আমি অবিনাশ সেনগুপ্ত,রিটিয়ার্ড ডব্লু.বি.সি.এস অফিসার।সমাজের চোখে একগুঁয়ে, রাশভারী,অর্ন্তমুখী।তবে আদতে মানুষটা আমি একটু এলোমেলো স্বভাবের। বই আর গাছপালা এই গুলোই আমার বন্ধু। তাই চাকরী থেকে অবসর নিয়ে নদীয়ার গ্রামের বাড়ীকে সাজিয়ে গুছিয়ে একাই বসবাস করি। আমার প্রতিষ্টিত ছেলে মেয়েরা তাদের কাছে গিয়ে থাকর জন্য অনেক অনুরোধ করেছে।কিন্তু এই বাড়ীর গাছপালা,দূরে দিগন্তব্যাপি চাষের জমি সর্বপরি বাড়ীভত্তি বই ম্যাগাজিন, পেপার কাটিং এই গুলোর মায়া কাটিয়ে ছেলে, মেয়েদের কাছে গিয়ে থাকতে পারিনি।আজ অবশ্য ঢাকুরিয়াতে বড়ছেলের বাড়ীতে এসেছি। আমার বড় নাতি এবার মাধ্যমিকে ৭ম স্থান অধিকার করেছে।তার জন্য পার্টি হবে।আমার ছোট ছেলেও সপরিবারে হাজির হয়েছে।কেবল একমাত্র মেয়ে কানাডা থেকে আসতে পারেনি।সে অবশ্য ভি.ডি.ও কর্নফ্রারেন্সে পুরো পার্টিটাই এনঞ্জয় করবে।সে হিসাবে ধরলে পত্নী বিযোগের পরএই আমার পুরো পরিবার এক সাথে। এসে অবধি আমার নাতীর ভবিষৎ এ কি পড়া আর কি পেশায় আসা উচিৎ তা নিয়ে সবাই নিজের, নিজের মতামত দিচ্ছে।আমি মনে মনে ভাবলাম ভাগ্যিস আমি এসময়ে জন্মাই নি। তাহলে স্কুল ফাইনালে জেলার মধ্যে প্রথম আর অংকতে ১০০ পেয়েও আটর্স নিয়ে কলেজে ভর্ত্তি হতে পারতাম না। কি করবো ইতিহাস, সাহিত্য যে আমার বড় প্রিয়!চুপচাপ সবার কথা শুনছিলাম।এমন সময় বড় নাতি এসে অনুরোধ করলো দাদু সন্ধ্যেবেলার পার্টিতে তুমি একটা প্রেমের গল্প বলবে, সঙ্গে সঙ্গে নাতনি ঠোঁট ফোলালো- না দাদু তুমি ভুতের গল্প বলবে। পড়লাম মহা ফাঁপড়ে, আসলে আমি বরাবরই সিধু জ্যাঠার খুড়তোত ভাই।বই,পেপার, ম্যাগাজিন, মায় রান্নাঘরের ঠোঙা, বইয়ের মলাট, মোড়কের খবরের কাগজ সব পড়ি।আর যদি এর থেকে কোন খবর মনে ধরে তো কাটিং করে রেখে দেই। কিন্তু লিখতে এক কলমও পারি না।বানিয়ে গল্প তো আরো নয়।কি করি?? হঠাৎ মনে পরে গেলো আজ থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগের সেই ঘটনার কথা-যার ব্যখ্যা আজও পাইনি। তাই কাউকে বলতেও পারিনি।এছাড়া ওটাই আমার জীবনের প্রথম প্রেম।শরৎ এর শিউলির সুভাস মাখানোএক ঝাঁক মিষ্টি অনুভুতি,তেমন হলে নাম,স্থান বদলিয়ে দেবো…
পার্টি বেশ জমজমাট হলে গল্প বলা শুরু করি। আমার চারপাশে আমার নাতি, নাতনি তাদের বন্ধু,বান্ধবী আর একটু দূরে আমার ছোলে বৌ ও উপস্থিত অতিথিরা বসা। আমি শুরু করলাম…..
