বাংলাদেশের ব্যাতিক্রমধর্মী প্রতিষ্ঠানের কথা উঠলে সবার আগে মাথায় আসে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের কথা। ‘বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন’ কি এবং কেন সে গল্পও বলবো, তার আগে বলি ‘বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের সাথে আমার পরিচয়ের গল্প। দুই বছর আগে, বইমেলায় আমার এক বন্ধুর লেখা ছোটগল্প তরুনলেখকদের সংকলন আকারে বেড়িয়েছে, বইয়ের ব্যাগে লেখা, ‘১ টাকার আহার’ আমি বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলাম এই লেখার অর্থ কি?
দোকানের মেয়েটি আমাকে মৃদু হেসে জানালো, তাদের প্রতিষ্ঠানের বিক্রীত প্রতিটি বইয়ের ১ টাকা তারা ব্যায় করে থাকে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের সহোযোগীতায়। শুধু তাই না তাদের পুরো প্রতিষ্ঠানটিই স্বেচ্ছাসেবক দ্বারা পরিচালিত,এবং সে নিজেও একজন স্বেচ্ছাসেবক।
সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত বিদ্যানন্দকে যত দেখছি তত মুগ্ধ হচ্ছি।
এবার আসি বিদ্যানন্দের গল্পে, ‘বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন’ মূলত একটি বাংলাদেশী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সংগঠনটি কাজ করে থাকে পথশিশু, সুবিধা বঞ্চিত দরিদ্র ও অস্বচ্ছল শিশুদের মৌলিক শিক্ষা, আহার, চিকিৎসা এবং আইন সেবা প্রদানে। এক টাকায় খাবার–দাবারসহ চিকিৎসা এবং আইনি সহায়তা সত্যিই অবাক করার মত ব্যাপার, এই অবাক করা কার্যক্রম ২০১৩ থেকে এখন পর্যন্ত চালিয়ে যাচ্ছে ‘বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন’। ২০১৩ সালের ২২ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ থেকে এই ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু; এর প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাশ। যার শৈশব কেটেছে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে। এখনো যুদ্ধ করছেন, তবে ভিন্ন এক যুদ্ধ; অসহায়দের মুখে হাসি ফুটানোর যুদ্ধ, ক্ষুধার্তদের পেটে আহার যোগানোর যুদ্ধ। এ যুদ্ধে এখন তার শরীক হয়েছেন প্রত্যাক্ষ ও পরোক্ষভাবে পুরো দেশবাসী।
বিদ্যানন্দের লড়াইয়ের গল্প অসমাপ্ত। কখনো দরিদ্র শিশুদের মাঝে বৃত্তি প্রদান, আবার অসহায় সাঁওতালদের পাশে, আবার পার্বত্য রাঙামাটিতে পাহাড়ধস বিপর্যয়ে বিপদে আটকে পরা মানুষের সাহায্যে। আবার শিশুদের শৈশব রঙ্গিন করার মত হাস্যোজ্জল কার্যক্রম যেমন; ‘ফ্রেমে বাঁধা শৈশব’ অথবা ‘হাওরাঞ্চলে ঈদ উৎসব’ আবার কখনো বা ‘ছিন্নমূল শিশুদের জন্মদিন পালনের মত কার্যক্রম যা কেউ করার কথা মাথাতেও আনে নি এমন সব আনন্দ–অর্জনও রয়েছে তাদের ঝুলিতে।
এছাড়াও রয়েছে ‘বিদ্যানন্দ প্রকাশনী কার্যক্রম’, বিনামূল্যে প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য ‘অভিবাসন সহায়িকা বিতরণ’ ও ‘পথশিশুদের গোসল করানো’,আবার ‘পাচঁটাকায় ন্যাপকিন’, বইমেলায় পুরাতন জিনিসের বিনিময়ে বই, নির্বাচনী পোস্টারে লেখার খাতাসহ কত শত শত আয়োজন। ভালোবাসা বিলিয়ে দিতে যেন কখনো ক্লান্ত হয় না বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবীর দল।
