নিজো পালিয়েছে , শুনে প্রথমে কান বিশ্বাস করলো না। কিন্তু মস্তিস্ক স্বীকার করলো , এটা অসম্ভব কিছু নয়। কারণ ওদের বাড়ির পাঁচটি মেয়ে , চতুর্থটি হলো নিজো , যাদের মধ্যে প্রথম তিন জন ঠিক এভাবেই বিয়ে করেছে , কেউ পালিয়ে, কেউ ফাঁসিয়ে। শুনেছিলাম ওদের দ্বিতীয় মেয়েটি , মানে নিজো র মেজো দিদিটি নাকি রোজ সেজে গুঁজে পরিপাটি হয়ে ঘুরে বেরিয়ে একটি বড় লোকের ছেলেকে ফাঁসিয়েছিলো। ছেলেটি জানতেও পারেনি সে কোন বাড়ির মেয়ের সাথে প্রেম করছে। যখন জানতে পারে তখন বিয়ে করতে মানা করায় ,তাকে প্রথমে ভুলিয়ে ভালিয়ে দেখা করতে বলা হয় আর সেখানে ছেলেটি দেখা করতে এলে তাকে নিজো র দাদারা ও তার বন্ধুরা চ্যাংদোলা করে একেবারে বিয়ের মণ্ডপে তুলে এনে বিয়ে দিয়ে দেয়। বড় দিদির ঘটনা জানা নেই , আর সেজো দিদির কান্ড অন্যরকম। তাই নিজো যে পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছিল তাতে ওর পক্ষে এই ঘটনা ঘটানো এমন কিছু আহামরি ব্যাপার নয়।
সেদিন স্কুল থেকে এসে ভালো করে খেতে পেরেছিলাম না, কারণ বার বার ওই নাম না জানা মেয়েটির মুখটি ভেসে আসছিলো চোখের সামনে। ও তো বুঝতেও পারেনি কি বিপদ আসতে চলেছিল ওর জীবনে। নিজো যার সাথে পালিয়েছিলো , মানে অসীম , দেখতে বেশ ভালো ছিল বয়েস ও অল্প আর নিজো শ্যামবর্ণ হলেও ভারী মিষ্টি দেখতে, তেমন দেহের গঠন আর তেমন কালো ঘন লম্বা চুল। সে আন্দাজে নাম না জানা মেয়েটি ছিল অতি সাধারণ দেখতে , অনেকটা আমার–ই মতো।
দুপুর থেকে নাকি খোঁজ খোঁজ রবে পাড়া মাথায় তুলেছে আমাদের পেছনের বাড়ির পরিবারের দিদি–জামাইবাবু। সেই রব এখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হতে কলরব ছেড়ে কোলাহল আর গন্ডগোলের রূপ নিয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর চেঁচামেচি –বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ আর নানা অভিযোগ। পাড়ার সব লোকের কান তখন ওই বাড়ির আসেপাশে ঘোরাঘুরি করছে। আমার পড়ার ঘর ছিল দোতলায় নিজো র বাড়ি আর ওই পেছনের বাড়ির লাগোয়া। তাই মন দিয়ে শুনলে বেশ সব কথায় কানে আসছিলো। ইতিমধ্যে আমার কাকিমারা এলেন আর শুরু হলো তাদের ও আলোচনা। আলোচনার আসল বিষয়বস্তু ছিল , নিজো র পরিবার সবই জানে এবং ওরাই পরিকল্পনা করে দুজনকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে ,এই একই কথা ওই মেয়েটির দিদি বার বার কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো , “নিজো আর তার পরিবার সব জানতো , যে দুদিন পর আমার বোনের বিয়ে হবে ওই ছেলের সাথে , আশীর্বাদ হয়ে গেছে , কি করে এ কান্ড সব জেনে শুনে কোনো মেয়ে করতে পারে !!!কি করে মেয়ে হয়ে আরেক মেয়ের এভাবে সে সর্বনাশ করলো ?