জাপান, জাপানীস এ নিপ্পন [ippoɴ] বা নিহন [ihiho] নামে পরিচিত এই দেশটি, পূর্ব এশিয়ায়, প্রশান্ত মহাসাগরে পূর্ব উপকূলে অবস্থিত একটি সার্বভৌম দ্বীপ । কাঞ্জি (Kanji ) ভাষায় জাপান কথার অর্থ ‘সূর্যের উৎস’ ,তাই জাপান এর আর এক নাম “Land of the Rising Sun” ।

এই জাপানের অন্যতম সুন্দর শহর কিয়োটো (京都, Kyōto) ,যা এক হাজারেরও বেশি বছর ধরে জাপানের সাবেক সাম্রাজ্য এর রাজধানী হিসেবে জাপানের ইতিহাসে বিশেষভাবে পরিচিত। শতাব্দী ধরে, অনেক যুদ্ধ ও অগ্নিকান্ডের মধ্য দিয়ে কিয়োটো ধ্বংস হতে থাকলেও , তার অসাধারণ ঐতিহাসিক মূল্যের কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শহরটি পরমাণু বোমার লক্ষ্য তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয় এবং এটি সেই ঐতিহাসিক ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। অগণিত বৌদ্ধ মন্দির, শ্রাইন (Shrine), অন্যান্য ঐতিহাসিক মূল্যবান কাঠামো এবং অসাধারণ সৌন্দর্য্যকে বুকে নিয়ে আজ কিয়োটোও বেঁচে আছে।