বর্তমানে ‘অনাথ ও বঞ্চিত’ শিশুদের মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য বিদ্যানন্দ ৮ টি স্থানীয় শাখা সহ ৪০ জন কর্মকর্তা এবং শত শত স্বেচ্ছাসেবক দ্বারা এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। মাসে একদিন,সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বড় পর্দায় বিভিন্ন শিক্ষামূলক চলচ্চিত্র দেখানোর মত সুক্ষ বিবেচকের মত কার্যক্রম বিদ্যানন্দের। শুধু সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য নয়, সর্বস্তরের পাঠকের জন্য রয়েছে পাঠাগার, যা বিনা মূল্যে ব্যবহার করা যায়। বিদ্যানন্দ গ্রহীতাদের ভেতর ‘ভিক্ষা’ ও বন্টনকারীদের মধ্যে ‘দান’ শব্দটি মুছে ফেলার চিন্তা থেকেই ‘এক টাকায় আহার’কর্মসূচি। (তথ্যসুত্রঃ উইকিপিডিয়া)
এক টাকায় আহার কর্মসূচির আওতায় খাবার পেয়ে থাকে সব পর্যায়ের মানুষ। হোক সে ১২ বছরের নিচের সুবিধাবঞ্চিত শিশু অথবা ৬০ বছরের হতদরিদ্র বৃদ্ধ। খাবারের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়ার দৃঢ় এক প্রতিজ্ঞায় যেন সংসারের কর্তার মত বুক বেঁধেছে ‘বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন’। সেই সাথেই লক্ষনীয় বিষয়, প্রতীকী এই ‘এক টাকা’ নির্ধারন করা হয়েছে শিশুদের স্বাবলম্বি হওয়ার আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে। শিশুদের মধ্য থেকে ভিক্ষা বা দান নির্ভরশীল মনোভাব তৈরি না করাই এই ‘এক টাকা’ মূল্য নির্ধারণের উদ্দেশ্য।
নিয়মিত খাবারের তালিকায় থাকে ভাত,সবজি আর ডাল। আবার মাঝে মাঝে মুরগির মাংস, মাছ, ডিম, খিচুড়ি আর পোলাও যোগ হয় আবার কখনো হয়ত মিষ্টি। ঠিক যেন গৃহস্থবাড়ির একটা পরিবার, বাড়িতে অতিথি এলেই ভাল–মন্দ রান্না হয়। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে তৈরি হয়েছে কক্সবাজার জেলার রামুতে আদিবাসী অনাথদের একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল, সমপ্রীতি অনাথালয়। এক স্বেচ্ছাসেবক পরিবারের দান করা ১৫০ শতক জমির ওপর এটি গড়ে উঠেছে। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নয়, তাদের গড়ে তোলা হচ্ছে বিভিন্ন সৃজনশীল কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে। এখানেই শেষ নয় ২০১৭ সালে বাংলাদেশে সরনার্থী হয়ে আসা লক্ষাধিক রোহিঙ্গাদের পাশেও দাড়িয়েছিলো প্রতিষ্ঠানটি। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রায় প্রতিদিন আট হাজার মানুষকে শুকনো খাবার ও তিন হাজার মানুষের মধ্যে রান্না করা খিচুড়ি বিতরণ করেছিল তারা।
আবার এবছরের শুরুতে যখন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে ঢাকা–শহর নির্বাচনী প্রচারনা পোস্টারে ছেয়ে গেছিল, নির্বাচনের পর সেই পোস্টারই হয়েছিল ঢাকার আবর্জনার স্তুপ, তখন সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী ও কর্মীরা সেসব পোস্টার সংগ্রহ করে বানিয়েছেন সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের খাতা। একই সাথে শিশুদের খাতা এবং একই সাথে আবর্জনা মুক্ত ঢাকা।
সারাবিশ্ব যখন করোনার মহামারীতে আক্রান্ত, দেশে করোনা প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ, কিন্তু বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশ যেখানে বহুমানুষ ‘দিন আনে দিন খায়’ মাসের পর মাস লকডাউনে তাদের অবস্থা শোচনীয়, আর্থিক সংকটে আছে নিম্মমধ্যবিত্ত পরিবারেরাও। এই অবস্থায় বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনও থেমে নেই, মাঠে নেমেছে মানুষের সহায়তায়। মাস্ক বানিয়ে জনসাধরনের মধ্যে বিতরণ থেকে শুরু করে পাবলিক প্লেসে জীবানুনাশক ছিটানোর কাজ, হাসপাতালে জনসচেতনতা তৈরী, রান্না করে চাহিদাসম্পন্ন মানুষের হাতে খাবার বিতরন করে চলেছে বিদ্যানন্দ। হাত ধোয়া বেসিন বসানোর কার্যক্রম ও তাদের কর্মকান্ডের অন্তর্ভূক্ত। দেশের মানুষও যার যা আছে তাই দিয়ে সহয়তা করছে বিদ্যানন্দকে, করোনা পরিস্থিতিতে ‘এক টাকায় আহার’ বন্ধ থাকায় সেই উইং থেকে প্রতিদিন বিতরন করা হচ্ছে ৫০০০ মানুষের খাবার।