গহীন জঙ্গলের মধ্যে এসে পড়েছে এরাস্তো। দীর্ঘদিন যাবৎ গা ঢাকা দিয়ে, রাতের অন্ধকারে পায়ে হাঁটার পর, এই গুপ্তচরটি এসে পড়েছে গন্তব্যের খুব কাছাকাছি। মাঝে আর মাত্র এই রহস্যময় জঙ্গল। তারপরেই সে ঢুকে পড়বে সেই নিষিদ্ধ এলাকায়, যেখানে তথাকথিত বহু মানুষ হারিয়ে গেছে। কথিত আছে, এই এলাকায় যে প্রাণীই আসে, সে আর কোনদিন ফেরে না। এরাস্তোর দৃঢ় বিশ্বাস, বড়সড় কিছু চক্রান্ত চলছে এই এলাকায়। কোনো শক্তিশালী সংস্থা নিশ্চিত আছে এইসবের পেছনে। তাদের হদিস পেতেই হবে। অতগুলো নিখোঁজ মানুষ হয়তো সমূহ বিপদের মধ্যে রয়েছে। 

আফ্রিকার এই ঘন জঙ্গলে, বহিরাগতদের পক্ষে নির্দিষ্টভাবে বলা দুঃসাধ্যকর, যে এর অভ্যন্তরে কি ঘটে চলেছে। এরাস্তোকে এবারের মিশনে একা আসতে হয়েছে। এর আগে, একই মিশনে এসেছিল চারজন গুপ্তচর। কিন্তু কেউ ফেরেনি। তাই যা করার এখন এরাস্তোকে নিজেকেই করতে হবে। 

তবে গত রাত্রী থেকে এরাস্তোর মনে হচ্ছে, জঙ্গল না পেরতেই সে এক দুর্ভেদ্য গোলকধাঁধায় পড়েছে। একই জায়গায় কি দীর্ঘক্ষণ ধরে চক্রাকারে ঘুরে চলেছে? অকারণে এই জঙ্গলের আতঙ্ক মানুষকে শতহস্ত দূরে রাখে না। কিছু একটা অজানা রহস্য তো আছে এর নিবিঢ়তম অন্ধকারে।

হঠাৎ কিট-কিট করে আসতে থাকা একটা ক্ষীণ আওয়াজ আকর্ষণ করলো এরাস্তোকে। আওয়াজটা একপ্রকার যান্ত্রিক, কোনো বন্যপ্রাণীর উদ্ভবে নয়। আওয়াজের সূত্র ধরে, এক-পা দু-পা এগিয়ে যেতেই, আচমকা এরাস্তো পিছলে পড়লো অরণ্যভূমির ওপর। কেউ যেন মাটি ভেদ করে পাতালে প্রবেশ করার এক অদেখা সুড়ঙ্গপথ খুলে রেখেছে লোকচক্ষের অন্তরালে। স্খলিত হয়ে পড়া বীর এরাস্তো তবু নির্ভীকভাবে উঠে পড়লো পায়ের তলায় স্থিতি পেতেই। ততক্ষনে সে গড়িয়ে নেমে এসেছে অনেক অনেক নীচে।

কিন্তু পরক্ষনেই, হতবাক হল। কোথায় এসে পড়লো সে? এ যেন এক বহু প্রাচীন পৃথিবী। মহাকায় তরুপ্রাচীর নিস্তব্ধে, নিঝুম রাত্রিতে আবৃত ঘুমন্ত পৃথিবীকে পাহারা দিচ্ছে। ওপরের দিকে তাকালে ও কি দেখা যায়? আকাশ তো নয়, যেন বহু, বহু ওপরে আরেক স্তর পৃথিবী, আজকের নতুন পৃথিবী! 

এরাস্তো অনুভব করে, নিজে বুঝি দাঁড়িয়ে আছে এক সর্পিল অন্ধকূয়োর মধ্যে, যার স্তরে স্তরে ঘুমিয়ে আছে আদিম হতে আদিমতর পৃথিবী।

হঠাৎ চোখ চলে গেল একটা ক্ষীণ আলোর উৎসের দিকে। কৌতূহলবশত, সন্তর্পনে সেদিকে পা বাড়ালো। বেশ খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার পর, বুঝলো একটা বিশালাকৃতির দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। দরজার তলার ফাঁক দিয়ে আলোর রেখা এসে পড়েছে বাইরে।

দরজা প্রানপনে ঠেলে ঢুকতে, চোখে পড়ল বিশাল বড় হলঘরের। সে ঘরের শেষ চোখে পড়ে না। ঘরের ভেতরে রাখা একটা কাঠের টেবিলের ওপর টিমটিম করে জ্বলছে কয়েকটা নিভন্তপ্রায় মোমবাতি। ঘর ভর্তি পুরোনো সিন্দুক আর হলদে হয়ে যাওয়া নথিপত্রের ছড়াছড়ি। এ যে কোনো গুপ্ত রাজকোষ! টেবিলের উল্টোদিকে জনা-পঞ্চাশেক লাল আলখাল্লা পরিহিত মানুষ ধ্যানমগ্ন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওরা ওর আগমনে সম্পূর্ণভাবে অনুতপ্ত। অর্ধনিমীলিত চোখে ওকে দেখছে। এরাই তো তারা, যাদেরকে খুঁজছিল এরাস্তো। অবশেষে, মিশন সফল হলো কি তবে!