কোনোদিন ভগবান মাফ করবে না , না ওই ছেলেকে না বোজকে , কেউ ওরা শান্তি পাবে না , পেতে পারে না , আমার বোন কে এভাবে কাঁদিয়ে কিছুতেই ওরা সুখী হতে পারে না। ” এই বলছিলো আর একবার কাঁদছিলো আর কিছুক্ষন সেই কান্না রাগ হয়ে ফেটে পড়ছিলো।আর ওপর দিক থেকে নিজো র পরিবারে দাদা –মা –দিদিরা চিৎকার করে দাবি করতে থাকছিল যে তারা কিচ্ছুটি জানে না। আদৌ নিজো ওই ছেলেটার সাথে নাকি পালায়নি , ও নাকি ওর কোনো আত্মীয়র বাড়ি গেছে কাকদ্বীপে। সে এক বাক্স যুক্তি তর্ক আর তর্ক আরো তর্ক। যেখানে সবাই বুঝতে পারছিলো নিজো র পরিবার শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই করছে না। এর পর প্রায় প্রতিনিয়ত , বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে চলতে থাকে হুমকি , কোথায় নিজো !!কেন ফিরছে না , ইত্যাদি ইত্যাদি।
এভাবে কেটে গেলো কিছুদিন আর কয়েকমাস , সবে মাত্র মানুষ ভুলতে শুরু করেছে নিজো আর অসীমের পালিয়ে যাওয়ার কথা বা সবে বিশ্বাস করতে চলেছিল যে নিজো র পরিবার কিছুই জানে না ওদের পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে , এরকমই একদিন বাড়ির ল্যান্ডলাইনটা বেজে ওঠে। তখন সন্ধ্যে হয়েছে হবে। ফোনটা ধরবি তো ধর আমিই ধরেছি। আসলে সবে সবে নতুন ল্যান্ডলাইন লাগান হয়েছিল বাড়িতে , পাড়াতে দু একটা বাড়ি ছাড়া , কারোর বাড়িতে তখন টেলিফোন এর সংযোগ হয়ে ওঠেনি। তাই যতবার দিনে ওই টেলিফোন বেজে উঠতো , বেশির ভাগ সময় দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরার অভ্যাস আমারি ছিল।
যাক , ওপার থেকে গলা ভেসে এলো একটি ছেলের। “আমি অসীম বলছি” . প্রথমে মাথার ভেতরের কলকব্জা গুলো অত তাড়াতাড়ি নামটাকে মনে করিয়ে দিতে পারেনি , তাই ক্ষনিকের জন্য বুঝিনি কে অসীম ! তাই জিগেস করলাম “কে ?”.অমনি পরক্ষনে উত্তর এলো “আরে অসীম , নিজো র বর ” . শুনেই ফোনটা এক সসেকেন্ড এর ও ভগ্নাংশ সময়ের মধ্যে রেখে দিলাম। ভয় না কি সে জানিনা। ভাবছি দৌড়ে মাকে গিয়ে বলি , অমনি আবার টেলিফোন বেজে উঠলো। ফোন ধরবো কি না ধরবো দ্বিধা থাকা সত্ত্বেও কিসের একটা লোভে ফোনটা ধরেই নিলাম।
ওপাশ থেকে কথা ভেসে এলো “কে বলছো ? টুসাই !আমি নিজো র বর অসীম , ফোনটা রেখে দিলে কেন ?প্লিজ , বেশি সময় নেবো না , শুধু একটা কথা “, বলতে বলতেই পেছনে মা র গলা পেয়ে ফোন রেখে দিলাম ভয় এ। আবার ও ফোন বাজলো তবে ২–৩ মিনিট পর , ততক্ষনে মা কে আমি সব ভয় এ বলে দিয়েছি। আমার মা ভালোর ভালো , খারাপের টা আর নাই বললাম , তাই জীবনে কিছু লুকোয়নি , এমনকি কোনো কথাই মা কে বেশিক্ষন চেপে রাখা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব , সে আজ ও একই ভাবে জীবনে প্রযোজ্য। যাক , এবার ফোন বাজলে , মা পাশে থাকলেও , আমাকে ফোনটি ধরতে দেয়।