অভি(নিজের নামকেই একটু কেটে দিলাম,..এর বেশী কল্পনা আসলো না)।সদ্য চাকুরী নিয়ে মিরিকের কাছে বি.ডি.ও হিসাবে জয়েন্ করেছে।ছোট ব্লক.. ঝামেলা কম…পাহাড়ি প্রকৃতির নির্জনতায় বইপত্র, গাছ পালা, অর্কিট এই সবের সাথে বেশ মজায়ই কাটছিলো দিনগুলো।হঠাৎ একদিন বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পথে দেখে একটি ২২ কি ২৩ বছরের অল্প বয়সি মেয়ে পথের ধারে বসে আছে..আর তার উদাত্ত গলায় গলায় ঝরে পরছে -“আমারি চেতনার রংঙে পান্না হলো সবুজ, চুনি উঠলো রাঙা হয়ে, আমি চোখ মেললুম আকাশে…” কবিতাটা বহুবার পড়া তাও কবিতাটা যেনো অন্য মাত্রা পেয়েছে মেয়েটির গলায়।অভি থমকে দাড়ালো, কবিতা শেষ হলে মেয়েটি নিজেই অভির সাথে আলাপ জমালো। অভি জানতে পারলো মেয়েটির নাম নীহারিকা বোস..সে এখানে সিনেমার কাজে এসেছে। তার দল একটু নীচের ডাক বাংলোতে আছে।আর সে নিজে প্রকৃতি দেখতে দেখতে প্রায় ২কি,মি উপরে চলে এসেছে।শুনে অভি বললো তাড়াতাড়ি ডাকবাংলোয় ফিরে যান। আকাশের অবস্থা ভালো নয়।বলতে বলতেই চারিদিক কালো করে বৃষ্টি নামে।পাহাড়ী বৃষ্টি তার উপর অন্ধকার নেমে এসেছে।অগত্যা অভি মেয়েটিকে নিয়ে রাস্তার উল্টোদিকে তার সরকারী বাংলোতে ঢুকে পরে।ভাবে বৃষ্টি কমলে সে নিজে ওকে দিয়ে আসবে।কিন্ত বৃষ্টি থামার বদলে আরো বেড়ে যায়।নিরুপায় হয়ে অভি দোতালার গেষ্ট রুমটি মেয়েটির জন্য খুলে দিল।সে রাতে বাবুর্চির রেঁধে যাওয়া মাংস রুটি সহয়োগে ডিনার করতে করতে নীহারিকার গলায় অনেকগুলো কবিতা শুনলো অভি। নীহারিকা ও গেষ্ট রুম ছেড়ে অভির রুমে এসে বই পত্র দেখতে লাগলো।অবাক হয়ে অভি দেখলো নীহারিকা ও বই পাগল… তার সংগ্রহের অনেক বইই নীহারিকার পড়া।বই পত্র নিয়ে আলোচনা, কবিতা শোনা.. এই সবের মধ্য দিয়ে রাত গভীর হলো। তারপর নীহারিকা নিজের ঘরে চলে গেলো।অনেক দিন পর একটা সঙ্গী পেয়ে অভির বেশ ভালোই লাগছিলো।বৃষ্টি কিন্তু থামলো না-বরং আরো বেড়ে গেলো। বেশ বেলায় ঘুম ভেঙে অভি দেখলো তার বাড়ীর সামনের রাস্তায় ধস্ নেমেছে। বাড়ী থেকে বার হবার উপায়ই নেই। তাই আজ অভি অফিস যেতে পারবেনা। রিলিফের লোক না আসা অবধি গৃহ বন্দীই থাকতে হবে। পাহাড়ে এই সব বিপর্যয়ের জন্য তারা তৈরীই থাকে। বেশ কিছু খাবার দারার ঘরে থাকে…কিন্তু সমস্যা তো নীহারিকাকে নিয়ে।