কিন্তু ওরা কেন ওর দিকে অদ্ভূতভাবে তাকিয়ে আছে? ওরা কি বুঝতে পারছে না, যে এরাস্তো ওদেরকে উদ্ধার করতে এসেছে? একেবারে নির্বিকার, নির্বিচলিত কেন এদের ভাব-ভঙ্গি?

ওর প্রশ্নের যে উত্তর পেল, তার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না এরাস্তো। ওরা কি না প্রহরী! পাহারা দিচ্ছে প্রাচীন পৃথিবীতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কিছু রাজত্বের প্রচ্ছন্ন ধনরত্ন, পুরোনো সভ্যতা গড়ে ওঠার পুঁথিপত্র, ইত্যাদি। আধুনিক পৃথিবীর অন্তঃস্থলে সেইসব সুরক্ষিত রাখাই এখন  ওদের মুখ্য দায়িত্ব। আর এরাস্তোও  ওদেরই একজন। আধুনিক পৃথিবী থেকে যে ওদেরকে ভুলেও খুঁজতে আসে, সেও ওদের মতনই একজন হয়ে যায়।

বিভ্রান্ত এরাস্তোর চোখ চলে যায় বিপরীত দেওয়ালে রাখা ভাঙা আয়নাটার দিকে। এ কি! আয়নায় যে কারুর প্রতিবিম্ব দেখা যায় না! না তার নিজের, না ঘরভর্তি লোকজনের। সবটাই কি নিছক মরীচিকা?

টেবিলের এক কোনায় কোঁচকানো অবস্থায় বেশ কিছু ছবি দেখতে পায়, যাদের মধ্যে আছে ওর নিজেরও ছবি। অবাক হয় সে, ছবিটা এখানে এলো কিভাবে? দুরুদুরু বুকে দেখে ইংরেজিতে লেখা – 

এরাস্তো কিমাথি

১৯২৮১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দ

কিন্তু…কিন্তু এইটা তো ২০২১ সাল বলেই ও অবগত আছে। তাহলে কি ছবির লোকটা ওর কোনো পূর্বসূরির? 

বাইরে ভোর হয়ে আসছে ক্রমশ। রাত ফিকে হয়ে আসার সাথে সাথে এক অদ্ভুত সন্ত্রাস গ্রাস করে এরাস্তোকে। এবার লুকিয়ে পড়তে হবে। না হলে ওরা, ওই অজানা শত্রুরা যে ওকে দেখে ফেলবে… হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে আর ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে না। অনেক পরিশ্রমের পর খুঁজে পেয়েছে ওদেরকে। ভাবার সাথেসাথেই এক অদ্ভুত ক্লান্তি এসে তার সমস্ত স্নায়ু গ্রাস করতে থাকে। পলকের মধ্যে এরাস্তোর মনে হয়, সে মিলিয়ে যাচ্ছে। এই প্রাচীন পৃথিবীর বাষ্পের মধ্যেই ও বিলীন হয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়… হালকা হয়ে যাচ্ছে চারপাশটা, রূপান্তরিত হচ্ছে সে এক লাল আলখাল্লা পরিহিত প্রহরীতে…

আচমকা এক ঝটকায় চমক ভাঙার মতন উপলব্ধি হয়! এ এক কঠিন মায়ায় বাঁধা পড়ে গেছে এরাস্তো। বন্দীদের উদ্ধারকারী হতে গিয়ে আজ সে নিজেই এক বন্দী। এরা প্রত্যেকে আসলে যক্ষ। এদেরকে যে উদ্ধার করতে আসে, সেও না চাইতে এক অপার্থিব প্রহরীতে পরিণত হয়ে যায়।

তবু বছরের পর বছর, দিনের পর দিনের, প্রতি রাত্রে, এরাস্তো বারংবার জেগে ওঠে একইভাবে, পূর্বের সমস্ত ঘটনা ভুলে, এক অধুনা গুপ্তচর হয়ে। গুপ্তপথ ধরে এগিয়ে চলে আসে হারিয়ে যাওয়া বন্দীদেরকে বাঁচাতে, বিচ্ছিন্ন করতে এই প্রাচীন পৃথিবীর অবরুদ্ধ কারাগার থেকে। অবিচ্ছিন্ন থেকে যায় ওর লক্ষ্য আজও, শুধু সে রয়ে যায় বন্দী।।

কলমে অবন্তী পাল, দমদম, কলকাতা

পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, সম্প্রতি টুকটাক লেখালেখি করছি

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here