নতুন জীবন (স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে )

নতুন জীবন _চিরঞ্জীব চক্রবর্তী_

3
3255
Photo CopyRight @ FLickr

স্বাধীনতা দিবস আসছে, পেলু দার মনটা তাই বড়োই খুশি খুশি, দু দিন খুব খাটা খাটনী হবে। না মনটা তার জন্য খুশি নয়, কারণ টা একটু অন্য।।

পেলু, পাড়ার একটা মোটামুটি করিতকর্মা ছেলে। বয়স বিশ কি বাইশ হবে, এর মধ্যেই যত ডিগ্রী সব টপকে গেছে সে। আরে না না, পড়াশোনার না, নেশা র।। কোথায়, কি পাওয়া যায় সে তা নিজের হাতের তালুর মতো জানে। সে এখন পাড়ার উঠতি দাদা মনে মস্তান আর কি। বাবাঃ ভেবোনা এ বড়ো সহজে হয়, কি না করতে হয় জানো? পুলিশের গুঁতো খেতে হয়,নেতাদের পা চাটতে হয়, রাত বিরেতে হটাৎ চিৎকার করে খিস্তি দিতে হয়,কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে দল নিয়ে চমকাতে হয়, পাড়ার মেয়েদের পিছনে লাগতে হয়,মাঝে সাঝে হাত,বুক কেটে নাম লিখতে হয়, এর বাচ্চা, ওর ছেলে শুনেও দাঁত কেলাতে হয়,,, আরো কত্তো কি। যাহোক পাড়ার লোকেরা তাকে একটু আধটু ভয় ও পায়।

পাড়াটা খুব শান্তি প্রিয় এটা পেলু বুঝে গেছে। ও মাঝে মাঝে, কারো বিপদে আপদে হাসপাতাল গিয়ে নিজের ইমেজ তা ঠিক করে নেয়, তার পর মাস খানেক ওই বাড়ি থেকে কৃতজ্ঞতা আদায় করতেও ভোলে না পেলু।
ও জানে শালারা, এর পরে ওর হয়ে কোনো অভিযোগ করবে না। ওরা শান্তি চায়। পেলু শান্তি দেয়। বদলে মাসে দু একশো ছাড়তে তো হবেই।

আর এ ভাবেই কিছু রোজগার ও হয়ে যায় ওর। তাই দিয়ে সন্ধে বেলা একটু চানাচুর, বাদাম, আপেল নিয়ে বাংলার ছেলের বাংলা পান। এ সময় নিজের দেশপ্রেমে ন
নিজের পিঠ চাপড়াতে ইচ্ছাও করে হয়তো।

যাইহোক সেই স্বাধীনতা দিবস আসছে। পেলু মনে মনে ভাবে নেয় কোন খাতে কত খরচ।। যেমন পতাকা 100 টাকা, ছোটো পতাকা 50 টাকার, দড়ি 25 টাকার, বাচ্ছাদের লজেন্স ইত্যাদি ইত্যাদি। আর সারাদিনের নিজের খরচ তা হাজার দশেক হলেই হবে। তার পরের দিনের স্বাধীনতা সেলিব্রেশন ধরেটোরে মোটামুটি ত্রিশ হাজার টাকা লাগবেই।।

বাজেট করেই, পেলু ভাবে কার থেকে কত নেবে। সেখানেও একটু আধটু মানবিক ও। যেমন পাশের বাড়ির যে বৌদি আরে যার স্বামী আর্মি যে কাজ করে, তার কষ্টে মানে কম বয়স জনিত কষ্ট পেলু কে খুব কষ্ট দেয়, তাইতো একবার ও বৌদি কে,, যাক সে যদি কষ্ট কমাতে না চায় তাহলে কি করা যাবে।। তার চাঁদা হাজার হলেই চলবে।।।

আর পাশের বাড়ির বুড়োটা, যেটা পেলুর কথায় একটা মাল, আরে যে আগের বছর স্বাধীনতা দিবসের পরের দিন পাগলের মতো ছোট পতাকা গুলো কুরচছিলো, মালের কি মাথা! বলে কিনা এ গুলো পায়ে লাগা পাপ, এগুলো নাকি দেশের সম্মান, ঐতিহ্য, এর প্রতীক। ওই মালের থেকে পাঁচ হাজার নিতেই হবে।। নয়তো কেলিয়ে ঐতিহ্য পিছনে ঢুকিয়ে দেবে। শালা। সম্মানের উম্।

