নিজো আবার বিয়ে করেছে। এই পক্ষে একটি মেয়ে। এখন এখানেই থাকে আমাদের পাড়ার পাশের পাড়ায় কোথাও। কয়েকবার দেখেছিও ওর এখনকার বর কে। মেয়েটিকে দেখতে একদম নিজোর ছোটবেলার মতো।
আমার এখন আর সে ভাবে বাড়ি থেকে হয়না। কাজের সূত্রে বাড়ির বাইরেই দিন কাটে। যেটুকু খবর কানে আসে , তা পাই , কাকিমা দের কাছ থেকে। মাঝে মাঝে নিজোর গলা শোনা যায় , কিন্তু কথা বলার ইচ্ছে তা যেন হারিয়েছি।
অনেক গুলো বছর পেরিয়ে গেলো। আমি এখন বিবাহিত। একটি মেয়ের মা। এবারের দোলযাত্রায় বাপের বাড়ি এসেছিলাম। দেখা হলো নিজোর সাথে ,ও নিজের মেয়েকে আমার মেয়ের সাথে আলাপ করালো। ওর মেয়ে প্রায় অনেকটাই বড় হয়েছে স্কুল এ যায়। আমার মেয়ে সবে কয়েক মাস , জানলার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে যখন ওদের বাড়ির দিকে , খুব কথা বলে ওরা।
এখন কয়েকদিন যাবৎ প্রায় ওদের বাড়িতে ঝগড়া অশান্তি , লেগেই থাকে। রাত যত বারে , ওর মাতাল স্বামী , ওর বাপেরবাড়ি এসে হানা দেয় , আর চিৎকার চেঁচামেচি শুরু। পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি ছোট্ট মেয়েটিকে। ভাবি একি আদৌ জানে , এর একটি বড় দাদা আছে , না সেই দাদা জানে তার একটি ছোট্ট বোন এভাবে বড় হচ্ছে।
বাড়িতে বছরে এখন দুবার কখনো একবার যাওয়া হয় , প্রতিবার নিজোর সাথে দেখা না হলেও , ওদের বাড়ি থেকে ওর গলা আর র ওর মেয়ে কে ছাদের ওপর থেকে দেখি। এক বছর পর , এবার দেখলাম বেশ বড় হয়েছে , একা একা সাইকেল ও চালাতে পারে। দেখতেও ভারী মিষ্টি , স্কুলে যায়। সব সময় মামা র বাড়িতে থাকতেই দেখি। নিজো মনে হয় দু বাড়িতে যাতায়াত করে। মা কে জিগেস করলাম ওদের ব্যাপারে , মা বললো জানেনা।
একদিন সন্ধ্যেবেলা ফিরছিলাম একা অটো করে ঝালমুড়ি খেতে খেতে , হঠাৎ , মাঝ পথে একটি মেয়ে পাশে চড়ে বসলো। প্রথমে খেয়াল করিনি , পরে দেখলাম নিজো। “আরে কি ব্যাপার !!কোথায় গেছিলি ” বললো নিজো। আমি বললাম “এই তো চোখের চেক-আপ ছিল , তাই ডাক্তার দেখিয়ে ফিরছি। ঝালমুড়ি খাবি?”
একটু ঝালমুড়ি শেয়ার করলাম। খেলো। তারপর বললো “তুই তো শহরের বাইরেই থাকিস , কতদিন হয়ে গেলো , তাই না? আচ্ছা , তোদের তো অনেক বড় শহর , অনেক বড় বড় সব বাড়ি , মল , কত দোকান পত্র। “আমি বললাম “হ্যাঁ , ওই একটু। কেন বলতো ?”
না মানে, আমি না , কাজ খুঁজছিলাম। এখানে কলকাতার মল গুলোতে অনেক খুঁজেছি , সেরকম পাচ্ছি না রে। দেখ না তোদের ওখানে মল এ বা কোথাও যদি কোনো কাজের খবর পাস , আমাকে একটু বলিস প্লিজ। ”
আমি ওকে বুঝিয়ে বললাম ” এখানে , কলকাতায় তো সব অনেক সস্তা , অন্তত খেয়ে পরে বেঁচে থাকবি , বাইরের শহর বাইরে থেকে যত ঝা চকচক লাগুক না কেনা , সেখানে থাকতে খেতে পড়তে যা লাগবে , তা ওই সামান্য টাকায় কুলাবে না ”
জানিনা সেইদিন ও কি ভাবলো , হয়তো ভাবলো কাজের খোঁজ দিতে পারবোনা তাই হয়তো জ্ঞান দিচ্ছি। কিন্তু বাইরের বাস্তব যে কি কঠিন , তা ঘরের বাইরে না বেরোলে কি সত্যি বোঝা যায় ?
এর পর আর ওর সাথে দেখা হয় নি।
দু বছর পর আবার যখন বাড়ি গেলাম , মেয়ে আমার প্রায় ৫ বছরের , ওর মেয়ে আরো বড়। বাড়ি গেলেই পড়ার ঘরের জানালা দিয়ে ওদের বাড়িরই সব হালনাগাদ পাওয়া যায় সেই ছোটবেলার মতন ই। এই বার চোখে পড়লো মাঝে মাঝে নিজোর মেয়ে কে। অনেকটা পরিণত। দুপুরে এসে বলে “মামী, ভাত দাও , খিদে পেয়েছে “. কখনো নিজোকে দেখলাম না। এভাবে দিন দশ যাওয়ার পর মা কে জিগেস করি , “মা নিজো কে তো দেখিনা , ও কোথায় ?আসে না এখানে ?মেয়ে টা তো আছে!”
মা বললো ” কে জানে বাপু , অনেক দিন তো ওর খোঁজ খবর নেই। মেয়েটা ওই মামার বাড়িতে থাকে। বাবা কেও দেখিনা -মা কেও না “.
পরে আশেপাশে সবার থেকে কানে এলো , নিজো আবার কোথাও চলে গেছে , ওর বর এসে নাকি অনেক বার ঝামেলা করেছে , জানতে চেয়েছে ও কোথায় ?কিন্তু কেউ নাকি কিছু জানে না।
আচ্ছা , ওর জীবন তা কি ছোটগল্পের মতো , যার শেষ হয়েও শেষ নেই। ও কোথায় গেলো ? সত্যি কি কোথাও কাজ পেলো , কাজের সন্ধানে কোথাও গেলো নাকি অন্য কোথাও ?
ও কি একবারও ওর মেয়ের কথা ভাবলো না , ছোট্ট মেয়েটি কি ভাবে কি পরিস্থিতিতে বড় হবে , কে ওকে দেখবে?না কি মেয়ের সব ব্যবস্থা করে গেছে ও। একটি ছেলে -একটি মেয়ে , যাদের মা থাকা সত্বেও তারা মা এর অমূল্য স্নেহ থেকে বঞ্চিত হল। নিজো কি আবার ফিরবে ! নাকি হারিয়ে গেলো অন্য কোনো অজানা শহরে , সুখের খোঁজে।
©মৌসুমী
©মন ও মৌসুমী
[…] <<দ্বিতীয় পর্ব শেষ পর্ব >> […]