কিয়োটো Yamashiro উপত্যকার এক অংশে অবস্থিত একটি শহর যার তিন দিক ঘিরে রেখেছে হিগাশিয়ামা (Higashiyama), কিতায়ামা (Kitayama ) এবং নিশিয়ামা (Nishiyama) নামে তিনটি পর্বত। সেভাবে বলতে গেলে এটি নদী আর পাহাড়ে ঘেরা , প্রকৃতির এক অনবদ্য উপহার। এটি বিখ্যাত এর সৌন্দ্যর্য -ঐতিহাসিক মূল্য ও তার সংরক্ষণের জন্য। এই শহরে রয়েছে দুই হাজার ধর্মীয় স্থান, যার মধ্যে 1,600 বৌদ্ধ মন্দির এবং 400 টি শিন্টো মঠ বা শ্রাইন , যা শুধু মাত্র জাপানেই দেখা যায়। ধর্মীয় স্থানের পাশাপাশি প্রাসাদ, বাগান এবং স্থায়ী স্থাপত্য – এই শহরকে জাপানের সেরা সংরক্ষিত শহরগুলির একটি করে তুলেছে ।যে কোন মানুষ ধারণা করে নিতে পারবেন ,যে শহরটি কি মায়া আর ঐতিহ্য বহন করে চলেছে , যখন জানবেন যে , জাপানের ২২ টি বিশ্ব ঐতিহ্য (UNESCO World Heritage ) এর ১৭টি এই শহরেই অবস্থিত।
এবার আসা যাক কি ভাবে আমার এ দেশের সাথে, এই শহরের সাথে আলাপ। কর্মসূত্রে ২০১৮ এর, গত ফেব্রুয়ারি মাসে আমি আসি কিয়োটো শহরে। কিয়োটো শহরে কোনো বিমানবন্দর নেই , তাই আমাদের, জাপানের অন্য একটি প্রধান শহর, ওসাকার (Osaka) কানসাই এয়ারপোর্ট হয়ে কিয়োটো আসতে হয়। আগামী এক বছরের আমার ঠিকানা সুগাকুইন ইন্টারন্যাশন হাউস (Shugakuin International House )। হ্যাঁ , এটি একটি গেস্ট হাউস , তবে শুধু মাত্র বিদেশীদের জন্য , যারা কর্মসূত্রে কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত। এই গেস্ট হাউস পাওয়াটা অনেক সৌভ্যাগের বটে , কারণ প্রথমতঃ লটারি ব্যবস্থার মাধ্যমে এখানে ঘর পাওয়া যায় , দ্বিতীয়তঃ দেশ বিদেশ থেকে হাজারো মানুষ একই সাথে কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়তে বা গবেষণা করতে আসলে , এখানে ঘর পাওয়ার জন্য বুকিং করেন। এই হাউসটি কিয়োটো ইউনিভার্সিটি থেকে ৩.৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটা সুপরিকল্পিত নগরীর অন্তর্গত যার নাম সুগাকুইন । হাতের কাছে অসংখ্য দোকান , বাজার ,স্কুল , পার্ক সবই পেয়ে যাবেন আর সাথে পাবেন দেশ বিদেশ থেকে আসা বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষকেও।
এখানে মানুষরা গাড়ি আর সাইকেল এ বেশি ব্যবহার করে তাদের দৈনন্দিন কাজের উদ্যেশে , কারণ আমাদের দেশের মতো রিক্সা বা অটো এখানে চলে না। চলে তো ট্রেন আর বাস। বাস এ এক স্টপ গেলেও মাথাপিছু ভাড়া ২৩০ ইয়েন (ইয়েন জাপানীস মুদ্রা ), আবার শেষ স্টপে গেলেও ২৩০ ইয়েন। তবে ট্রেনের ব্যবস্থা আলাদা ,দূরত্ব দেখে ভাড়া নির্ণয় , নূন্যতম ভাড়া ২১০ ইয়েন। তাই এদিক ওদিক দোকান বা স্কুলে যেতে সাইকেলই শ্রেষ্ঠ। অন্যদের মতো আমাদের ও এরকম দুটি সাইকেল , একটি বেবি সিট্ যুক্ত। হ্যাঁ ঠিক পড়েছেন ,বেবি সিট্। এখানে বাচ্চাদের ক্যারিয়ারে বসিয়ে পা ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া আইনত নিষিদ্ধ। জাপানের সব জায়গায় সাইকেল জিনিসটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে সাইকেল এর রেজিস্ট্রেশন থেকে ইন্সুরেন্স সব হয়।সাথে বাচ্চাদের হেলমেট পরিয়ে যথাযত বেবি-সিট্ এ বসিয়ে সাইকেল চালাতে হয় নইলে ফাইন ভরতে হয়।সাইকেল ও বিভিন্ন রকম , সাধারণ থেকে ইলেকট্রিক ,তাও নানা প্রযুক্তি যুক্ত। এখানে মাঝে মাঝে চোখে পরে সাইকেল এর বিশাল মল। সাইকেল এর দাম ২৫০০০ যেন থেকে শুরু করে ৩ লক্ষ ও চোখে পড়েছে আমার। এখানে ৪ বছরের শিশু উদ্বেগহীন ভাবে বড় রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে পার হয়ে যায় অনায়াসে। দেখা যায় ৮০ বছরের উর্দ্ধ বৃদ্ধ -বৃদ্ধা কেও সাইকেল চালিয়ে যেতে।
জাপানের অন্যান্য শহর গুলোর তুলনায় কিয়োটো যেন খুব শান্ত-সিন্গ্ধ , যেন দেবতা এখানে বাস করেন। টোকিও -ওসাকা -নারা , জাপানের আরো অন্যতম প্রসিদ্ধ শহর গুলো ঘুরে এটুকুই মনে হয়েছে কিয়োটো যেন মনের খুব কাছের শহর। চারপাশ এতটাই সুন্দর -পরিষ্কার , যে রাস্তা ঘাটে যেকোনো জায়গায় বসে পড়লেও আপনার কিছু মনে হবে না। সাথে রয়েছে এখানকার মানুষের অমায়িক ব্যবহার , সাহায্য করার আপ্রাণ চেষ্টা , আর মাথা নত করে মৃদু হাসি। গত সাত মাসে একটি বারের জন্য মনে হয়নি আমি এদের কেউ নই। মনে আছে প্রথম প্রথম দিন গুলো সাইকেল চালিয়ে মেয়েকে স্কুলে আনতে গেলে চোখে পড়তো এরকমই অনেক মানুষের হাসিমাখা মুখ যারা আমাকে না চিনেও মাথা নত করে বলতো Konnichiwa (ইংলিশ এ Hi/Good day )। তখন আশ্চর্য্য লাগতো , আমার মাথা নত হতো না। কিন্তু আজ আমিও ওদের লোক হয়ে গেছি , আপনা আপনি মাথা নত (Greeting ) করে Hi বলতে কিন্তু বেশ লাগে।আরো একটি শব্দ যা জাপানে এলে সবার প্রথমে যে কেউ শিখবে সেটা হলো “Arigatou gozaimasu” আরিগাতো , মানে ধন্যবাদ। দোকানে , স্কুলে , রাস্তা ঘাটে ,পরিচিত-অপরিচিত সব কিছুর বাঁধন ভাঙা এই কথা “আরিগাতো”, কারণ এরা কাউকে ধন্যবাদ জানাতে পারলে বোধহয় সব থেকে বেশি খুশি হয়।
এই শহরটিকে যত দেখেছি ততই আশ্চর্য্য হয়েছি বার বার।প্রতি সপ্তাহান্তে কোথাও না কোথাও ঘুরতে গেলে চোখে পড়েছে বিরল সব ঘটনা , আজ আমার কাছে বিরল হলেও জাপানীস দের কাছে খুবই সাধারণ। যেমন এদের পাবলিক টয়লেট , কেউ বলবে না ওটা পাবলিক এর , বাড়ির থেকেও পরিষ্কার। রাস্তা ঘাট এ কোনো নোংরা নেই ,কারণ এরা নিজের হাতে তা পরিষ্কার করে উঠিয়ে নিয়ে যায় , রাস্তায় গাড়ি না থাকলেও ট্রাফিকের লাল লাইট এর অমান্য করতে আজ অবধি কাউকে দেখিনি , দেখিনি ভিড় বাস এ কোনো ঠেলাঠেলি বা জোরে কথা বলা -আওয়াজ। দেখিনি প্রকাশ্য ধূমপান বা বাস ট্রেন এ মোবাইল এ কথা বলা।এখানে বাস এর দুটি দরজা আলাদা ভাবে খোলে , একটি লোক নামাতে একটি লোক ওঠাতে। এখানে ভিড় ট্রেন এ ও মানুষ অপেক্ষা করে লাইন দিয়ে ট্রেনে ওঠে। চলমান সিঁড়িতে দেখা যায় এক বিরল লাইনের দৃশ্য।
আমাদের গেস্ট হাউসের লাগোয়া সুগাকুইন রেল স্টেশন। এই স্টেশন এ এক-দুই কখনো বা তিন বগির ট্রেন চলে। দেখতে অনেকটা টয় ট্রেনের মতো। তবে কিয়োটো স্টেশন বা অন্য বড় স্টেশন এ এক্সপ্রেস ট্রেনের সাথে সাথে বুলেট ট্রেনের দেখা মেলে।
এখানে একই রাস্তার দুধারে এক এক সময়ে চোখে পড়েছে মরসুমের ফুল।চড়াই রাস্তা ছাড়া এখানে ঘন্টা খানেক সাইকেল চালিয়ে বহুদূর চলে যেতে বেশ লাগে। এখানে ফেব্রুয়ারী থেকে মার্চ অবধি থাকে সাকুরা (Cherry Blossom Season ), সেই সময় বিদেশিদের সাথে সাথে , জাপানের বিভিন্ন শহর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পর্যটকরা আসেন এখানে সাকুরা দেখতে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। এক হিমেল ঠান্ডা হাওয়ার সাথে সাদা লাল গোলাপি নানা রঙের ফুলের মেলা। এ সময় কিয়োটোর বোটানিক্যাল গার্ডেন এ চলে লাইট শো।

