ক্রাকাও ডিস্ট্রিক্ট) এর অধিকর্তা আপনাকে মুক্তি দেবার নির্দেশ দিয়েছেন।”
কথাটা শুনেই ডেভিড তো একেবারে চাঙ্গা হয়ে উঠলো, যাক! নিশ্চিন্ত! ওরা ওকে ছেড়ে দেবে। ডেভিড জিজ্ঞেস করলো, “আমি কতক্ষন এখানে আছি?” হের লয়ত্ন্যান্ট মুল্যা বললো, “এই আজ নিয়ে দুদিন হবে।” ডেভিড বুঝলো না ওর ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে না হয়নি? ও আবার জিজ্ঞেস করলো, “আমার ভাই ড্যানিয়েলের বিয়ে…” ওর কথা শেষ হবার আগেই উত্তর এলো, “না হয়নি, বিয়ে মুলতুবি রয়েছে।” কথাটা শুনে ডেভিড যারপরনাই উচ্ছসিত হয়ে উঠলো। হের শ্মিটের চোখের ইশারায় সান্ত্রীরা ওর হাত খুলে দিল। আনন্দের অতিশয্যে ডেভিড বলে বসলো, “জার্মানরা এমনিতে ভালো কিন্তু বড্ড গোঁয়ার, কত করে বললাম, আমি কিছু জানিনা, কিন্তু জার্মান গাধাগুলোর মাথায় ঢুকলে তো!”
হঠাৎ, যেন ডেভিডের মনে হলো ঘরটা কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেল। একটা পিন পড়লে যেন তার শব্দ কানে বাজবে, এতো নিস্তব্ধ। ও চারিদিকে তাকিয়ে দেখল চোদ্দ জোড়া চোখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখের বিস্ময় আর ক্রোধ যেন ওকে বিদ্ধ করছে।
ডেভিড ওদের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিজের মারাত্মক ভুল উপলব্ধি করতে পারলো।
কয়েকটা মুহূর্তে যেন কয়েক শতাব্দী পার হয়ে গেল! ডেভিড নদীতে ভেসে যাবার আগে খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টার মত দিগ্বিদিগ জ্ঞানশূন্য হয়ে ঝাঁপিয়ে টেবিলের ফাঁক দিয়ে হের হাওপ্ট শ্মিডের বুট শুদ্ধ পা জড়িয়ে ধরলো। ধরেই চিৎকার করে বলতে থাকলো, “সেপ্রাসাম, সেপ্রাসাম, আমাকে ক্ষমা করুন, আমাকে ক্ষমা করুন!”
হাওপ্ট শ্মিট্ কিন্তু ধীর শান্ত ভাবে সান্ত্রীদেরকে ডেভিডকে ধরে তুলতে আদেশ করলো এবং ওকে তোলা হলে আবার ওর নির্দিষ্ট চেয়ারে বসাতে বললো। ডেভিড তখন নিজের কৃতকর্মের ভয় কেঁদেই চলেছে আর থর থর করে কাঁপছে, মাথা তুলতেই ভয় করছে। জার্মানরা এখন তাদের প্রভু আর তারা যে কত নিষ্ঠুর তা কে না জানে? তাদেরকেই কিনা সে মুখের ওপর গোঁয়ার আর গাধা বলে ফেললো! এটা বোধহয় ওর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। ওরা তো বোধহয় ওকে ছাড়বেই না, তার ওপর আরো কতরকমের যে শাস্তি কপালে আছে যীশুই জানেন।
হের শ্মিট্ কিন্তু কিছুক্ষন ওকে লক্ষ্য করলো, তারপর খুব ঠান্ডা বরফ শীতল গলায় বলল, “কি? জার্মানরা গোঁয়ার না গাধা ঠিক করে বলুন।” ডেভিড হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে আবার ক্ষমা চাইতে থাকলো। ও আবার উঠে গিয়ে শ্মিটের পায় পড়ার চেষ্টা করল কিন্তু দুজন সান্ত্রী ওকে চেপে বসিয়ে দিল। এবার হের শ্মিট্, হের মুল্যার দিকে ফিরে বললো, “কি লয়ত্ন্যান্ট একে কি করা উচিত? মুল্যা বললো,”আমাদের পিতৃভূমির সন্তানদের