দেশের সর্বস্তরের মানুষ যেমন পুলিশ থেকে শুরু করে প্রশাসন,স্কাউট, সামাজিক স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে সেই খাবার পৌছে যাচ্ছে বিভিন্ন এলাকায়। চাল, ডাল, তেল, সাবান ইত্যাদি নিত্যসামগ্রী পৌছে দিচ্ছে মানুষের হাতে।মধ্যবিত্ত একান্নবর্তী পরিবারের মত কারো হয়ত নগদ অর্থ নেই কিন্তু ত্রান পৌছে দিতে নিজের শখের গাড়িখানা দিয়ে দিতে কুন্ঠিতবোধ করছেন না। বাজারে মাস্ক সংকট দেখা দেওয়ায় ১০০০০হাজার মাস্ক, ৫০০লিটার হ্যান্ড স্যানিটাইজার ইতিমধ্যে উৎপাদন করেছে বিদ্যানন্দ। যার মধ্যে ২১০লিটার হ্যান্ড স্যানিটাইজার নিজেরা কিনেই বিতরন করেছেন মসজিদ, মন্দির ও নানান পাবলিক প্লেসে। এখন পর্যন্ত ডাক্তারদের সুরক্ষায় পিপিই দেওয়া হয়েছে দেড় হাজার। রাস্তার পাশে অভুক্ত পশুকেও বুকে টেনে নিয়েছে বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবীর দল। আর তাদের অর্থ যোগাতে, ঝাপিয়ে পরেছে দেশবাসী, সবাই তার সাধ্যমত সাহয্য নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে।
তাদের নতুন কার্যক্রম করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা সহায়তা দিতে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন। প্রাথমিকভাবে ৫০–শয্যা দিয়ে শুরু হওয়া ফিল্ড হাসপাতালটিতে পর্যায়ক্রমে ২০০–শয্যাবিশিষ্ট করার প্রস্তুতি রয়েছে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে হাসপাতালটির কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হওয়ার কথা রয়েছে, মানুষের সেবার পথে বিদ্যানন্দের আরো এক ধাপ।
শুরুটা যেহেতু বইমেলা দিয়ে করেছি, তাই বইমেলা দিয়েই করি। গতবছর বইমেলার গল্প বলি, গত বছর বইমেলায় বিদ্যানন্দের স্টল তো ছিল, কিন্তু স্টলে ছিল না কোন বিক্রেতা। যে বই পছন্দ সেই বই নিয়ে, সমমূল্যের অর্থ রেখে যেতে হবে। এবং বইমেলা শেষে দেখা যায়, সততা এখনো হারিয়ে যায় নি মানুষের মাঝে। ভাবুন তো সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে এমন একটা খবর পত্রিকার পাতায় পড়লে,মন ভাল না হয়ে উপায় থাকে?
এবছরও যথারীতি বইমেলায় বিদ্যানন্দের নতুন চমক, অব্যবহৃত অসুধের বদলে কিনতে পারেন নতুন বই, অথবা অব্যবহৃত অসুধ চাইলে দান করতে পারেন তাদের ফাউন্ডেশনে। এমন অকল্পনীয় কিছু উদ্যোগেই বদলে যাবে মানুষের জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। বিদ্যানন্দের কর্মকান্ড যত দেখি আমার তত কামিনী রায়ের একটা কবিতা আওরাতে ইচ্ছে করে,
“সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে “
কলমে শাওনী রুদ্র তিতলী ,বাংলাদেশ, স্টুডেন্ট অফ ‘Ahsanullah University of Science and Technology’, Department of Electrical and Electronics Engineering
Warning: Attempt to read property "roles" on bool in /home3/weavesdi/public_html/www.monomousumi.com/bengali/wp-content/themes/morenews/inc/template-functions.php on line 941