কিয়োটোর গলি গলি তে রয়েছে কোনো না কোনো মন্দির নয়তো শ্রাইন। শ্রাইন আর মন্দিরের মধ্যে কিছু তফাৎ থাকলেও ধর্মতত্তক দৃষ্টিকোণ থেকে সেরকম কোনো পার্থ্যক নেই। শ্রাইন হলো শিন্টো সম্প্রদায় এর তৈরী ধর্মপীঠ , এদের পুজো করার পদ্ধতি একটু আলাদা ,প্রতিটি শ্রাইন এর সামনে থাকে একটি টোরি “Tori ” গেট। আর মন্দির বলতে জাপানে সবই বৌদ্ধ মন্দির।
গত সাত মাসে ১৭ টি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ র ১২ টি দেখা সম্পূর্ন করে ফেলেছি। প্রতি সপ্তাহান্তে একটি করে জায়গায় আমরা গেছি। কেউ যদি ১৫-২০ দিনের জন্য জাপান ঘুরতে আসেন এবং ৩-৪ দিন কিয়োটো শহরের জন্য রাখেন তবে তাকে কিয়োটোর সব কটি জায়গা না ঘুরে দেখলেও যেগুলো দেখতেই হবে বা অন্যতম সেগুলি ,
এক : কিউমিজু-ডেরা (Kiyomizudera 清水寺, literally “Pure Water Temple”) : এটি পর্বতশৃঙ্গের ওপর তৈরি জাপানের অন্যতম সুপ্রসিদ্ধ একটি চমৎকার কাঠের মন্দির; Kiyomizudera একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ , এটি সেরা তার কাঠের মঞ্চের এর জন্য ,যেটি পাহাড়ের 13 মিটার উপরে প্রধান হল এর বাইরে ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে । পর্যটকরা বসন্ত এবং হেমন্তকালে চেরি এবং ম্যাপেল গাছগুলির একটি চমৎকার দৃশ্য এবং সেইসাথে দূর থেকে কিয়োটো শহরটি চমৎকার দৃশ্য দেখার জন্য এখানে এসে থাকেন ।