এ অপমান করেছে, এর তো শাস্তি অনিবার্য। এখন এটা আপনার বিচার্য্য, একে এখানে শাস্তি দেবেন না আমাদের মিলিটারি কোর্টে পাঠাবেন।” শ্মিট্ আবার কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো, তারপর বলল,”নাঃ, এ আমার সামনেই অন্যায় করেছে, আবার আমার কাছেই ক্ষমা চেয়েছে, একে শাস্তি দিতে হলে আমিই দেব। এবার তোমরা বল এর কি শাস্তি হতে পারে? সৈন্যরা তোমরা আগে প্রস্তাব দাও।”
সৈন্যরা নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এবার হের মুল্যা তাদেরকে বললো,”হের হাওপ্ট শ্মিট্ যখন অনুমতি দিচ্ছেন, তোমরা বলো। প্রহরী তুমি আগে বলো। তারপর র্যাঙ্ক অনুযায়ী বলবে।”
প্রহরী প্রস্তাব দিল, “ওকে গুলি করে মারা হোক।” ডেভিড চমকে উঠলো। হের শ্মিট্ কিন্তু মাথা নেড়ে বললেন, “না, মেরে ফেলা চলবে না, অন্য কিছু।” এবার প্রথম সান্ত্রী বললো,”ওকে, বেয়নেট দিয়ে খোঁচানো হোক।” ডেভিড কঁকিয়ে উঠলো। হের শ্মিট্ ফের মাথা নেড়ে জানালেন,”চলবেনা, ওতে মরেও যেতে পারে।” দ্বিতীয় সান্ত্রী মত দিলো,” উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হোক।” ডেভিডের মাথার পেছনে যন্ত্রণাটা যেন হঠাৎ বেড়ে গেলো। হের শ্মিট্ এবারেও মাথা নেড়ে বললো, “নাঃ, ওতেও মরতে পারে।” তৃতীয় জন দৃঢ়তার সাথে লাঠিপেটা করতে বললো, ডেভিড কিছু বোঝার আগেই তা নাকচ হয়ে গেল। এবার চতুর্থ ও শেষ সান্ত্রী ডেভিডকে চাবকাবার প্রস্তাব দিল, ডেভিডের মাথা ঝিম ঝিম করতে শুরু করলো, কিন্তু শ্মিট্ বললো এটা নাকি বহু পুরোনো পদ্ধতি, তাই চলবেনা।
এবার শ্মিট্ মূল্যার দিকে ফিরে বললো, “সবাই তো পুরোনো পদ্ধতি বলছে, নতুন কিছু বলো।” মুলার্ বললো, “হের হাওপ্ট শ্মিট্ ওর মাথাটা জলে ডুবিয়ে জল খাওয়ানো হোক, দম বন্ধ হয়ে ছটফট করলেই তুলে নেওয়া যাবে, এরকম কয়েকবার করলেই ব্যাটার উচিৎ শাস্তি হবে।” হের শ্মিট্ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলো, এদিকে ডেভিডের তো অবস্থা শোচনীয়। অবশেষে শ্মিট্ বললো, “ভালো প্রস্তাব, তবে জলের বদলে মদ ব্যবহার করা হোক, কি বলো? পোলিশরা তো পৃথিবী বিখ্যাত মদ্যপ্রেমী তাই না?” কথাটা শুনেই ডেভিড ভয় চেঁচিয়ে উঠলো, বলতে থাকলো, “সেপ্রাসাম, সেপ্রাসাম, দয়া করুন, দয়া করুন, আমরা ক্যালভিনিস্ট টিটোটলার, আমাদের মদ ছোঁয়া পাপ, আমি নিষ্ঠাবান খ্রিস্চান, আমাকে জল দিয়ে মারুন, মদ দেবেন না।” শ্মিট্ হো হো করে হেসে উঠলো, বললো, “পোলিশ আবার মদ খায়না, এ আবার হয় নাকি?” ডেভিড কেঁদে বললো,”আমরা পোলিশ নই স্কটিশ। আমরা টিটোটলার, আমাদের পূর্বপুরুষের রীতিতে আমরা মদ ছুঁতেও পারিনা।” শ্মিট্ হাসতে হাসতে বললো,”তাহলে তো মদেই আপনাকে ডুবিয়ে শুদ্ধ করতে হবে। আমাদের পিতৃভুমির অপমানটা পরিষ্কার করতে হবে না?” মুল্যা বললো, “হের শ্মিট্, প্রস্তাবটা খুব ভালো, কিন্তু এতো মদ কোথায় পাওয়া যাবে।”
