বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মনটা উদাস হয়ে যায় দুলালের। বাস কাশ্মীরের অপরূপ সুন্দর পাহাড়ী প্রকৃতির বুক চিঁড়ে পাকদন্ডি বেয়ে, বেয়ে উপরে উঠে চলেছে। রাস্তার পাশের আপেল বাগান গুলোতে আপেল ধরেছে। সেই দেখার জন্য অনেকেই মুখ বার করে আছে। দুলালেরও এই গুলো দেখতে খুব ভালো লাগে। কিন্তু এখন আর সেই মন নেই তার। আসলে ছুটি কাটিয়ে কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাওয়ার সময় ও , তার মনটা বাড়ীতেই পরে থাকে। মিলিটারিতে চাকরি, কঠোর নিয়ম আর অনুশাসনে জীবন বাঁধা তার। কিন্তু কজন আর এগুলো বোঝে?? এই তো পাড়ার ছেলেরা ধরেছিলো ১৫ ই আগষ্ট অবধি থেকে যেতে। ওই দিন ওদের ক্লাবের প্রতিষ্ঠা দিবস। তাই প্রতিবারই ওরা এই উপলক্ষ্যে একটা ফুটবল টুরনামেন্টের আয়োজন করে। চাকরি পাওয়ার আগে সে-ও এই টুরনামেন্টের আয়োজক ছিলো। ফুটবলটা ভালোও খেলতো। কিন্তু চাকরিতে যাবার পর ১৫ই আগষ্ট ফুটবল খেলা আর হয়না তার। ওটা যে একটা বিশেষ দিন। তাই সেই দিন দেশের নিরাপত্তা দেখার কাজেই ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে। ইচ্ছে থাকলেও ছুটি পাওয়া যায় না। আবার মা ও এবার বললো যদি পুজোর সময় আসতে পারে তো ভালো হয়। দুলালের নিজের মা তার পাঁচ বছর বয়সেই ওকে বাঁচাতে গিয়ে আগুনে পুড়ে মারা যায়। সেই আঘাত সহ্য করতে না পেরে দুলালের বাক্ শক্তি সাময়িক ভাবে হারিয়ে গিয়েছিলো। তারপর এই মা এসে তার মায়া মমতা দিয়ে দুলালকে স্বাভাবিক করে তোলে। কেনো যে লোকে সৎ মা বলে?? সেটা দুলাল বুঝে পায় না। তার নিজের মায়ের মুখ আজ আর মনে নেই। তার কথা মনে করলে খালি একটা শাড়ীর আঁচল দেখতে পায় দুলাল। যেটা দাউ দাউ করে জ্বলে গ্রাস করে নিচ্ছে একটি সম্পূর্ণ নারী মূর্তিকে। আজও সেই কথা ভাবলে ভয়ে চোখ বন্ধ করে দুলাল। মায়ের সমস্ত স্নেহ ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে তাকে বড় করে তুলেছে দুলালের সৎমা শ্যামা। নিজের একটা ছেলে থাকলেও বড় ছেলে দুলালের উপর আশা ভরসা বরাবরই বেশী। এমন কি ছোট ছেলে শিবু প্রেম করে দাদার আগে বিয়ে করায় বেশ রাগই করেছিলো সে। দুলালই মাকে বুঝিয়ে ভাই আর ভাইয়ের বৌকে ঘরে তুলেছিলো। আহা! বাবা মারা যাওয়ার সময় কতো ছোট ছিলো ভাইটা। দুলালেরই তো দায়িত্ত্ব ওকে ভালো রাখা। তাই নিজের সংসারের কথা না ভেবেই ভাইয়ের সংসার গুছিয়ে দিয়েছিলো। আর কি বা রোজগার ওর? নিজেদের ওই সামান্য জমিতে যা ফসল হয় তা বেচেই তো ওকে সংসার চালাতে হয়। তাই দুলাল যদি একটু সাহায্য না করে তো ওরই বা চলে কোথা থেকে!! এই যে এবার এতো কষ্ট করে ছুটিটা নিলো তাও তো ভাইয়ের কথাই ভেবে। বর্ষায় আমন ধানের বীজ বপন করতে হয়। ভাইটা একা সব করে উঠতে পারেনা। ও গিয়ে ভায়ের সাথে চাষের কাজে সাহায্য করে। আর এখন তো ছুটিও