পেলু দা, সাজিয়ে নেয় পুরো প্রোগ্রাম টা। কি কি লাগবে, দশটা ডি জে বক্স(যার ভাড়া তুলতে গিয়ে মালিকের কোথা দিয়ে যেন লালসুতো বের করবে পেলু) আর কি মুক্তি মন্দির না কি একটা গান আছে না, ওটা লাগবে। পতাকা আছে, একটা ছবি, নেতাজির কাটতি খুব ভালো,মানায় আর কি, দশ টা গাঁদা র মালা,কিছু কুচো ফুল, পাড়ার বৌদির দোকানে বলে রাখতে হবে, কিছু সস্তার লজেন্স।।।।।।

সব জোগাড় করে ফেলতে হবে তেরো তারিখের মধ্যে, নয়তো ডি জে বক্স তা পাওয়া চাপ, না খুব চাপ নয় অন্য পাড়ার ছেলেরা নিয়ে গেলে আর পাওয়া যাবে না এই আর কি। তখন আবার বে পাড়ার সাথে পাঙ্গা নিতে হবে, যে ভাবেই হোক নিজের ফান্ডা রাখতেই হবে পাড়ায়। পেলু জানে ও এ পাড়ার শের, কিন্তু পাশের পাড়ায়??

পাড়ায়, দুপুরের মধ্যে কোন বাড়ির কত বরাত, কবের মধ্যে টাকা দিতে হবে সব জানিয়ে এলো। কেউ কেউ সাথে সাথে দিয়ে দিল। মাল্লু হাতে, এসে গেছে পেলুর মন ও তাই প্রজাপতির মতো।

ও ভাবতে বসলো কি কি করা হবে, আজ রাতের মধ্যেই গোটা পঞ্চাশেক বাংলার ফাইল আনতে হবে, সালা ভদ্র লোকেরা আবার স্বাধীনতার দিন পালন করে একটু নেশা করে, তাই ও দিন মাল পাওয়া চাপের।
চোদ্দ তারিখ রাতে, ওই বৌদির বাড়িতে ঢুকে যাবে, বুড়ো শ্বশুর শ্বাশুড়ি নিয়ে থাকে, ম্যানেজ করে একটু মস্তি করে নেবে।।।।। সালা ফুলটুস মস্তি, স্বাধীনতা।।।।

সন্ধ্যা নেমে এলো, পেলুর দলের ছেলেরা হাজির, ওরা একটা মারুতি অমনি এনেছে, পেলু ওদের সত্তর ফাইল আনতে বললো, পচবে তো না তাহলে একটু বেশি করেই আনা থাক।। আর টাকা বাঁচলে,পতাকা, তটাকা এইসব আনবে।।।

ওরা চলে গেলে,পেলু ক্লাবের রক এ বসে বিড়ি ধরিয়ে, কাল বৌদির সাথে কি করবে,সেই ব্যাপারটা নিয়ে মনের মধ্যে রসিয়ে ভাবতে লাগলো,

ঠিক তখনি কিছু দূরের পোড়ো বাড়িটার ভিতর থেকে চিৎকার মতো কিছু একটা শুনে পেলুর গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠলো। কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে সে ছুটলো ওই বাড়িটার দিকে। কোনো এক অজানা শক্তির তাড়নায় ঢুকে পড়লো বাড়ীটায়।।খুঁজতে লাগলো আওয়াজের কারণ। এ জায়গা তা তার চেনা, এখানে রাতের অন্ধকারে বহুবার বন্ধুদের নিয়ে পার্টি করেছে সে।।।। রাস্তার ছিটকে আসা আলোতে সে দেখলো তিনজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।।তাদের সামনে পরে আছে ওটা কি? সময় নষ্ট না করে ও ঝাঁপিয়ে পড়লো, ছেলে গুলো যেন বুঝে গিয়েছিল ওর উপস্থিতি। তারাও ঘুরে দাঁড়িয়ে ধারালো কিছু নিয়ে ও কে মারলো।।।।। পেলু আন্দাজ করলো বেশ কেটেগেছে, ও আরো জোরে, চিৎকার করে প্রচন্ড খিস্তি দিয়ে ওদের প্রতিরোধ করতে চাইলো।
চিৎকার শুনে কয়েক জন পাড়ার লোক এগিয়ে আসছে দেখে তিন জন কোথায় যেন পালিয়ে গেল।।
অন্ধকারে পরে থাকা ও টা কি, তা দেখতে পেলু দেখলো ও তা একটা বাচ্চা মেয়ে, বয়স চোদ্দ কি পনেরো হবে, গায়ের পোশাকের বেশিরভাগ অংশই ছেঁড়া, ঠোঁটের কোণে রক্ত ঝরছে, মনে হয় চিৎকার করায় মার খেয়েছে।।।। মেয়েটা ভয় পেয়ে বেহুঁশ।।