এবারের গলা একটি মেয়ের , নিজো র। বলল ,” ভয় পাস না টুসাই, আমি নিজো , তোর বান্ধবী , আমার একটা কাজ করে দে। শুধু আমার বাড়িতে খবর দিস আমরা ভালো আছি , ঠিক আছি আর আমি কাল ঠিক এই সময় আবার কল করবো , আমার বোন কে বলিস একটু ফোন টা ধরতে। ” আমি বললাম “ঠিক আছে “. আর কথা বাড়ায়নি , ফোন রেখে মা কে সব বললাম। ওদিকে দাদা বাবা জানতে পেরে খুব রাগারাগি শুরু করলো ,কি করে নিজো আমাদের বাড়ির টেলিফোনে নম্বর পেলো , মানে কার দোষ কার ঘাড়ে। কে জানে বাবু কোন কুলক্ষনে আমি আমাদেড় টেলিফোনে নম্বর ওকে দিয়েছিলাম , আমি তো কিছুতেই মনে করতেই পারলাম না যে আমি ওকে সত্যি ই দিয়েছি না ও কোথাও থেকে জোগাড় করছে। বাবা দাদা বলে দিলো , কোনো ফোন ধরা হবে না আর না কোনো কথা জানানো হবে , না কেউ আমাদের বাড়িতে আসবে।
আমি কিন্তু সেই রাতেই অন্ধকারে চুপিচুপি নিজো র বোনকে গিয়ে সব বলে আসি আর ও বলি নিজো কাল ফোন করবে এই সময়ে , সে যেন আমাদের বাড়িতে আসে। কারণ আমি জানতাম আমার পরিবার ওদের পছন্দ না করলেও অমানবিক কোনো আচরণ কে প্রশ্রয় দেবে না ,এখন রাগ দেখাচ্ছে , কাল সব মেনে যাবে। ঠিক তাই হলো।
সময় মতো নিজো র বোন এলো আমাদের বাড়িতে , সাথে বৌদিও। কিছুক্ষন পর ফোন এলো। ফোনে যা কথা হলো , তাতে যেটুকু সন্দেহ ছিল তাও মিটে গেলো। বেশ বোঝা গেলো ওদের ফিসফিসানি কথাতে যে নিজো র পালিয়ে যাওয়া ব্যাপারটা ওদের বাড়ির সবাই জানতো , এমনকি কি ভাবে কোথায় ওরা পালিয়ে বাঁচবে তারও পরিকল্পনা খুব ভালো করে করা হয়েছিল ওদের , আর কথা ছিল , সব গন্ডগোল থেমে যেতে ওরা আবার ফিরে আসবে। তাই হলো।
কদিন পর ওরা মানে নিজো আর নিজো র বর অসীম এসে উপস্থিত হলো। স্পষ্ট বোঝা গেলো ওরা এখন থেকে সব রকমের খবর পাচ্ছিলো , আর খবর যখন পেয়েছিলো যে সব থিম গেছে , তখন ওরা চলে এলো বাড়িতে। সব যেন কেমন থিতিয়ে গেছিলো ,কোথায় সে গন্ডগোল , কোথায় সে অভিযোগ , গালিগালাজ। সবাই তখন বিয়ে করে নিজো কে কেমন লাগছে , লাল সিঁদুর পরে কেমন লাগছে সেই নিয়েই আলোচনা শুরু করলো , ও কানে এলো বেশ মানিয়েছে দুজন কে। ঠাকুর নাকি জোড়া ওপর থেকে বানিয়ে পাঠান। আমার কিন্তু শুধু মনে পড়েছিল ওই নাম না জানা মেয়েটির কথা , কে জানে সে কেমন আছে , কি তার মনের পরিস্থিতি। সে তো নিশ্চয়ই সব খবর পাচ্ছে।
পরে একদিন বিকেলে নিচে খেলছিলাম, হঠাৎ সামনে দিয়ে নিজো এসে পরিচয় করলো বরের সাথে, অসীম। অসীম নাকি ওকে দেখে প্রথম দিন থেকে প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলো। এতো সুন্দর দেখতে ছেলে ওই বাজে মেয়েটাকে নাকি কোনো দিনও পছন্দই করেনি , ওই মেয়েটি নাকি জোর করে ওর গলায় পড়েছিল। “কালো ভূত মেয়ে আর এতো ভালো দেখতে ছেলে কখনো কি টেকে !!”ঠিক এই কথাটি বলেছিলো নিজো , তাও আর একটি কালো মেয়ের সামনে , কথাটি বেশ মনে লেগেছিলো , আমিও কালো কিনা !