হের শ্মিট্ কথাটা শুনল, তারপর হের মুল্যার কানের কাছে গিয়ে কি যেন বললো। হের মুল্যার ঠোঁটের কোনায় একটা হাসির রেখা যেন দেখা গেল। হাসিটা ডেভিডের চোখ এড়ালোনা। হাসিটা দেখে কিসের আশঙ্কায় যেন ওর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। মুল্যা তৎক্ষণাৎ একজন সান্ত্রীকে ডেকে ফিস ফিস করে জার্মান ভাষায় কি নির্দেশ দিল। সান্ত্রীটি চলে গেল।
এবার হের শ্মিট্ ডেভিডকে উদ্দেশ্য করে বললো, “দেখুন প্যান স্মিথসন, আপনি আমাদের অপমান করেছেন, কিন্তু আমরা কত ভদ্র আর মানবিক দেখুন, আপনার ওপর কোনো শারীরিক অত্যাচার করছিনা। আমি আর আপনি প্রায় সমবয়সী, আমি শ্মিট্ আপনি স্মিথসন, আমদের দুজনেরই লৌহকার বংশে জন্ম, জানেন তো স্মিথ আর শ্মিট্ দুটো শব্দের অর্থই লৌহকার। তাছাড়া ক্রাকাওতে লৌহকার হিসেবে আপনার বেশ সুনাম আছে, আর আপনার ভাই জার্মান সরকারের বেতনভুক। তাই আপনার ওপর আমরা কোনো অত্যাচার করবোনা। শুধু আজ আমাদের জার্মানদের এই মানবিকতাকে আমরা একটু সন্মান জানাবো। আপনি আমাদেরকে অপমান করা সত্ত্বেও যদি আমাদের এই মহানুভবতাকে সন্মান জানান তাহলেই আপনার মুক্তি। কি রাজি তো?”
ডেভিডের হাঁটু দুটো যেন ওর বশে নেই, ওদুটো থর থর করে কাঁপছে, এদিকে মনে হচ্ছে যেন ওর পেটে প্রস্রাবের চাপ লাগছে। কোনোমতে ডেভিড ওর মাথাটা সম্মতিসূচক ওপর নীচ করলো। ঠিক এইরকম সময় সান্ত্রীটি একটি চামড়ার ফৌজি ব্যাগ হাতে ফিরে এলো। ব্যাগটা সে টেবিলের ওপর রাখলো। ঠক করে একটা আওয়াজ হলো।
শ্মিট্ মুল্যাকে চোখের ইশারা করতে, সে ব্যাগটা খুলে তিনটি বড় পানীয়ের বোতল বার করলো। শ্মিড বোতল তিনটি তুলে ভালো করে দেখল। ডেভিড শুধু দেখছে, ওর বোধে কিছুই কুলাচ্ছে না। তারপর শ্মিড ডেভিডের দিকে ফিরে বললো, “আপনি তো স্কটিশ তাই স্কচ হুইস্কি এনেছি, এদিকে আপনি আবার পোল্যান্ডের অধিবাসী তাই পোলিশ ওয়দকা(ভদকা) নিয়ে এসেছি, আপনারা যেন অন্য একটা কি বলেন একে? ও হ্যাঁ, গরজালকা না কি যেন। তাইনা, ঠিক বললাম তো?” ডেভিড যন্ত্রের মত মাথা নাড়লো। ও তখন মনে মনে নিজের বাবার কথা ভাবছে। তার মাঝে কতবার যে যীশুকে স্মরণ করছে তারও কোনো হিসেব নেই।
শ্মিট্ এবার মুল্যাকে আবার কিছু নির্দেশ দিল, সাথে সাথে মুল্যার আদেশে একজন সান্ত্রী এসে বোতল গুলো খুলে দিল। শ্মিট্ ডেভিডের উদ্দেশ্যে বললো,”একটা বোতল স্কচ, একটা ওয়দকা, অন্যটা কি বলুন তো?” ডেভিড প্রশ্নটার কিছুই বুঝতে না পেরে শ্মিটের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। শ্মিট্ হাসতে হাসতে বললো,”বুঝলেননা? এটা খালি। আসলে আপনি যেমন একইসাথে স্কটিশ আর পোলিশ, আজকে আমাদের পানীয়ও হবে স্কটিশ আর পোলিশের মিশেল।” এবার শ্মিটেরই নির্দেশে সান্ত্রীটা ওয়দকার বোতল থেকে ওই খালি বোতলে প্রায় অর্ধেক ঢালল। তারপর স্কচের বোতল থেকে অর্ধেক স্কচ ওই বোতলেই ঢালল। এবার বোতলটার ছিপি বন্ধ করে ওটাকে ঝাঁকালো। তারপর বোতলটা শ্মিটের সামনে রাখলো।