অনেক কম। কিন্তু মা ও এবার বড় অবুজের মতো আবদার করলো। মার বয়স হয়েছে, তাই বোধহয় একটু অবুজ আর খিট্ খিটে হয়ে গেছে। পুজোতে আসার জন্য বার বার করে বলে দিয়েছে। ওই সময় মা নাকি ওর বিয়ের সমন্ধ পাকা করবে। তার বিয়ে নিয়ে মা খুবই চিন্তায় আছে। শিবুর বৌকে ও মাঝে মাঝে অযথাই কথা শোনায় এই নিয়ে। সে বেচারি ই বা কি করবে?? ছেলেমানুষ সে কি করে ভাসুরের বিয়ে দেবে?? অবশ্য দুলালকে সে নিজের দাদা ছাড়া কিছুই ভাবে বলে মনে হয় না। যে কটা দিন বাড়ী থাকে, তার সুখ সাচ্ছন্দ্যের দিকে যথেষ্ট খেয়াল রাখে। সন্মানও করে অনেক। না! এবার বিয়েটা করেই ফেলতে হবে। বিয়ের ভাবনা ভাবতেই মনের মধ্যে একটা খুশির হাওয়া খেলে গেলো। চকিতে মনে পরে গেলো ওই মেয়েগুলোর মুখ। মিলিটারি জিপের ভেতর থেকে যাদের দেখে ও। ঐ যারা কাশ্মীরে বেড়াতে এসে রঙ্গীন প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ায়। সত্যি! কি সুন্দর দেখতে মেয়েগুলো। গায়ে যেনো মাছি বসলে ও পিছলে পরে। কতো কেতার চুল তাদের। মুখে লাল, নীল রং (লিপস্টিক, আইশ্যাডো) মেখে রং বেরঙের পোষাক পরে যখন ঘুরে বেড়ায় তখন তাদের দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারে না ও। আচ্ছা,ওই রকম একটা মেয়ে যদি তার বৌ হয়?? ভাবনাটা ভেবেই মনে মনে হেসে ফেললো সে। ধুর! ওসব মেয়ে বড়লোকের ঘরের শোকেসেই ঠিক আছে। তাদের ঘরে মানায় না। একটা সোজা, সরল মোটামুটি দেখতে মেয়ে হলেই চলবে তার। হঠাৎই দুলাল “ভাইয়া” ডাকটা শুনে চমকে ওঠে। আরে! বাসের পাশেই তো জিপ নিয়ে রয়েছে তাদেরই ব্যাটেলিয়নের ছেলে- সুরেশ থাপা। যাক্, ভালোই হলো তাকে আর শ্রীনগর অবধি যেতে হবেনা।তাড়াতাড়ি ড্রাইভারকে বলে বাস থামায় সে।
বাড়ী থেকে আসার সময় যে মনের কষ্টটা ছিলো জিপে উঠে সহকর্মীদের মাঝে এসে তা কমে গেলো। সত্যি বলতে কি এরাই এখন ওর পরিবার। বছরের অধিকাংশ সময়ই তো ওদের সাথে থাকা। কে বলে ভারতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নেই?? তা যদি না থাকতো তা হলে ওরা নানা ধর্মের, নানা জাতের, নানা ভাষার এতো গুলো ছেলে এক সাথে থাকতো কি করে??এখানে প্রায় সবাই সবার সুখ, দুঃখের কথা জানে। একে অন্যের দুঃখে দুঃখ পায়। আবার খুশির কোন ঘটনা ঘটলে এক সাথে সবাই সেলিব্রেট করে। ছুটি কেমন কাটলো সেই গল্প করতে করতে আর ওদের ক্যাম্পের খবরা খবর নিতে নিতেই কখন যে পথ ফুরিয়ে এলো তা বুঝতেই পারলো না দুলাল। তবে ওদের একটা কথায় মনটা যেনো একটু কূ ডাক দিয়ে উঠলো। ওরা বলছিলো ওদের ক্যম্পের আাশে পাশে নাকি জঙ্গীরা ঘাঁটি গেড়েছে। যে কোন সময়ই গন্ডগোল হতে পারে।