এরপর নিজের পড়াশোনা নিয়ে দিন দিন ব্যস্ত হতে থাকি , উঁচু ক্লাসে ওঠার চাপ আর কি। মাঝে মাঝে নিজো বাপের বাড়ি আসলে , ওর বর যখন নিতে আসত , মাঝে সাঝে অল্পসল্প কথা হতো , তবে তা ১ মিনিটের কম হবে বৈকি। মাঝে মধ্যে কোনো দরকার হলে ও বা ওর বড় শশুরবাড়ি থেকে আমাদের বাড়িতে ফোন করে সব বলে দিতো। ওদের বাড়ি থেকে বোন বা বৌদি এসে ফোন কথা বলে নিতো। ও একবার নিয়ে এসেছিলো ওর বর কে আমাদের বাড়িতে , বিয়ের পর পর, মা বাবা র আশীর্বাদ নেবার জন্য। মা নতুন জামাইকে আদর যত্ন করে মিষ্টিও খাইয়েছিল। পরিবারের মধ্যে যতই অমিল থাকে না কেন , বাড়িতে আসা অতিথির আপ্যায়ন যে বাঞ্ছনীয় , তা আমার পরিবারের সবাই খুব ভালো জানতো।
স্কুল প্রায় শেষের পথে , ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছি আমিও। ওর মতো তখন আমার প্রাপ্তবয়স্ক মন না হলেও , কৈশোরের হাওয়ার আমেজ আমাকেও ছুঁয়ে গেছে। এর মধ্যে ওর বিবাহিত সেজদির প্রেমপর্ব মোড় নেয় অন্যদিকে। মহিলা বিবাহিত , তিন সন্তানের মা হওয়া সত্বেও , প্রায় তার ঘরের সামনে অপেক্ষারত ,দেখা যেত এক লাল কালো বাইক। বেশিরভাগ সময় দুপুরে। এদিক ওদিক কানাঘুসো শুরু হয় , সে গুলো কতটা সত্যি বা মিথ্যে জানিনা , কারণ সত্যির ৮০ শতাংশ আমি নিজের চোখেই দেখতাম , পড়ার ঘরের জানলা দিয়ে। কখনো কান চাপা দিতে হতো , কখনো লজ্জায় অন্য ঘরে চলে যেতাম। যেদিন ওর দিদি বুঝতে পেরেছিলো , আমি ও আমার এক বান্ধবী ,ওদের ওই ব্যাপারটা দেখে ফেলেছিলাম , সেদিন থেকে শুরু হলো নতুন খেলা। আগে যে জিনিস ওরা লুকিয়ে ঘরে করতো , যে আলাপালোচনা , তা এখন শুরু হলো , উঠানের খোলা প্রাঙ্গনে। আর আড় চোখে তার দিদি দেখে নিতো আমি বা আমার পরিবারের কেউ তাকে দেখেছে নাকি , তাহলে তো কথাই নেই , এমনি কিছু তারা শুরু করতো যে আমরা জানলা দিতে বাধ্য হতাম। দিন কে দিন নিজো র দিদির এই ব্যবহার প্রায় অসহ্য হয়ে উঠছিলো। পাড়া প্রতিবেশীরা এবার কানাঘুষো থেকে সরাসরি অভিযোগ নিয়ে আসতে শুরু করে। আসলে মহিলার স্বামী ছিলেন দিন মজুর , সারাদিন সে বাড়ি থাকতই না , আর রাতে আসলে শুরু হতো তুমুল ঝামেলা। রোজ এসব শুনতে শুনতে বছর ঘুরে আমি স্কুল ছেড়ে এবার কলেজ এ ভর্তি হয়েছি। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের হস্টেলে এবার জীবনের দিন গোনা শুরু। ইতিমধ্যে শুনলাম নিজো র নাকি একটি ছেলে হয়েছে। খবরটি অনেক পরে পায় , যখন সে কয়েকমাসের ছেলে কে নিয়ে ঘুরতে আসে বাপের বাড়ি।
Mousumi Kundu Paul
©মৌসুমী
©মন ও মৌসুমী
বিঃ দ্রঃ : এই গল্পের সব চরিত্র এমনকি স্থান -কাল-পাত্র সব ই কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে তার মিল খুঁজে পাওয়া , নিতান্ত ব্যর্থ প্রচেষ্টা। গল্পের মধ্য দিয়ে কারোর কোনো অনুভূতিতে আঘাত লাগুক , তা লেখিকার উদ্দ্যেশ নয়। তাই পাঠকের কাছে আবেদন , লেখাটিকে শুধু মাত্র লেখা বা ছোট গল্প হিসাবে পড়তে ।
[…] পরবর্তী >> পর্ব ২ […]
[…] <<দ্বিতীয় পর্ব […]