অল্প বয়সী, অবিবাহিত মেয়ে তার বাংলোয় রাত কাটালো… এবার দিনের বেলাও না যেতে পারলে তার সাথের লোকেরা কি ভাববে?? চিন্তা নিয়েই জানালায় বসে বৃষ্টি দেখতে থাকে সে। এর মধ্যেই নীহারিকা চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে আসে। টেবিলে ট্রে রেখে বলে খুব ভাবছেন না আমাকে নিয়ে???আমি খুব বিপদে ফেললাম না আপনাকে?? অপ্রস্তুত অভি বলে তা নয়….তবে আপনি কেনো চা করার পরিশ্রমটা করতে গেলেন??…নীহারিকা হো হো করে হেসে বললো আপনার বাবুর্চি তো আজ আসবে না … তাই আমি ওই রোলটা করিনা কেনো???তাড়াতাড়ি চা খেয়ে নীচে আসুন… আমি জল খাবার করছি।অভি চা খেয়ে ফ্রেস হয়ে নীচে এসে দেখে নীহারিকা তার জন্য ময়দার সাদা ফুলকো লুচি, আলু গোলমরিচের সাদা তরকারি আর এলাচ দিয়ে সুজি করেছে। প্রবাস জীবনে যেনো মার হাতের রান্নার স্বাদ পেলো অভি। সে ঘিয়ের গন্ধ ভালো বাসতো না বলে মা ও এলাচ দিয়েই সুজি বানাতেন। খেতে খেতে অভি নীহারিকার ব্যপারে জিজ্ঞাসা করে, কিন্ত নীহারিকা তা এড়িয়ে যায়।কখনো কবিতায়, গানে আবার কখনো চুপচাপ মুখোমুখি বসে বৃষ্টির শব্দ শুনতে লাগলো।দুপুরে অভির প্রবল আপত্তিতে ও নীহারিকা খিচুরি বানায়….. অভির মনে হয় এতো ভালো খিচুরি সে আগে কোনদিন খায়নি। সন্ধ্যা হলে অভি উপরে এসে তার বেলিফুলের গাছের সামনে দাড়ায়।হঠাৎ নীহারিকা লন্ঠন নিয়ে সেখানে আসে।লন্ঠনের মৃদু আলোয় অভি দেখে নীহারিকা একটা লাল বেনারসি পরে আছে।অভি খুব অবাক হয়।নীহারিকা জানায় সিনেমার জন্য এই বেনারসিটা নিজের কাছে রেখেছিলো।তাই অন্য কিছু না পেয়ে এটাই পরেছে।সন্ধ্যার মৃদু আলোয় লাল বেনারসিতে নীহারিকাকে দেখে অভির মনে হলো…. এই তো তার স্বপ্নের প্রেয়সি।অভি অবাক চোখে নীহারিকাকে দেখতে লাগলো।রাত বাড়লো তার সাথে বৃষ্টি ও।অভি বেলিফুল তুলে নীহারিকার চুলে লাগিয়ে দিলো। নীহারিকার চুলের গন্ধের সাথে ফুলের গন্ধ মিলেমিশে অভির মনকে ভালো লাগার আবেশে ভরিয়ে দিলো। রাত গভীর হলো…..দুজন দুঘরে চলে গেলো। পরদিন সকালে আকাশ পরিষ্কারর হলো আর রিলিফের লোকা এসে ধস্ও সরিয়ে দিলো।নীহারিকা নিজের ছোট ব্যাগটা নিয়ে অভির কাছ থেকে বিদায় চাইলো
অভি বললো তোমার কিছু চিহ্ন দিয়ে যাও…..বলে ডাইরির একটা ছেঁড়া পাতা দিলো তার একদিকে বাজারের ফর্দ লেখা। অভির কাছ থেকে ফাউনটেন্ট পেনটা নিয়ে বাজারের ফর্দর উল্টো পিঠে নীহারিকা তার গোটা গোটা মেয়েলি হাতের লেখায় লিখলো……..
“তুমি ছাড়া কে আর
এ উদাত্ত হাহাকার….
হেথা নয়, হেথা নয়,….
অন্য কোথা অন্য কোনো খানে…..”
