আজ বছর পাঁচেক পর দিল্লী খেটে ফারাক্কা এক্সপ্রেস করে বাড়ি ফিরছে রতন। বুকে অনেক আশা, টালি সরিয়ে ছাদ ঢালবে – রোমাকে ঘরে তুলবে। বহু বছর ধরে বেচারী অপেক্ষা করে আছে তার জন্য। দু বছর তো তার সাথে কোথাই হয়নি। ট্রেনে চাকার ঘটাং ঘটাং খট এর সঙ্গে বুকের ধকধকানি মিলে মিশে এক প্রবল অনুরনন সৃষ্টি হলো তার চওড়া বুকের মধ্যে। ফুটন্ত দুধ যেমন হঠাৎ করে ফুলে ফেঁপে হাড়ির মুখ থেকে উপচে পড়তে চায় রতনের ভালোবাসাও যেন বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে সব একসাথে। ট্রেন মালদা স্টেশনে ঢুকলো। রতনের পুরো শরীরেই যেন আনন্দের জোয়ার এলো। এরকম দৌড়েই ঘরে ঢুকলো রতন। মা বাবাকে প্রণাম করে হাত পা ধুয়ে খেতে বসে মা কে জিজ্ঞেস করলো , ” তোরা এতো চুপচাপ আছিস কেন রে মা ,? আমি এলাম , তোদের মনে কোনো আনন্দই তো নেই !’ মা চোখের জল মুছে আসতে আসতে বললেন , ” হারু কোন একটা বড়োলোকের মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে শিলিগুড়ির একটা হোটেলে উঠেছে রে বাবা। রতনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। মাথার ওপরের টালিগুলো যেন কংক্রিটের ছাদ হয়ে মাথার ওপর ভেঙে পড়তে চাইলো তার। তার বেকার ভাই ! ছিঃ……..ছিঃ……..ছিঃ ! তবু মায়ের মনে খুশি আনার জন্য রতন মাকে বললো ,” তুই কিছু ভাবিস না মা , আমি তো আছি ‘ খাটিয়ার ওপর বৃদ্ধ বাবা উঠে বসলেন এবার , চশমাটা চোখ থেকে খুলে বললেন ,” বেঁচে থাক বাবা , তুই আমাদের বাঁচালি। আমার তো মাথায় কিছুই খেলছিলো না। তুই আসতে শরীরে প্রাণ এলো। ‘ খাওয়ার পরে রতন দাঁতে দাঁত চেপে ভাইয়ের পড়ার ঘরে ঢোকে। বইপত্র ছড়ানো ছেটানো। দেওয়ালে আধুনিক সিনেমার নায়িকাদের ছবি লাগানো। তাদের চারপাশে স্কেচ পেন দিয়ে ভালোবাসার চিহ্ন আঁকা। রতন সব কিছুই বুঝতে পারে এবার। সারাদিন পরিশ্রম করে , রাত্রে এক্সট্রা ডিউটি করে পাঠানো টাকাগুলো বাজেভাবে নষ্ট করেছে শয়তানটা। বেশ কিছুদিন ধরে চলছিল এইসব। নয়তো হঠাৎ করে কেউ কাউকে নিয়ে পালায় নাকি ! আর এইসবের জন্য তো পয়সা চাই ! দাদা রোজগার করে গেলো আর ভাই সেগুলো নিয়ে ফূর্তি করে গেলো! কোথায় যেন হারিয়ে গেলো রতন। নিজেকে খুব ছোট মনে হলো তার। পরের দিন বিকেলে রোমাদের বাড়ির দিকে গেলো রতন। পাঁচ মিনিটের রাস্তা। বরো স্পর্শকাতর পথ এটা। প্রতি পদক্ষেপে হৃদয় কেঁপে ওঠে তার। ভারী সুন্দর মেয়ে রমা। আর তার ভালোবাসা আরো সুন্দর – আরো গভীর। তার অকৃত্রিম ভালোবাসাই তো রতকাল পথ ভ্রষ্ট হতে দেয়নি রতনকে। তবে বাড়ির কাছে পৌঁছে রতন দেখলো সেই বিখ্যাত জানলাটা বন্ধ করে রাখা রয়েছে – যেটা দিয়ে রমা তার পথ চেয়ে বসে থাকতো। দরজার কাছে এসে রতন ডাক দিলো , ‘ কাকী ….মা ‘ ভেতর থেকে রমার মা বেরিয়ে এলেন। এতদিন পর হটাৎ রতনকে দেখে যেন অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন তিনি। অরে রতন যে ! কবে এলে ? এসো , এসো , ভেতরে এসো। ‘ রতন ভেতরে ঢুকলো। রজনীগন্ধার সুন্দর গন্ধ তার নাকে এলো। টি -টেবিলে একগোছা রজনীগন্ধা রাখা। তাতে গোলাপ ফুল গুঁজে রাখা আছে। ‘তাহলে রতন ওই আগের কোম্পানিতেই আছো ?’ ‘হ্যাঁ , কাকিমা ,ওটাতেই আছি ‘ ‘পয়সা কড়ি কিছু বাড়িয়েছে ?’ ‘হ্যাঁ ,হাজার পনেরো পাই ‘ ‘বাঃ, এবার বিয়ে থা করে নাও ‘ – কাকিমা মুচকি হাসলেন। ‘হ্যাঁ , কাকিমা , এবার করেই নেবো ঠিক করেছি , রতন বললো। ‘ হারু তো করেই ফেললো। পরশু নাকি বৌ নিয়ে ঢুকছে। রমেশ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে। দেখে শুনে বেশ পয়সাওয়ালা ঘরই খুঁজেছে তোমার ভাই , – কাকিমা হেসে ফেললেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখে সামান্য হাসি এনে প্রসঙ্গ পাল্টালো রতন , ‘রমাকে দেখছি না , কাকিমা ?’ ‘রমা কি আর সেই রমা আছে রতন ? ব্যাংকার ক্যাশিয়ারের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছি। রমারও খুব পছন্দ। রোজ বিকেলে ওরা পার্কে যায়। খুব দিলখোলা ছেলে রাতুল। আজ তো একেবারে ফুল নিয়ে …..’ কিছুই কানে শুনতে পায়না রতন। চোখের সামনে কালচে -হলুদ বিন্দু , বিন্দু হতে থাকা অনুরণন হঠাৎ করে থিম যাই যেন। ‘কাকুকে দেখছি না , কাকিমা ‘ ‘গয়নার অর্ডার দিতে গেছে তোমার কাকু। বিয়ে যখন ঠিকই হয়ে গেছে , তো আর এবারের দেরি কেন। তাই ……’ ‘ আমি আসছি কাকিমা ‘ বলে রতন উঠে পরে। ‘সে কি ! কিছু মুখে দেবে না ? রোমার সঙ্গে দেখা করে যাও ‘ ‘না কাকিমা। একটু কাজ আছে। রোমাকে আমার শুভেচ্ছা জানাবেন ‘ ‘আবার এসো ,রমার বিয়েতে আসতেই হবে কিন্তু। ‘এসব কাকিমা , বলে রতন বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। নিজের ওপর হাসি পায় তার। মুহূর্তের মধ্যেই তো মানুষের পরিবর্তন হয়ে যায় – কথা বার্তা , মন , ব্যবহার , চাল – চলন সবই কেমন যেন হয়ে যায়। আর এটাতো পাঁচ বছর অনেকটা সময়। অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চললো রতন। পরিবর্তন তা সস্বাভাবিক। কিন্তু সে তো একইরকম রয়ে গেলো। পাঁচবছর আগে সে সবাইকে ভালোবাসতো এখনো তো সে সবাইকে ততটাই ভালোবাসে অথচ অন্যেরা তো সেরকম নয়। যে যার নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। তবে কি ভুলটা তারই ? যুগের সঙ্গে তাকেও পাল্টাতে হতো। কিন্তু সে পারলো কৈ ? রাস্তার বাঁকে রমার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় রতনের। কি সেজেছে রমা ! কাঁধে ভ্যানিটি ব্যাগ ,ঠোঁটে লাল লিপস্টিক , মুখে লালচে পেন্ট , ভ্রুটা সরুকরে সেপ করা। ঠিক যেন সদ্য ফুলের মধু খেয়ে আকাশে ওরা রঙিন প্রজাপতি। পাঁচবছর আগে জানলায় অপেক্ষা করতে থাকা রমার সঙ্গে কোনো মিলই খুঁজে পায়না রতন। ‘কোথায় গেছিলে রমা ? রতন জিজ্ঞেস করে। ‘লাইব্রেরিতে বই পাল্টাতে। ‘- সহজেই উত্তর দেয় রমা। বই পাল্টাতে ! এতো সহজে মিথ্যা বলা যায়। চলন -বলনে একই আমূল পরিবর্তন তার। যেন এক অজানা লোকের সঙ্গে কথা বলছে সে। সাত বছরের পবিত্র বন্ধুত্ব ব্যাংকার কোন লকারে বন্ধ করে দিয়েছে রমা কে জানে ? ‘ওহ …… ভালো কাকিমার সঙ্গে দেখা হলো। কথা হলো …..’ রমা যেন শুনতেই পায়না। চটপট বাড়ির দিকে চলে যায়। রতন হাঁটতে থাকে বাড়ির দিকে। আবার চিন্তায় কুরে কুরে খেতে থাকে তাকে। কিসের আশায় এসেছিল সে ? ভাইটা এরকম কাজ করে বসলো। পড়াই শেষ করেনি – খাওয়াবে কি ? রমা! তার ভালোবাসা ! একি কান্ড তার – এরকমও হয় ? তার সো সেই কর্মক্ষেত্রই ভালো। সারাদিন কাজের মধ্যে থাকা – রাত্রে কাজ থেকে ফায়ার পুরোনো রেডিওতে পুরানো দিনের গান শোনা , খবর শোনা – রাত এগারোটায় কালুর দোকানে গরম গরম রুটি তরকারি ….. ওহ …. তুলনা নেই। কষ্ট হয় মা -টার জন্য। কিন্তু কি করবে সে ? এখানে তো সেরকম কাজই নেই। যাও বা আছে তো পয়সা নেই। কোম্পানিগুলো যা পয়সা দেয় তাতে সংসার চালানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়। ঘরে ফিরে ব্যাগ গুছিয়ে নেয় রতন। তৈরী হয়ে মাকে ডেকে বলে ,’ আবার আমাকে চলে যেতে হবে মা। কোম্পানি বেশ বড়োসড়ো একটা কাজ পেয়েছে। কাজটা ধরতে না পারলে চাকরিটাও থাকবে না। ‘সে কিরে , তুই না থাকলে সব সামলাবে কে ?’ মা অবাক হয়ে বললেন। ‘সব ঠিক হয়ে যাবে মা , কারোর জন্য কোনো কাজ আটকায় না। কিন্তু চাকরি গেলে আমার কি হবে বলতো মা ?’ মা আর কিছু বলতে পারলেন না। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকলেন তার হৃদয়ের টুকরোটার ভবিষ্যৎ চিন্তা করে। বাবাকে প্রণাম করে হাতে দশ হাজার টাকার রক্ত বান্ডিল দিয়ে রতন বলে , ‘চালিয়ে নিও বাবা , চাকরিটা আমাকে বাঁচাতেই হবে। ‘ বাবার চোখে জল আসে। রতনকে আশীর্বাদ দেওয়ার মতো কোনো ভাষাই খুঁজে পাননা তিনি। দরজা পর্যন্ত তার সাহসী ছেলেকে এগিয়ে দেন কোনো কথা না বলেই। মা মুড়ি , চিড়া , লাড্ডু বাঁধা তার কাপড়ের পুঁটলীটা রতনের ব্যাগে দিয়ে বললেন ,’ ঠিক সময়ে খেয়ে নিস্ বাবা। ‘ রতন তার দিকে তাকাতে পারে না। তাকালেই বাঁধ ভাঙা বিপুল জলরাশিকে আটকানোর ক্ষমতা তার থাকবেনা। রাস্তাটা কষ্টকরে পার হওয়ার পর জোরে পা চালায় মালদা স্টেশনের দিকে। দমভোর বেশ কয়েকবার শ্বাস নেয় রতন। সে আজ মুক্ত পুরুষ। কোনো বন্ধনই আটকাতে পারবেনা তাকে আজ। অনেক হয়েছে প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা।কাজ-কাজ-কাজ।কাজই তার প্রেম ভালোবাসা সবকিছু। ফারাক্কা এক্সপ্রেস ঠিক সময়ই ছেড়ে দেয়। রেল লাইনের ধারে তাদের ছোট্ট পাড়াটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ তার স্পিড আসতে হয়ে যায়। হয়তো বা সামনে ক্রসিং আছে। দুয়ারে মা এখনো দাঁড়িয়ে। ট্রেনের উদ্দেশ্যে বার বার প্রণাম করে হাত নেড়ে চলেছে এক নাগাড়ে – রাতনা স্পষ্ট দেখতে পায় সেটা। রতনও জানলা দিয়ে হাত বের করে নাড়াতে থাকে। মা সেটা পরিষ্কার দেখতে পান না – চোখটা যে তার ভেজা। তবে মা এটুকুই বুঝতে পারেন , তার অভিমানী ছেলে এইভাবে আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।
কলমে শঙ্কর নাথ প্রামানিক
Participate in Creative writing Contest & International Essay Contest and win fabulous prizes.