অর্ধশতক কেটে গেল।এখন আমি প্রান্তিকে।কেমন করে যেন অনেকটা রাস্তা আমরা একসাথে হেঁটে এলাম। আমি ও সুচেতা।কিছুদিন হলো আমরা আমাদের এই নতুন ফ্ল্যাটে এসেছি।এখনো বাতাসে হালকা গরম ভাব আছে।এই চোদ্দো তলার বহুতলে অবশ্য এটা অনূভুত হয় না।সন্ধ্যে থেকে একটা হিমেল ভাব গায়ে লেগে থাকে। অদ্ভুত এক শিহরণ খেলে গেল হঠাৎ সারা শরীর মনে।গত বছর এরকম দিনে শহরের ভেতরে একটা ভাড়া বাড়িতে ছিলাম।এখন এই বহুতলের বাসিন্দা।যেন অন্য গ্রহের জীব মনে হয়।এখনো সকাল হয় নি।এক সপ্তাহ পরেই মা আসছেন।বোধন শুরু হবে।মহালয়া আজ।সামনের ব্যলকনিতে এসে দাঁড়াতেই হাইওয়ে দিয়ে ট্রাকের গর্জন গুলো শোনা যাচ্ছে।সামনে দিগন্ত বিস্তৃত খোলা আকাশ।সূর্যদয়ের আভাস দেখা দিচ্ছে।সুচেতা এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি।কদিন থেকে বাতের ব্যথাটা ওকে খুব কষ্ট দিচ্ছে।ঘুমাক। আমার জন্য অনেক লড়াই করতে হয়েছে। দীর্ঘ এতগুলো বছর অনেক সুখ দুঃখের সাথী আমরা। পাশের অম্লান বাবুর ফ্ল্যাট থেকে রেডিওর আওয়াজ পাচ্ছি।মনে পড়ে গেল আজ তো মহালয়া! একটা সময় ছিল যখন বীরেন ভদ্রের গলার আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙতো।হঠাৎ যেন সেই পুরোনো মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম।য্যা দেবী ‘সর্বভূতেষু মার্তৃরূপেন সংস্থিতা।’ মনটা যেন হারিয়ে অনেকটা পেছনে চলে গেল।তখন ওরা ছোটো।বড় অভিমূন্য পাঁচ কি ছয় হবে ছোটো অভিষেক বছরখানেক বোধহয়।তখন লড়াই চলছে ।বেঁচে থাকার , ওদেরকে বাঁচানোর ।স্বপ্ন পূরণের লড়াই।আর আজ এখন ওরা সুপ্রতিষ্ঠিত।কর্মসূত্রে আজ দুজনে দুদিকে।একজন সুদূর আটলান্টায়,আর অভিষেক কলকাতা। একটু ঠান্ডা লাগছে। ডাইনিং হল টা পেরিয়ে নিজেদের ঘরটায় ঢুকে একটা হাল্কা চাদর জড়িয়ে নিলাম। ঘুম ভাঙা গলায় সুচেতা বলে উঠলো ‘তুমি উঠে পড়েছো? বুঝতে পারিনি ওর ঘুম ভেঙ্গেছে। এবার ওর দিন শুরু হবে।সুচেতা বলল, “শোনো না একটু কালীবাড়ী যেতে হবে”।”আমি স্নান করে নিই পূজো দিয়ে আসবো”।”ছেলে দুটো বিদেশ বিভুঁইয়ে থাকে”; তাই তো? আসলে মা তো!ফল্গুধারার মতো মঙ্গলকামনায় অন্ঃসলিলা থাকে। “হ্যঁ যাবো” তবে একটু চা খেয়ে নাও , দেরী হতে পারে।।