দুই :নিজো কাসল (Nijo Castle , 二条城, Nijōjō ) : এটিও একটি UNESCO world heritage site।এই দুর্গটি জাপানের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।এটি কিয়োটোর বৃহত্তম এবং শ্রেষ্ঠ সংরক্ষিত দুর্গ। এর দুটি অংশ , নিনাোমারু প্রাসাদ( প্রাসাদের প্রধান দুর্গ ) এবং হনমারি প্রাসাদ এর ধ্বংসাবশেষ ।
আজ, নিনাোমারু প্রাসাদ এর প্রধান হল দুর্গটির প্রধান আকর্ষণ। ছাপানো সিলিং, সুন্দরভাবে আঁকা স্লাইড দরজা, তাতামি (বাঁশের মাদুর) মেঝে,এই হল এর আকর্ষণ।এই হলের মেঝের ওপর দিয়ে হাঁটলে এক রকমের আওয়াজ শোনা যায় , যা প্রাচীন কালে অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে সতর্কতা হিসাবে কাজ করতো ।

তিন : কিংকাকু-জি : কিংকাকুজি (金 閣 寺, গোল্ডেন প্যাভিলিয়ন) কিয়োটোর উত্তরে অবস্থিত একটি জেন মন্দির, যার উপরে দুটি মেঝে সম্পূর্ণরূপে সোনার পাতে আচ্ছাদিত।এটিও একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ। এই মন্দিরের সামনের বিশাল পুকুরে এর সোনালী রূপ দেখতে ও ছবি তুলতে সব সময় পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে।এটির আর একটি মডেল গিনকাকুজি (銀 閣 寺, সিলভার প্যাভিলিয়ন) নাম পরিচিত।

চার : ফুশিমি ইনারি শ্রাইন (伏見稲荷大社, Fushimi Inari Taisha) : এটি দক্ষিণ কিয়োটোর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিন্টো শ্রাইন। এটি তার হাজার হাজার টোরি গেটের জন্য বিখ্যাত, যা ধীরে ধীরে মাউন্ট ইনারির দিকে চলে গেছে। প্রতিটা টোরি গেট কেউ না কেউ, কারোর নামে উৎসর্গ করেছে। সব থেকে ছোট গেটের উৎসর্গকৃত মূল্য ৪ লক্ষ ইয়েন আর সব থেকে বড় গেটের মূল্য শোনা যায় এক মিলিয়ন ইয়েন এর ও বেশি।