পাড়ার লোকরা এসেছে, বৌদিও এসেছে, কয়েক জন মহিলা জড়ো হয়েছে। বৌদি এসে মেয়েটাকে দেখেই এক জনকে একটা পোশাক আনতে বোললো, তারপর পেলুর দিকে তাকিয়ে বলল হা করে দেখছো কি, নিজের অবস্থা দেখো, প্রচুর রক্ত পড়ছে যে। সে এগিয়ে আসে, বলে চলো বাইরে, বলে হাত ধরে বাইরে নিয়ে আসে।।
পেলুর মনে তখন ঝড় উঠেছে, এই বৌদি কে নিয়ে তার যা চিন্তা, তা আর মাথায় আসছে না কেন, কেন মেয়েটার ওপর তার কেমন একটা দায়িত্ব জন্মাচ্ছে, কে জানে।।
বাইরে এসে যখন বৌদি কাটা জায়গা গুলোয় ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে তখন কেন মায়ের মুখটা বৌদির মুখে মিশে যাচ্ছে, পেলু ভাবলো এ মনে হয় বেশি রক্ত বেরিয়ে গেছে তাই।।।
পুলিশ এলো, ততক্ষণে মেয়েটার চেতনা ফিরেছে, তার বয়ান নেওয়ার পর যে কনস্টেবল (যে লাস্ট বার তাকে খুব কেলিয়েছিলো সে) পেলু কে বললো” কেসটা তোর না তো”? যাঃ পেলু যে দুটো জোরে খিস্তি দেবে, তা কেন দিতে লজ্জা করছে?

সেই বুড়ো মালটা, ভিড়ের ভিতর থেকে বললো “বাঘের বাচ্ছা”। পেলু বুঝলোও না, কেলানে বুড়োর কাছে শুনতে ভালোও লাগছে না।। পুলিশ মেয়েটাকে, আর ও কে নিয়ে হাসপাতাল এ যাবার সময় সে মেয়েটাকে দেখলো আর মেয়েটা ওর হাত দুটো ধরে বলল “ধ্যন্যবাদ দাদা”।

আরে!!!!এতো সহজ, এত সহজ দাদা হওয়া? আর এই দাদা হতেই কি কষ্টই না করেছে? আজ যেন পেলু সব পেয়েছে, সব।।

আজ পনেরই আগস্ট, প্রথা মতো, এই দিনে পাড়ার বুড়োদের খোঁজ পরে, আজ ও তাই হলো, কিন্তু সেই বুড়োটা এবার কোনো জ্ঞান না দিয়ে, পেলুর হাতে দড়িটা দিয়ে বললো, নাও এ দায়িত্ব, তুমিই পারবে, এ ভার বইতে।।।।

পতাকা উঠলো, জাতীয় সংগীত বাজলো, ডি জে বক্স ছাড়াই।। পেলু বিড়বিড় করে আওড়ালো ছেলে বেলা খিচুড়ি স্কুল এ শেখা জাতীয় সংগীত।।।

আজ ও স্বাধীন দাদা, সর্বজন স্বীকৃত।।

আজ পেলুর স্বাধীনতা দিবস।।।।।

— চিরঞ্জীব চক্রবর্তী

 

Writer Chiranjib Chakroborty

লেখক চিরঞ্জীব চক্রবর্তীর কলম থেকে ,একটা ছোট্ট গ্রামের খুব সাধারণ মানের ছেলে।কবিতা বা যা কিছু লেখা শুরু, আর্য‍্যা(স্ত্রী) র কথায়,ওর পড়ার জন্যে। শখ:1. মানুষের সাথে মেশা, 2.বিজ্ঞান কে বিজ্ঞান হিসাবে শেখা, 3.রাতের নিঝুম রাস্তায় একা হেঁটে রাতের মিস্টি কথাশোনা।পেশা: স্কুল এ জীবন বিজ্ঞান শেখা,ও শেখানো।স্বপ্ন: পৃথিবী টা কে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর করে রাখা(জেগে দেখা স্বপ্ন)।

লেখকের আরো লেখা পড়তে ক্লিক করুন 
স্বাধীন-বুড়োর-মৃত্যুকামনা    ভুল-ভেবেছি       রূপকথা-চুপকথা

3 COMMENTS

  1. কবে যে বাংলার পড়ার ছেলেরা পেলুর মত পরিবর্তিত হবে জানিনা— লেখাটা ভাল লাগল চীরঞ্জীব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here