শ্মিট্ বোতলটা ভালো করে দেখল, তারপর ডেভিড কে বললো,”নিন, এই বোতলটা এক দমে খেয়ে ফেলুন তো। এটা খেয়ে যদি নেশাগ্রস্ত না হন আর যদি বমি না করেন তাহলেই আপনি হেঁটে বাড়ি চলে যেতে পারবেন।” ডেভিড কথাটা শুনে হাউমাউ করে বললো,”দয়া করুন, দয়া করুন আমায়! আমি পারবোনা। হের শ্মিট্, আমি টিটোটলার, আমি মদ খেলে আমার পাপ হবে, আমি শয়তানের দাস হব। আমাকে ক্ষমা করুন। আমি পারবোনা।”
শ্মিট্ হিমশীতল গলায় বললো, “পারবেননা? তাহলে কিন্তু মুক্তিও পাবেননা, নেহাৎ আপনার নামে গভর্নর এর আদেশ আছে, নইলে আপনার অন্যায়র শাস্তি কী আপনি ভাবতেও পারবেননা। আর আপনার অন্যায়ের জন্য আপনার ভাইয়ের চাকরি তো যেতই, তাকে আর আপনার বাকি পরিবারকেও ধরে আনতাম, তারপর তাদের কি হতো, তা বোধহয় আপনাকে বলে দিতে হবেনা।” ডেভিডের মনে হলো ওর পাজামাটা যেন ভিজে গেল, অনেকক্ষন চেপে ছিল, আর পারলোনা।
জার্মান অফিসার দুজন হেসে উঠলো। সৈনিকরাও ফিকফিক করে হাসতে থাকলো। ডেভিডের মনে হলো, ও কেন মড়ে যাচ্ছে না?
ওর দুচোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো, কিন্তু ভয়ে মুখে শব্দ বেরোলনা। ওর পরিবারের জন্য ওর চরম দুশ্চিন্তা হতে থাকলো। ও নিজের মনেই নিজের দুর্ভাগ্য নিয়ে ভাবতে থাকলো। পোল্যান্ডের বাদিন্দা হওয়ায়, ও ভালো করেই জানে যে এই পানীয় গুলি পুরো এক বোতল বিনা জলে খেলে কি হয়। পোলিশরা পান করতে ভীষন ভালোবাসে, এ তাদের একটা জাতীয় স্বভাব, তারাই এগুলো বিনা জলে এক বোতল পুরো খেলেই সুস্থ থাকে না, আর ও তো ক্যালভিনিস্ট টিটোটলার প্রটেস্টান্ট খ্রিশ্চান, ওরা তো বহু পুরুষ ধরে মদ ছুঁয়েও দেখেনি। এমনিতেই ও গত পরশু থেকে খালি পেটে রয়েছে, তার ওপর এমন পৃথিবী বিখ্যাত দু রকমের পানীয়কে সমান সমান মেশানো হয়েছে, তাও জলছাড়া একটা পুরো বোতল! এ যদি ওর পেটে যায় তবে নির্ঘাৎ মৃত্যু।
অবাক কান্ড! মৃত্যুর কথা যেই ওর মনে এলো, ও কিছুটা আশ্বস্ত হলো, ও যদি মড়ে যায় তবে এক দিক থেকে নিশ্চিত, ওর পরিবারটা বেঁচে যাবে বোধহয়। তাছাড়া মদ্যপান করে ওর যা পাপ হবে তার জন্য ও তৎক্ষণাৎ সরাসরি ঈশ্বরের কাছে গিয়েই ক্ষমা চাইতেও পারবে। ডেভিড ধীরে ধীরে সোজা হয়ে বসলো।
এদিকে শ্মিট্ তখনো বলে চলেছে, “কি ভাবছেন? পান করবেন কি করবেননা? হাঃ হাঃ, কোনো ব্যাপার নয় আমরা অপেক্ষা করছি, বল এখন আপনার কোর্টে, আপনি যদি পান করেন তবে মুক্তি পেতে পারেন, না করেন তবে ওই দশ-দশের খুপরিতেই ফিরে যেতে হবে। আর আপনার পরিবারের উপযুক্ত ব্যবস্থা আমরা করবো। অবশ্য পান করে নেশাগ্রস্ত হওয়া বা বমি করে চলবেনা, তাহলে কিন্তু আবার ওই খুপরি।” ডেভিড কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো, ওর মাথার পেছনের যন্ত্রণাটা ও আর অনুভব করছেনা। আস্তে আস্তে ও মাথাটা উঁচু করলো। সোজা শ্মিডের চোখের দিকে তাকালো। ওর আর ওর পরিবারের বন্দিত্ব আর ওর যেকোনো রকম মুক্তির মাঝে শুধু ওই একটা বোতল অপেক্ষা করছে।