পাঁচ : তজি মন্দির ( Toji Temple (東寺, Tōji) ) : এটিও একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ এবং এটি বিখ্যাত এর পাঁচতলা উঁচু প্যাগোডার জন্য , যেটি কিয়োটোর একমাত্র। প্যাগোডার সাথে সাথে এই মন্দিরের চারপাশের বাগান ও পরিবেশ এতো মনোরম যে বসন্ত কালে এটি একটি মায়া নগরীর রূপ ধারণ করে।

ছয় : কিয়োটো টাওয়ার : ১৩১ মিটার উঁচু এই টাওয়ার টি কিয়োটো স্টেশনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। যার ডেক থেকে যে কেউ দেখতে পারবে কিয়োটো শহরের অনাবিল সৌন্দর্যের মায়া রাজ্য।

সাত : আরাশিয়েমা : Arashiyama (嵐山) কিয়োটোর পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত একটি মনোরম, আকর্ষণীয় জেলা।এটি বিখ্যাত এর Togetsukyo Bridge, Bamboo Groves এবং দুটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ মন্দির Tenryuji Temple ও Daikakuji Temple এর জন্য।

আট : রয়ানজি মন্দির Ryoanji :রয়ানজি মন্দির (龍 安 寺, Ryōanji) হল জাপানের সবচেয়ে বিখ্যাত শিলা বাগান এর একটি ,যেখানে প্রতিদিন শত শত পর্যটকদের ভিড় হয় । বাগানটিতে আয়তক্ষেত্রাকার দেওয়াল ঘেরা জায়গায় , 15 টি পাথর ছোট ছোট গোষ্ঠীর মধ্যে বসানো রয়েছে। এই বাগানের বিশেষত্ব বা নকশার একটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল যে, যে কোন দিক থেকে বাগানের ওই ১৫ টি পাথরের দিকে দেখলে, একটা না একটা পাথর লুকায়িত অবস্থায় থাকবে ,সেটা দেখা যাবে না।

নয় : যাসাকা শ্রাইন ,Gion : Yasaka Shrine (八坂神社, Yasaka Jinja) ,GION শ্রাইন নামেও জনপ্রিয়। এটি কিয়োটোর Gion জেলার অন্তর্ভুক্ত একটি শ্রাইন। এটি কিয়োটোর সবথেকে প্রসিদ্ধ উৎসব Gion মাৎসুরির জন্য জানা যায়। কিয়োটোর মূল মূল উৎসব গুলোর নাম মাৎসুরি দিয়েই আসে , যেমন Aoi মাৎসুরি , মিতারাশি মাৎসুরি ইত্যাদি।আমি যথেষ্ট ভাগ্যবান যে আমি এই সব উৎসব গুলি উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছি।
দশ : নিশিকি মার্কেট : 錦市場, Nishiki Ichiba, Sanjo ও shijo Kawaramachi এর কাছে অবস্থিত একটি খাদ্য মার্কেট। এখানে জাপানের সব ধরণের খাদ্য উপকরণ যেমন সুসি ,জাপানীস আচার , শুকনো সামুদ্রিক মাছ, মিষ্টি ইত্যাদি এখানে পাওয়া যায়।এই মার্কেটকে কিয়োটোর কিচেন ও বলা হয় ।

এগারো : এঁর্যাকুজি মন্দির ও মাউন্ট হিয়েই : জাপানের হিউজান (比叡 山,মাউন্ট Hiei ) পর্বতমালার অবস্থিত, Enryakuji (延 暦 寺) মন্দির ,জাপানি ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মঠ এবং জাপানি বৌদ্ধ ধর্মের তেন্ডাই সম্প্রদায়ের সদর দপ্তর। অনেক প্রভাবশালী ভিক্ষুরা Enryakuji এ আজও অধ্যয়নরত।এদের কঠোর শিক্ষা ব্যবস্থ্যা ও সাধনা ,বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে অন্যতম।

বারো : সুগাকুইন ইম্পেরিয়াল ভিলা: সুগাকুইন রাজবাড়ী , সুগাকুইন গেস্ট হাউস থেকে ২ কিলোমিটার দূরে চড়াই বেয়ে , যেটি জাপানের সেরা বাগানের একটি।

