প্রৌঢ়মানুষটা থানায় মাথা হেঁট করে বসেছিলেন- থুতনিটা বুকে ঠেকেছে। হয়তো মুখটা কাউকে দেখাতে চান না বলেই ওইভাবে নিজেকে আড়াল করছেন।
অধোবদন মানুষটির বসে থাকার ভঙ্গী খুব চেনা চেনা লাগছে। মনে পড়তেই মস্তিষ্কে বিদ্যুৎচ্চমক! “একি স্যার! আপনি?
এখানে কি করছেন?”
ছলছল চোখে ঘোলাটে দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে, আবার মুখটা ঝুলিয়ে রাখলেন। ঝটিতি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে, এফ আই আর টাতে আড়চোখ বুলিয়ে নিলেন- স্কুলছাত্রীকে বলাৎকারের অপরাধে ধৃত চক্রবর্তী স্যার-পকসো অ্যাক্টে।
কনস্টেবল হাজতে ঢোকাবার জন্য হাতকড়া ধরে টানতেই—
“খবরদার! কেউ স্যারকে ছোঁবে না।
আর ওনাকে কে হাতকড়া পরিয়েছে? খোলো! এখুনি খোলো ওনার হাতকড়া!”
কনস্টেবল থতমত খেয়ে একটা লম্বা সেলাম ঠুকে হাতকড়াটা খুলে দেয়।
অফিসারের উর্দি পরা মানুষটি একটা সাদা কাগজ টেনে খসখস করে কিসব লিখে ফাইলে ঢুকিয়ে রাখলেন।
“আমি নিজে ওনার জামিন মঞ্জুর করলাম।
স্যার! আপনি বাড়ি ফিরে যান।
আমি আসছি আপনার বাড়িতে।”
এফ আই আর থেকে ঠিকানা নিয়ে, ফারদার ইনভেস্টিগেশন এর জন্য ক্লাস নাইনের ছাত্রী রুমা চৌধুরীর বাড়িতে এলেন এস আই অনির্বান মন্ডল।
“থানা থেকে আসছি।
আপনার মেয়ের সঙ্গে একটু আলাদাভাবে কথা বলতে চাই।”
“না। ও নাবালিকা।
আমরা ওকে একা অ্যালাও করবো না।”
“ঠিক আছে।
আপনারাও থাকুন।
তুমি পুরো ঘটনাটা গোড়া থেকে বলো তো, মামণি!
স্যার কি সত্যিই সেদিন তোমার গায়ে হাত দিয়েছিলেন?”
রুমা বেশ উদ্ধত ভঙ্গীতে জবাব দেয়, “দিয়েছেন বলেই তো কমপ্লেইনটা করা হয়েছে! না দিলে কি আমি মিথ্যে কথা বলছি?”
“আপনি এসব প্রশ্ন করে আমার এইটুকু মেয়েকে এমব্যারাস করতে পারেন না। যা কথা বলার তা কোর্টরুমে হবে- এখানে নয়।” চেঁচিয়ে ওঠেন রুমার মা।
“তাই বললে কি হয় ম্যাডাম? আমাকে জিজ্ঞাসা করতেই হবে।”
আপনি যদি এক্ষুণি চলে না যান, তাহলে আমি মিডিয়াতে জানাবো বলাৎকারের পুরো ঘটনাটা।
জানেন নিশ্চয়ই রুমার কাকা খবরের কাগজের রিপোর্টার! আপনি নিশ্চয়ই চান না যে ওই মাস্টার কালকের পেপারের হেডলাইন হোক!
টুং করে মেসেজ দুজনের ফোনেই ঢুকলো।
মেসেজটা একনজর দেখে, রুমা আপন মনেই বললো, "এমনটা তো আমি চাইনি!"
এক মিনিট আগের দেখা মেয়েটা একলহমায় বদলে গিয়ে, মাথা নীচু করে বিড়বিড় করতে উদ্যত হতেই,
“এক মিনিট! দাঁড়াও!
রেকর্ডারটা অন করে নিই।
এবার বলো।”
“আমি স্যারের ক্লাস বাঙ্ক মেরে ঘুরছিলাম বলে,স্যার আমাকে ডেকে এনে সবার সামনে বকাবকি করেছিলেন।
আর আমিও স্যারকে টাইট দিতে চেয়েছিলাম বলে, ওভাবে ছকটা বানিয়েছিলাম অর্ণবদের সাথে। মা-বাবাকে যা বলেছি, তাইই বিশ্বাস করেছে।
কাকা রিপোর্টার। খবরটা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়তে দেরী হয়নি।
থানায় এফ আই আর করাতে স্কুলের গেট থেকে হাতকড়া পরিয়ে স্যারকে গাড়িতে তোলা হয়- সমস্ত ছাত্র-শিক্ষক, অভিভাবকদের সামনে দিয়ে।”
এস আই মন্ডলের চোখের সামনে ভেসে উঠলো দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্পন্ন ছোটবেলার চক্রবর্তী স্যারের লিকলিকে বেতটার ওঠানামা।
“বিশ্বাস করুন, স্যার!
আমি চাইনি!
স্যার মারা যাক।।”
“মারা গেছেন?
কি বলছ কি তুমি?”
“হ্যাঁ।
এইমাত্র মেসেজ এলো।
উনি বাড়ি ফেরার পথে রেললাইনে সুইসাইড করেছেন।”
নিজের মোবাইলটা এতোক্ষণে খুলে, মেসেজ দেখে স্তম্ভিত অনির্বাণ।
উঠে দাঁড়িয়ে, টুপিটা মাথা থেকে নামিয়ে, একমিনিট নীরব থেকে বললেন,
“আশা করি, তুমি স্যারকে টাইট টা ঠিক মতোই দিতে পেরেছো!
তবে একটা কথা শুনে রাখো! উনি আমারও শিক্ষক ছিলেন—-“
দোর্দণ্ড প্রতাপশালী অফিসার অনির্বান মন্ডল মাথা হেঁট করে বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কলমে দীপশিখা দত্ত
Participate in Creative writing Contest & International Essay Contest and win fabulous prizes.