কলিংবেলের আওয়াজ।অম্লান বাবু আর ওনার স্ত্রী কমলিকা।মর্নিং ওয়াকে যাওয়া অভ্যস।আমি বললাম ,”যুগলে দর্শন হয়ে গেল।”কি যে বলেন অমিতাভ দা! আপ্লুত হয়ে পড়লেন উনি। কর্মসূত্রে অম্লান দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলো। ছেলেরা অবশ্য এখানে থাকেনা।একজন স্টেটসে অন্য জন হামবুর্গ ।ইন্জীনিয়ার ও ডক্টর।ওদের স্ত্রীরাও বিভিন্ন পেশায় যুক্ত।দুজনার একটা করে মেয়ে।তারাও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপিকা।Happy couple তবে আমাদেরকে খুব পছন্দ করেন।অম্লান বলল ,” দাদা বৌদি উঠছেন?-বললাম উঠেছে,বলল একটু কালীবা,ড়ী যাব পূজো দিতে। তা আমি বললাম,”চলো একটু ঘোরাও হবে মাকে দর্শন করাও হবে”।অম্লান শুনে একটু চুপ করে রইলো, তারপর কমলিকাকে বলল,”কি যাবে নাকি? মাকে দর্শন করতে?।”না থাক”, শরীর টা ভালো যাচ্ছে না”।অম্লান একটু হেসে বলল, আমার আবার ওসব আসেনা”।”কিন্তু কমলিকার এই বিষয়টায় বরাবরই আগ্রহ”। “তুমি চুপ করো তো!” একটা মৃদু ধমক দিয়ে বলল, “দিদি আমার দুই মেয়ের জন্য একটু পূজো দিয়ে দেবেন?”, কমলিকার হাত ধরে সুচেতা বলল,” এ কি কথা দিদি, আপনি আমি কি আলাদা ?আর ওরা তো আমার মেয়ের মতোই”।আপনি কিছু চিন্তা করবেন না’ আমি পূজো দিয়ে প্রসাদ দিয়ে আসবো।’ আচ্ছা আজ তাহলে আসি’? আপনারা মাকে দর্শন করে আসুন ,দিনটাও খুব ভালো।’সামনেই মা আসছেন,’।খুব ভালো লাগলো’ আপনাদের সাথে কিছুটা সময় কাটিয়ে’।আরে চলো দেরী হয়ে যাবে যে ,ভীড় হয়ে যাবে , এসে আবার রান্নার ব্যবস্থা করতে হবে তো, ।ও, ভালো কথা-সুচেতা বলে উঠলো,’আজ কিন্তু নিরামিষ’, লুচি,ছোলার ডাল আর পনির।’আমি বললাম, great তোমার এখনও মনে আছে , মহালয়ার spacial menu?।’ চোখের কোলটা হঠাৎই চিকচিক করে উঠলো।পেছন ফিরে চাদরের খুঁট্ দিয়ে চশমার ফাঁকে জলটা মুছে নিলাম। আকাশটা ফর্সা হয়ে আসছে।নতুন দিন আবার শুরু হবে ।Ground floorএ নেমে সামনের লন্ থেকেই বেরিয়ে একটা অটো পেয়ে গেলাম।দিনের প্রথম সূর্য তখন দিগন্তে আলো ছড়াচ্ছে। সুচেতাকে আজ ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে,লাল পাড় গরদের শাড়ি ভিজে চুল কপালে সিঁদুরের বড় টিপ হাতে ফুলের ডালি। মনটা খুশিতে ভরে গেল ওকে দেখে। অটো চলছে।
ওর ফোন টা বেজে উঠল।এত সকালে?ও বলে উঠলো,”হ্যলো,কে?অভি? কি রে মা কে কি ভুলে গেলি?ধরা গলায় সুচেতা বলে উঠলো, স্পীকার টা অন করাই ছিল।ওপাশ থেকে অভীর গলা শোনা গেল।’মা তুমি না, অভিমানের সুরে বলল, জাননা এখানে সময়ের কি দাম! কাজের ভীষণ প্রেসার’,আর আমার কী ইচ্ছে করে না তোমাদের সাথে কথা বলতে? বলো? হ্যাঁ কেমন আছো তুমি? বাবা?, শরীর ভালো আছে তো?, ভালো কথা,আজ তো মহালয়া?