তেরো : বিবা লেক : এটি জাপানের সব থেকে বড় শুদ্ধ জলের লেক। এটি এতটাই বড় যে এর একপাশের সৈকত দেখলে কেউ বুঝবে না এটা কোনো ঝিল না সমুদ্র ,নীল স্বচ্ছ জল , জাপানীস সমেত বিদেশিদের মন কারে। এই লেকের এক পশে রয়েছে Omimako সৈকত। লেক এ রয়েছে বিশাল একটি cruise ন্যায় জলযান , যা আপনাকে ১ ঘণ্টা থেকে দেড় ঘন্টার সফর করিয়ে দেখাবে আসে পাশের দু একটা দ্বীপ। এটির ভাসমান টোরি গেট এটির একটি অন্যতম আকর্ষণ। এখানে প্রতি বছর অগাস্ট মাসে ১ ঘণ্টার লাইট শো হয় , যা দেখতে দূর দূরান্ত থেকে লাখের ও বেশি পর্যটকরা ভিড় জমায়।


চৌদ্দ :হেইয়ান শ্রাইন একটি শিনটো মঠ, যা 1895 সালে নির্মিত হয়েছিল, ইম্পেরিয়াল পরিবার উদ্যাপন করে এবং কিয়োটোতে বসবাসের জন্য প্রথম ও শেষ সম্রাটদের স্মরণ করায় ।এই শ্রাইন এর দৈত্যাকার টোরি গেট ,প্রশস্থ মাঠ ও মাসিক বিভিন্ন মেলা যে কোন পর্যটকদের বার বার হাতছানি দিয়ে যাবে।

পনেরো :কিয়োটো অ্যাকোয়ারিয়াম :Kyoto Aquarium আমার আর আমার পরিবারের ভালো লাগার জায়গাগুলো একটি। এখানে কি যে নেই তা ঠিক ভেবে দেখতে হবে। এখানকার সমুদ্রে যত রকমের প্রাণী দেখা বা পাওয়া যায় তা এই অ্যাকোয়ারিয়াম এর অন্তর্ভুক্ত। ডলফিনের নাচ থেকে পেঙ্গুইনের জল ঝাপটা। সাথে লখিন্দরের কাহিনীর সুচ সম সাপ ও। কিছুই বাদ রাখেনি এই অ্যাকোয়ারিয়াম। কিয়োটো স্টেশন থেকে ১০ মিনিটের বাস পথ এ পোঁছে যাবেন এই অ্যাকোয়ারিয়াম এ।


এছাড়াও ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ শিমোগামো -কামিগমো টেম্পল , নানজিনজি টেম্পল, এইকাণ্ড টেম্পল,কিয়োটো ইম্পেরিয়াল ভিলা ,ঝা চকচকে Sanjo-Shijo Dori (Dori মানে রাস্তা ) , কিয়োটো স্টেশন প্রান্তর , বিগ ক্যামেরার দোকান ,কিয়োটো বোটানিক্যাল গার্ডেন ,সুগাকুইন এর পাশে সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ আর বয়ে যাওয়া কামো নদী , সব সময় আমাকে হাতছানি দেয়। এসেছি পর্যন্ত শনি -রবিবার বাদ দিয়েও যে কতদিন কত জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি , কত অনুষ্ঠানে গেছি , তা বলার নয়। এই দেশ শহর কে দেখে আমাদের দেশের কথাই মনে পরে। এদের বারো মাসে তেরো পার্বন। রোজ এ কিছু না কিছু অনুষ্ঠান লেগেই থাকে।এরাও আমাদের মতো ধর্মে বিশ্বাসী আবার কুসংস্কারেও। প্রতিটা ধর্মস্থলে চোখে পরবে ধূপকাঠি-মোমবাতি জ্বালানোর স্ট্যান্ড ;লাইন দিয়ে ঘন্টা বাজানোর অপেক্ষারত মানুষ ; আর মনোকামনা পূরণ বা গুডলাক বজায় রাখার সরঞ্জামের বহু দোকান।