এর পর নীহারিকা পাকদন্ডী বেয়ে নীচে নেমে যায়। অভি এই প্রথম একাকিত্ত্বের কষ্ট পায় অনুভব করে।
এর দিন দুই বাদে রাজু নামে একটি নেপালি ছেলে অভিকে কলকাতা থেকে কএকটি বই এনে দেয়।এই রাজু মাঝে মাঝে কলকাতায় যায়… তখন তাকে দিয়ে অভি তার পছন্দর বই আনায়।অভি বইয়ের কাগজের মোরক খুলতে গিয়ে অভ্যাস বসে মোড়কের কাগজে চোখ বোলাতে গিয়ে দেখে সেখানে নীহারিকার ছবি….কৌতুহলি অভি খবরটা পড়তে গিয়ে দেখে সেটা বেশ কএক বছর আগের পেপার… আর তাতে লেখা আছে নীহারিকা নামের এক উঠতি অভিনেত্রী মিরিকের কাছে একটি গেষ্ট হাউজে ওঠে সিনেমার শুটিং এর জন্য.। আর সেখানে সে প্রযোজকের লালসার শিকার হয়।আর তারপর সে গেষ্টহাউজের ছাদ থেকে আত্মহত্যা করে।অভির চারিদিক দুলে উঠলো।সে নীচের ডাকবাংলোয় গিয়ে জানতে পারলো সেখানে কোনো সিনেমার পার্টি আসেনি।এরপর অভি খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলো যে তার বাংলোটা আগে গেষ্ট হাউস ছিলো …. কোন সিনেমার অভিনেত্রী আত্মহত্যা করার পর সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর সরকার সেটি লিজ নিয়ে বি.ডি.ও র বাংলো বানায়।এর পর আশ্চর্য্য ভাবে নীহারিকার লিখে যাওয়া কবিতার কাগজটা অভি আর খুঁজে পায়না।কিন্ত তার মনে আছে সে তার মশলার ডিবের মধ্যেই রেখেছিলো কাগজটা।অভি মশলা রাখলেও আদতে ওটি পানের ডিবে।নীচের থাকে পানের জায়গায় অভি তার দরকারি কাগজ রাখতো আর উপরের থাকে এলাচ, মৌরি কি লবঙ্গর মতো খুব সাধারন কিছু মশলা… নিয়মিত মশলা না খেলেও ডিবেটা অভির খুব প্রিয় ছিলো…তাই নিজের কাছেই রাখতো সবসময়।…এর পর অভি আর বেশী দিন থাকতে পারেনি… ট্রান্সফার নিয়ে কলকাতায় চলে আসে… এই অবধি বলে ঘরে চলে আসি।এই অবধি বলে ঘরে চলে আসি।
অনেক দিন পর নীহারিকার কথায় মনটা একটু ভার ভার লাগছিলো। এমন সময় আমার কলেজ পড়ুয়া নাতনী মিষ্টি ঘরে ঢুকলো… এক রাশ ফুলের গন্ধমাখা তাজা বাতাস নিয়ে!…সে এসে আমার গলা জরিয়ে ধরে বললো “দাদুভাই… এটা তোমার জীবনের ঘটনা তাই না??আমার ডারলিং… তা হলে রামগরুরের ছানা নয়!…বেশ প্রেমিক পুরুষ বলো!”নাতনির কথায় আমি হেসে উঠি…।সে আবার বলে “কলকাতায় এসে তুমি নীহারিকার খোঁজ করলেনা কেনো???একই রকম দেখতে দুজন মানুষও তো থাকতে পারে!!”…আমি বলি “না রে দিদিভাই…কলকাতায় আসার পর বাবা বললেন মেয়ে দেখা আছে আর ১৫ দিন পর তোমার বিয়ে!…ব্যস্ বিয়ে করে নিলাম।”মিষ্টি অবাক চোখে বলে তার মানে বিয়ের আগে দিদানকে তুমি দেখোই নি??!” আমি মিষ্টির চুলটা একটু ঘেঁটে দিয়ে হেসে বলি…” চোখের দেখায় কি আসে যায় রে পাগলী…. মনের দেখাই তো আসল!” তারপর বলি” যা অনেক রাত হলো শুতে যা…. আমিও ঘুমাবো।”মিষ্টি ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। শুতে যাওয়ার আগে গলাটা একটু খুশখুশ করছিলো….তাই অনেক দিন বাদে মশলার কৌটোটা খুলে দুটো লবঙ্গ তুলে মুখে দিতে গিয়ে লবঙ্গদুটো অসাবধানে নীচের থাকে চলে যায়। আমিও অনেক দিন পর নীচের থাকটা খুলে পুরোনো কাগজগুলোর ভাঁজ খুলে দেখে আবার ভাঁজ করে রাখতে থাকি। হঠাৎ একটা কাগজে চোখ আটকে যায়….আরে এটাতো সেই ডাইরির ছোঁড়া পাতা!হ্যাঁ ডেটটা তো একই আছে!….৩.৩.১৯৬৬…এটাতেই তো নীহারিকা লিখেছিলো….কিন্ত না কোনভাবে জল লেগে ফাউন্টেন্ট পেনের কালির লেখা সব ঘেঁটে গেছে!…সেটা বাজারের ফর্দ না নীহারিকার লেখা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।…. কালির দাগ ছাড়া আর কিছুই নেই সোখানে!!বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি নামলো!……
অনামিকা মন্ডল (আমি অনামিকা… আপনাদের কিছু গল্প শোনাতে চাই।)
লেখিকার আরো লেখা পড়তে ক্লিক করুন "মা তুঝে সালাম " ...
[…] আরো লেখা পড়তে ক্লিক করুন "ক্ষনিকের -অতিথি " […]