তাই না? দেখো আমি কিন্তু এখনও ভুলিনি। ও আবার বলল,’শরীর কেমন আছে মা? ভালো আছে তো? সুচেতা বলে উঠলো,’আরে বাবা হ্যাঁ হ্যাঁ’,এই বয়সে আবারও কেমন থাকবে?বাতের ব্যথাটা একটু যা বেড়েছে। ওদিক থেকে অভীর মৃদু ধমক শোনা গেল,’কতবার বলেছি নিয়মিত চেকআপ করাতে, শোনো আমার কথা? এবার গিয়ে আমার সাথে ডঃ গোস্বামীর কাছে যাবে। সূদুর আটলান্টায় থাকে অভিমূন্য।এখন আই বি এম এ আছে।এশিয়া জোনটা ওই দেখাশোনা করে।খুব ভালো পড়াশোনায় ছিল অভী।তাই উন্নতি করতে দেরি হয় নি।আবার অভীর গলা শোনা গেল।জানো, এখানে খুব ধূমধাম করে দূর্গা পূজো হয়।আমি ছবি পাঠিয়ে দেব।বাবাকে দেখে নিও। ঠিক আছে ঠিক আছে নে হয়েছে?পারিস বটে!নে, বাবার সাথে কথা বল।কেমন আছো? Superb আমি বললাম।তোর খবর বল।অভিষেকের সাথে কথা হয়? কি বলছে? পূজোয় আসবে বলল? আমার সাথে এখনো কথা হয় নি অবশ্য। যাই হোক সাবধানে থাকিস বাবা, ওখানে চারিদিকে যা হচ্ছে? আরে ছাড়ো তো! আমি ঠিক আছি।কিছু হবেনা।আচ্ছা রাখছি।অফিসে আছি লাঞ্চ হলো তাই ফোন করতে পারলাম। বাই, ভালো থেকো।সাবধানে থেকো।রাখলাম। ফোনটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল।মন্দিরের কাছে বোধহয় পৌঁছে গেলাম।মনটা উদাস হয়ে গেল।আড়চোখে সুচেতা কে দেখলাম,একি? তুমি কাঁদছ কেন? আরে ছেলেরা তো ভালই আছে। আমাদের খেয়াল রাখছে,।বুদ্ধিমান সংবেদনশীল, ওদের নিয়ে তুমি ভেবোনা। না, হঠাৎ ওদের ছোটোবেলার দিনগুলো মনে পড়ে গেল– তাই আর কি। কথা শেষ হলনা ।ধরা গলায় সুচেতা বলে উঠলো ,নামো নামো চলে এসেছি।বাবা ঐ মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড় করা বাবা। ঠিক আছে মাসীমা। ‘আরে আস্তে আস্তে তাড়াহুড়ো করছো কেন?এমন কিছু ভীড় নেই।নাও যা নেবার নিয়ে নাও।’ ও বলল ঠিক আছে বাপু নিচ্ছি। অটোর ছেলেটার নাম সুভাষ।বললাম কত দেবো রে তোকে?একমুখ হেসে বলল, আপনাকে কি আর বলতে হবে মেসোমশাই। আমি তিরিশ টাকা দিতেই ও খুব খুশী।ঠিক আছে মেসোমশাই চলি তাহলে? আয় বাবা। চলো হয়েছে?লাইন পড়ে যাবে। নাও চলো , হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে আরো পরিষ্কার হচ্ছে আকাশটা। আজকের দিনে অনেক মানুষের ভীড় দেখা যায় রাস্তায়।যাদের সারা বছর দেখা যায় না।পূজো শুরু হয়ে গেছে।ধূপ, ফুলের সুবাসে মনটা অন্য জগতে চলে গেল।সুচেতা মেয়েদের সারিতে দাঁড়িয়ে।খুব একটা ভীড় নেই।জনা দশ কি বারো।অনেকদিন আগের কথা মনে পড়ে গেল।তখন আমি ক্লাস সেভেনের ছাত্র।ভারত সেবাস্রম সংঘের স্বামীজিরা আসতেন এখানে।তৈরী হত এক আধ্যাত্মিক পরিমন্ডল।আমি মন্রমুগ্ধের মতো চলে আসতাম। এক অদ্ভুত অনুভূতি হতো মন ও শরীরে।আজ সুর দৌলতে সেটা আবার ফিরে পেলাম।