এখানেও গরমের ছুটিতে মেলা বসে , ছোট ছোট বাচ্চাদের আনন্দ উচ্ছল মুখ মনে করিয়ে দেয় নিজের ছোটোবেলাকে। দেশ- কাল- সময় আলাদা হলেও সংস্কৃতির প্রবাহ যেন কোথাও মিলে যায় ভারত আর জাপানের।
একটা কথা মনে রাখার বিষয় , যেহেতু কিয়োটো তে জাপানীস রা প্রায় একদম ই ইংলিশ বোঝে না , তাই মোবাইল ইন্টারনেট আর জিপিএস সিস্টেমটা চালু থাকলে যে কেউ কিয়োটো কেন জাপানের যে কোনো জায়গায় পৌঁছাতে পারবে। আমার সব যাত্রার সাথী আমার মোবাইলের জিপিএস সিস্টেম।
এই কদিনে ভ্রমণের সাথে সাথে অভিজ্ঞতা হয়েছে রেকর্ড করা ভূমিকম্প বা ভূমিকম্পনের। ২১ বছর আগে এভাবেই নাকি কিয়োটো দুলে উঠেছিল যা হয়েছিল গত ১৮ জুন ,২০১৮ তে। প্রায় ১০-১৫ দিন ঘুমোতে পারিনি। মনে হয়েছে সব যেন নড়ছে। প্রায় ৪৫ টা aftershocks , তার পর পর এ বন্যার এলার্ট, যা কিয়োটো কে ছুঁতে না পারলেও হিরোশিমা কে ভাসিয়ে গেছে। ইদানিং চলছে টাইফুন এর এলার্ট।এতো সুন্দর দেশের যদি কিছু একটা অপূর্ণতা থাকে তা হলো এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
জাপান-কিয়োটো বা জাপানীস দের কথা বলে শেষ করার মতো নয়। যত দিন এগোচ্ছে প্রতিটা দিন কিছু না কিছু শেখার মতো। কিয়োটো তে ৯৫% লোক ইংলিশ বোঝে না ,তবুও দিব্যি সব কাজ হয়ে যায় , স্কুল-দোকান পাঠ সব। কি করে , এইটা যেমন শেখার তেমন জাপানীসরা শেখায় কি ভাবে তারা তাদের দেশকে ভালোবাসে। এরা ছোট বয়েস এ নার্সারী থেকে বাচ্চাকে শেখায় পরিবারের মূল্যবোধ আর তারপর দেশের জন্য কর্তব্যবোধ । এখানে স্কুলের পড়ানোর ব্যবস্থাপনা এখন বিশ্বখ্যাত।
জাপান সম্পর্কে অনেকের অনেক রকম ধারণা আছে বা থাকবে।অনেকের মতো আমারও ইচ্ছে ছিল ইউরোপ বা আমেরিকা যাওয়ার , কিন্তু ভাগ্যচক্রে এসে পড়েছি এই জাপানের কিয়োটো শহরে। আজ গর্ব করে বলতে পারি ভাগ্যিস , এসেছিলাম, নইলে কি যেন একটা বাদ থেকে যেত জীবন থেকে। কিন্তু যতদিন না এই সুন্দর দেশ, সুন্দর শহরকে নিজের চোখে দেখবেন ততদিন বিশ্বাস করা সম্ভব না এরকম ও আশ্চর্য্য এক দেশ বা শহর আছে , অনেকটা আজব গাঁয়ের আজব কথার মতো।যেমন কোনো দেশ বা প্রজাতির বিষয়ে ১০০% অভিজ্ঞতা হওয়া এক বিশাল গবেষণার বিষয় , তেমনই সেই অভিজ্ঞতাকে ভাষায় প্রকাশ করা বা তাতে ইতি টানা টাও ততটাই মুশকিল। তাই যত বলবো যত লিখবো কম পরবে। আমার জাপানে জীবন এভাবেই চলছে ও আগামী দিনে চলবে।

— মৌসুমী কুন্ডু পাল
Warning: Attempt to read property "roles" on bool in /home3/weavesdi/public_html/www.monomousumi.com/bengali/wp-content/themes/morenews/inc/template-functions.php on line 941