পুজো আসে আর চলে যায়| আমরা বড় হই| পুজো আবার আসে আবার চলে যায় | আমরা আরো একটু বড় হই| পুজো মানে আমার কাছে স্মৃতি| কিছু স্মৃতি হরিয়ে যায়, কিছু স্মৃতি হারায় না, লুকিয়ে থাকে দিনের আলোর গভীরে| যে স্মৃতি হারিয়ে গেছে তার নিশ্চয় প্রয়োজন ছিল না| কিন্তু যে স্মৃতিগুলো হারাতে চাইনি অথচ হারিয়ে গেছে তার জন্য শুধু থেকে যায় একটা অব্যক্ত বেদনা আর দীর্ঘশ্বাস| জন্ম থেকেই আমি সহজ সরল প্রকৃতির মানুষ| জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া আমার ধাতে ছিল না| তোমরা যাকে বোকা বল আমি তাই ছিলাম| বাড়িতে সবাই বলত আমার মাথায় নাকি ঘিলু বলে কিছু নেই | পাড়ার ছেলেরা তাই আমায় বোকা বলে ডাকত | বোকার ছাপ নাকি মুখে লেগে থাকে| ছোটবেলায় সাবান দিয়ে কতবার মুখটাকে ঘষতাম, যদি ছাপটা উঠে যায়| কিন্তু সাবানে এই ছাপ উঠে না| পুজোয় আমি বিশ্বাস করি আবার করি না| কেউ বললে আমি অঞ্জলি দেই আবার কেউ না বললে আমি দেই না| কিন্তু পুজোর মন্ডপে বসে থাকতে আমার ভালো লাগে| পুজোর আগের দিন কে মা দুর্গাকে শাড়ি পরায় আমি জানিনা, দশটা হাতের ব্লাউসই বা কে বানায় তাও আমি জানিনা| মা দুর্গাকে দেখতে অনেকে আসে| ভিড় হয়, ঠেলাঠেলি করে ঠাকুর দেখার জন্য| আমি শুধু বসে থাকি কখন আমার ও আসবে| আমার ও কি সুন্দর দেখতে, ঠিক একটা ফুলের মতো| মেমসাহেবের মত গায়ের রং | মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল ঘাড়ের ওপর নেমে এসেছে ঠিক যেন একটা মেঘের মত| ঠোঁট দুটো ঠিক কমলা লেবুর মত| ওকে দেখলে আমার যেন কি হয়, আমি সব ভুলে গিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি| আমি জানি ওর জন্য আমি সব কিছু করতে পারি, তাকেই তো ভালোবাসা বলে তাই না? আমি ওকে ভীষণ ভালোবাসি | আমার ও বন্ধুদের সঙ্গে এসেছিল পুজো দেখতে | আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি দেখে ওর বন্ধুরা ওকে কিছু বলল , ও ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে ফিরে একটা ঘৃণার ভ্রূকুটি দিয়ে চলে গেল| আমি লজ্জায় মাটিতে মিশে গেলাম| এরপর থেকে ওকে দেখলে আমি ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম , কিন্তু তাও আমার চোখদুটোকে ওর ওপর থেকে সরিয়ে নিতে পারতাম না| আমার ও গাড়ি করে স্কুলে যায় আবার গাড়ি চড়ে ফিরে আসে| আমার ও থাকে আমাদের ভাঙ্গাচোরা বাড়িটার উল্টো দিকের ওই মস্তবড় বাড়িটায়| আমার বাবার গাড়ি নেই আমার বাবা গরিব| আমার বাবা কেরানি | সবাই বলে কেরানির ছেলে কেরানি হবে না তো কি হবে? সবাই যা বলে তাই হয়|
আমার ওর বিয়ে হলো, সানাই বাজল, কত বড় বড় লোকেরা এল, কত গাড়ি এল , কত আলো ঝলমল করল | আমি শুধু দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখলাম| আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল | আমার ও হারিয়ে গেল| পুজো আসে আর চলে যায় আমরা বড় হই| পুজো আবার আসে আবার চলে যায় | আমরা আরো একটু বড় হই| সবাই বলে কেরানির ছেলে কেরানি হবে না তো কি হবে? সবাই যা বলে তা হয় না| আমার ছেলে নাম করা ডাক্তার| তার মাথাভর্তি কালো চুল, আমার চুল সাদা| আমার ছেলে লম্বা দেখতে ভালো , আমার হাতে লাঠি| আমার ছেলে জোর করে ছিনিয়ে নিতে পারে, আমি খুঁড়িয়ে হাঁটি| আমার ছেলের মুখে বোকার ছাপ নেই, আমার মুখ আর দেখি না| আমার ছেলেকে কেউ বোকা বলে ডাকে না, আমি কানে কম শুনি| পুজোর সময়ে আমার ছেলে আমায় ধরে ধরে নিয়ে এল পুজোর মন্ডপে | আমি চেয়ারে বসে আছি, একটি অল্পবয়সী মেয়ে এসে আমায় প্রনাম করল| আমি মুখ তুলে তাকালাম| অবাক হয়ে গেলাম মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে| আরে এ তো আমার ও | সেই মুখ, সেই চোখ, সেই ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া মেঘের মত চুল, সেই কমলালেবুর মতো ঠোঁট | অবিকল সেই চেহারা | কি করব, কি বলব ভাবছি| হঠাৎ ছেলে এল এক ভদ্রমহিলাকে সঙ্গে নিয়ে| আলাপ করিয়ে দিল| আমরা দুজনে দুজনকে নমস্কার করলাম হাতদুটো জড়ো করে| ভদ্রমহিলার মুখে মৃদু হাসি| চেহেরা একটু ভারি হয়েছে, মাথার চুলে পাক ধরেছে, চোখে উঠেছে চশমা, কিন্তু গায়ের রং এখনও মেমসাহেবদের মত| আমি লজ্জায় কুঁকড়ে গেলাম, মাটিতে মিশে যেতে চাইলাম | ভয়ে ভয়ে আবার তাকালাম ওর দিকে| অবাক হয়ে গেলাম| ঘৃণার ভ্রূকুটি দেখছি না তো| আমার কি চোখটা আরো খারাপ হয়ে গেল? বুঝলাম সব কিছু| আমি আমার ওকে চিনতে পারলাম, কিন্তু আমার ও আমাকে চিনতে পারেনি |
কিছু স্মৃতি হারিয়ে যায়, কিছু স্মৃতি হারায় না, লুকিয়ে থাকে দিনের আলোর গভীরে| যে স্মৃতি হারিয়ে গেছে তার নিশ্চয় প্রয়োজন ছিল না| কিন্তু যে স্মৃতিগুলো হারাতে চাইনি অথচ হারিয়ে গেছে তার জন্য শুধু থেকে যায় একটা অব্যক্ত বেদনা আর দীর্ঘশ্বাস|
লেখক পরিচিতি : সুব্রত মজুমদার