শ্মিট্ এবার বললো, “দেখুন এই বোতলটা নিজে থেকে না খেলে কিন্তু আমরা আপনাকে খুপরিতে ঢোকাবার আগে আপনার গলায় এই বোতলটা তো ঢালবোই, এই বাকি পানীয় গুলো মিশিয়ে আরেকটা বোতলও আপনাকে খেতে বাধ্য করবো। এবার আপনার ইচ্ছে।”
ডেভিড ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো, তারপর এগিয়ে গিয়ে বোতলটা তুললো, ওর মনে হলো ও ওর নিজেরই বরফ ঠান্ডা মৃতদেহটার গলা ধরে নিজেই তুলছে। শ্মিট্ বললো, “যাক, তাহলে আপনি মুক্তি চান। ভেবে দেখুন আপনি কিন্তু নরকে শয়তানের কাছে যাবেন।”এই শুনে বাকি সবাই হেসে উঠলো। ডেভিডের ঠোঁটের ফাঁকেও যেন একটা হালকা হাসির রেখা দেখা গেল। ও বোতলটা খুলল, তারপর ওর পেছন ফিরে ওর চেয়ারের দিকে এগোতে গেল। শ্মিট্ সাথে সাথেই ওকে আদেশ করলো,”না, বসবেন না, আপনাকে দাঁড়িয়েই পুরো বোতল পান করতে হবে, বোতল নামাতে পারবেননা, একদমেই পান করতে হবে।” ডেভিড আবার শ্মিটের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো।
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ও প্রথমে শ্মিটের চোখের দিকে আবার সরাসরি তাকালো, ও সেখানে মৃত্যুকে দেখবে আশা করেছিল কিন্তু তার বদলে ও যেন সেখানে একরকম অনিশ্চয়তা লক্ষ্য করলো। এবার মনে মনে ও “দা হোলি ট্রিনিটি”বা “ত্রৈৎযা সুইয়েন্তা” কে স্মরণ করলো, “ঐযেৎস(দা ফাদার), সেইন(দা সন), দুখশ সুইয়েন্তে(দা হোলি স্পিরিট)।” তারপর বোতলটা তুললো, তুলে সরাসরি বোতলের মুখটা ওর নিজের মুখে ঢোকালো।
একটা প্রচন্ড বিশ্রী গন্ধযুক্ত তিতকুটে ঝাঁঝালো তরল ডেভিডের মুখগহ্বর আর জিবকে অসার করে ওর গলা দিয়ে নামতে শুরু করলো। প্রথম ঢোক টা দেবার পর ওর মনে হলো ওর গলাতে যেন আগুন জ্বলে উঠলো। ওর বাবার মুখটা ওর মনে পড়লো, তিনি ওকে ওর ছোট্ট ভাইটাকে মানুষ করার দায়িত্ব দিয়ে মারা গেছিলেন। ও আরো ঢোক গিলে আরো তরল গলার ভেতর পাঠাতে থাকলো, ওর জিব গলা, বুক, পেট সব যেন পুড়ে যাচ্ছে। ওর মনে পড়লো ও মুক্তি পেলে ওর ভাইটার বিয়ে হবে, ওর জন্য ওর ভাইটা নিজের ভবিষ্যৎ বাজি রেখে জার্মান গভর্নরের কাছে ওর মুক্তিভিক্ষা চেয়েছে, ও না ফিরলে ওর ভাইকেও হয়তো ওরা বন্দি করবে। ও আরো আরো তরল গিলতে থাকলো, ধীরে ধীরে ওর শরীরের ভেতরের জ্বলুনি চলে গিয়ে যেন অনুভূতিহীন হতে শুরু করলো। ওর কিন্তু থামা চলবেনা, থামলেই ওর স্ত্রী আর ছেলে মেয়ে দুটোকে ওরা ধরবে।