সুচেতা পূজো দিচ্ছে।অন্ঞ্জলীও দেবে।আর একটু বসলাম।সামনের বেলগাছটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে কতো স্মৃতি নিয়ে। একটু ঘুরে দেখলাম। মনে হলো, সেই স্বামীজি যেন বলছেন,’বেটা তু আগ্য়া ?’ সৌম্য অপরূপ সুদর্শন চেহারা, গেরুয়া বস্ত্র ধারী, এখনও আমি ভুলতে পারিনি ঐ সুমধূর কন্ঠস্বর।চমক ভাঙল , সুচেতার ডাকে।আরে চরণামৃত নাও,আর প্রসাদ গুলো একটু ধরতো।আমি ঐ দিক থেকে আসছি প্রনাম করে।ঠিক আছে তাড়াতাড়ি এসো,বেলা হয়ে যাচ্ছে।আরে বাবা আসছি আসছি,যাব আর আসব।ভীড় বাড়ছে,বেলাও বাড়ছে।দু একজন দীন দরিদ্র মানুষ মন্দিরের ভেতরে ও বাইরে কিছু পাবার আশায় বসে আছে।”নাও চলো হয়েছে”। চলো। মা, একটু প্রসাদ হবে? একজন ছিন্নবসত্র পড়া এক মহিলা সুচেতা কে বললো।সুচেত আমাকে পাশে নিয়ে গিয়ে বলল,’দশটা টাকা দাও তো! আমি বললাম ঐ সবের কি দরকার? প্রসাদ দিয়ে দাও , ব্যস।আরে দাও তো?আজ দিনটা ভালো।তাই বলো? আমি হেসে বললাম।দশ টাকা আর প্রসাদ দিতেই , মেয়েটি বলে উঠলো,মা আপনাকে সুখে রাখুন।আপনাদের মঙ্গল করুন।এই বলে মহিলাটি চলে গেল।মন্দির থেকে বেরিয়ে দেখি দু তিনটে অটো দাঁড়িয়ে আছে। বললাম যাবে নাকি? বললো যাবো।সুচেতাকে বললাম নাও ওঠো বেলা হয়ে আসছে।ঘড়িতে তখন সকাল আটটা।রাস্তা দিয়ে আসতে আসতে ভাবলাম দেবীপক্ষ সুচেতার হাত দিয়ে মা শুরু করালেন বোধহয়।এই শুভক্ষণে শুভ দিনে এর চেয়ে ভালো অনুভূতি আর হতো না।মনে মনে নিজেকে একবার দেখে নিলাম,আর দেখলাম সুচেতার মুখে একরাশ পরিতৃপ্তি ও সুখের ছোঁয়া লেগে আছে।সত্য্ই দেবীপক্ষ শুরু হলো।
প্রবীর ভদ্র এর কলম থেকে “লেখা আমার পেশা নয়, আমার নেশা।
আমার আবেগতাড়িত মন ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমাকে শব্দ ছন্দের দোলায়।
মানুষের মনের অন্দরমহলে প্রবেশ করার ও তাঁদের অনুভূতি অনুভব করার একটা ক্ষুদ্র প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি।”
প্রবীর ভদ্র এর আরো লেখা পড়তে ক্লিক করুন স্বাধীনতার-একাকীত্ব স্বাধীনতা-যখন-পণ্য ফাউন্টেন-পেন লজ্জা
[…] ভদ্র এর আরো লেখা পড়তে ক্লিক করুন দেবীপক্ষ স্বাধীনতার-একাকীত্ব […]