ও মনকে বোঝাতে থাকলো যে ও জল খাচ্ছে। ঠান্ডা, সুশীতল, পরিশ্রুত, ক্রাকাওর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পোল্যান্ডের প্রধান নদী উইস্লা(ভিস্টুলা)জ্বেকার জল। ওকে এই তরলটা গিলে চলতেই হবে। ওরা যদি ওর ভাইকে ওর স্ত্রীকে ওর সন্তানদেরকেও এইটা খাওয়ায়! না! না! ওকে মুক্তি পেতেই হবে। ওর মনে হলো ওর শরীরের সব অনুভূতি যেন উধাও হয়ে গেছে। মাথার মধ্যে আগের সেই যন্ত্রনা নেই, তার বদলে একরকম আচ্ছন্ন ভাব ওকে গ্রাস করছে। নাআআআআ! ওকে স্থির থাকতেই হবে, ওর সন্তানদের মুখ ওর মনে পড়লো, ছেলেটা দশ, মেয়েটা সাত, ওদের যদি এরা অত্যাচার করে! ওরা তো ছোট, ওরা তো মরেই যাবে। সন্তানদের মৃত্যুর কথা ওর মনে আসতেই ও অনেকটা মদ গিলে নিলো।
আর ভয় নেই, ও বোতলটা প্রায় শেষ করে এনেছে, কিন্তু ওর পা দুটো এমন কাঁপছে কেন? “স্থির হও, স্থির হও, তোমার এখন মাতাল হলে চলবেনা, তোমার স্ত্রীসন্তান আর ভাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে” ডেভিড নিজেকে মনে মনে বলতে থাকলো। বোতলের শেষ বিন্দুটা ওর গলায় চলে গেল আর ওর পেটের মধ্যে একটা যন্ত্রনা শুরু হলো। সব কিছু যেন ওপরে উঠে আসতে চাইছে। ওর স্ত্রীর মুখটা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠলো, তাদের বিয়ের সময় বিয়ের পোশাকে আর ক্রাকুস্কা টুপিতে ওর নতুন বউকে কি সুন্দর লাগছিল, ঠিক যেন একটা পুতুল। একে ওরা অত্যাচার করবে! ওর পেটের যন্ত্রণাটা কেন জানি আর অতটা অসহ্য মনে হচ্ছে না।
ও বোতলটা আস্তে আস্তে টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলো। তারপর ধীরে কিন্তু দৃঢ় পায়ে দরজার দিকে চলতে থাকলো। ও লক্ষ্য করলো না সেই চোদ্দটা চোখ আবার অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে চেয়ে আছে। ডেভিড সোজা হয়ে প্রতিটি মাপা পদক্ষেপ ফেলে বাইরে দিনের আলোয় বেরিয়ে এলো, তারপর রাস্তায় এসে একটা ব্রিজকা(ঘোড়ার গাড়ি)কে হাত তুলে ডেকে তাতে চড়ে বসলো। গাড়ির দরজাটা বন্ধ করে ও শরীরটা সিটের ওপর এলিয়ে দিলো। বেশ কিছুদূর যাবার পর ও একটা ফাঁকা জায়গা দেখে গাড়িটা থামাতে বললো তারপর দরজা খুলে নেমে এসে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে নিচু হলো। এবার পেটে ওর যা কিছু ছিল সব বমি হয়ে বেরিয়ে এলো।
আহঃ, মুক্তি! এবার ও ভাইকে আর জার্মানদের চাকরি করতে দেবে না, ওরা সপরিবারে যে করেই হোক স্কটল্যান্ডে চলে যাবে।
অমিতাভ_ব্যানার্জী
— লেখক অমিতাভ ব্যানার্জী Durgapur Steel Plant এর SAIL এ কর্মরত একজন অফিসার। ছোটবেলায় দুর্গাপুরের কল্লোল থিয়েটার গ্রূপের সাথে যুক্ত ছিলেন ।
একজন Voracious reader।সিনেমা পাগল মানুষ। জন্ম 1971এর 28 February মানে 47টা শীত পার হয়ে গেছে ।লেখালেখির বয়স খুব বেশি হলে এক বছর।
লেখকের আরো লেখা পড়তে ক্লিক করুন "গোপালকৃষ্ণ বাবুর পেন " " স্বাধীনতার ভোজ "
[…] আরো লেখা পড়তে ক্লিক করুন " মুক্তি_যুদ্ধ " "গোপালকৃষ্ণ বাবুর পেন " " স্বাধীনতার […]
[…] পড়তে ক্লিক করুন "হিন্দি_হ্যায়_হাম" " মুক্তি_যুদ্ধ " "গোপালকৃষ্ণ বাবুর পেন " " স্বাধীনতার […]