বেশ বেলা করেই ওরা ক্যম্পে পৌঁছলো। দুপুরের খাওয়া হয় নি। তাই তাড়াতাড়ি ক্যান্টিনে গিয়ে খাবার চাইলো। কিন্তু সেখানে কেবল শুকনো রুটি ছাড়া আর কিছুই নেই। অগত্যা তাই নিয়েই ফিরে আসার পথে অফিসার ক্যান্টিনের সুখাদ্যের ঘ্রান মনটাকে ভারী করে দিলো। মুহুর্তের জন্য লুদ্ধ দৃষ্টিতে ওই দিকে তাকিয়েই মনে মনে বললো তার মতো সাধারণ জওয়ানের ওই সব সুখাদ্যের লোভ করা মানায় না। রুটি দিয়ে খাওয়ার মতো কিছু আছে নাকি দেখার জন্য নিজের ব্যাগে হাত ঢোকালো সে। প্রতিবারই বাড়ী থেকে আসার সময় নাড়ু, মোয়া টাইপের কিছু শুকনো খাবার দুলালের মা দুলালের সাথে দিয়ে দেয়। সেগুলো দিয়ে কদিন বেশ মুখ বদল করে ও। এবার মায়ের শরীরটা ভালো নেই। তাই দুলাল ভেবেছিলো এবার হয়তো খালি হাতেই ফিরতে হবে। কিন্তু আসার আগের দিন যখন ও ব্যাগ গোছাচ্ছিলো তখন শিবুর বৌ খুব কুন্ঠিত ভাবে এসে দাড়িয়েছিলো ওর ঘরে। দুলাল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে একটা বড় প্যাকেট আর মাঝারি মাপের একটা শিশি হাতে দিয়ে বলে..”এগুলো রেখে দেন দাদা। ওখানে গিয়ে খাবেন… আমি বানিয়েছি।” শিবুর বৌয়ের মামার বাড়ী টাউনে। তাই ওর কথাবার্তা, চালচলনে একটু শহুরে ছাপ আছে। এই বয়সে বুদ্ধিও রাখে অনেক।দুলাল ওর হাত থেকে জিনিসগুলো নিয়ে জিজ্ঞসা করেছিলো “আর কিছু বলবে??” শিবুর বৌ আরো লাজুক মুখে গলার স্বরটা যতোদূর সম্ভব আস্তে করে, মাথাটা নীঁচু করে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি খুঁটতে খুঁটতে বলে-“আপনার অাপিসের ঠিকানাটা দেবেন??” শিবু অবাক হয়ে কারন জিজ্ঞাসা করলে বলে.. ” না মানে মা বলছিল সমন্ধের জন্য মেয়ের ছবি চেয়ে পাঠাবে। তো আপনি যদি ঠিকানাটা দিতেন তো আমি পোষ্ট অাপিসে গিয়ে ছবি পাঠিয়ে দিতাম”। প্রস্তাবটা শুনে দুলাল কয়েক মিনিটের জন্য চুপ করে যায়। তারপর হেসে বলে ” মাকে বলো অতো হাঙ্গামার দরকার নেই “। তারপর ভাইয়ের বৌয়ের দিকে ফিরে বলে.. “আরে বাবা! আমি তো কয়দিন পরেই আবার বাড়ী ফিরবো, তখনই না হয় মেয়ে দেখবো। ” তারপর একটু ভেবে বললো- “আর তোমরা যদি এর মধ্যে কোন ভালো মেয়ে পাও তো বিয়ে ঠিক করে রেখো। আমি না হয় একেবারে বিয়ের সময়ই দেখবো।” শিবুর বৌ মৃদু স্বরে প্রতিবাদ জানিয়ে বললো ” তা আবার হয় নাকি?? দুর! মেয়ে না দেখে কেউ বিয়ে করে নাকি!!” দুলাল সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিয়েছিলো, “কেনো হয় না?? সংসার তো তোমরা নিয়েই করবে। আমি আর কয়দিন বাড়ী থাকবো?? ” এতো বড় সমস্যার এতো সহজ সমাধান পেয়েই হয়তো শিবুর বৌ ঘর থেকে তাড়াতাড়ি বার হয়ে মাকে খবর দিতে চলে গেলো। না! সামনের বার গিয়ে ওদের একটা স্মার্ট ফোন কিনে দিয়ে আসতে হবে। এবার গিয়ে দেখেছে, ওদের গ্রামে এখন নেটের ভালোই সিগনাল পাওয়া যায়। অন্য কিছু না হোক ফোনটা থাকলে মাঝে মাঝে ভি.ডি.ও কলে মাকে দেখতে তো পাবে।
ব্যাগ হাতরিয়ে শিবুর বৌয়ের দেওয়া শিশিটা বের করে দেখলো তার মধ্যে আমের জেলি। একটু মুখে দিয়ে দেখলো, বা! ভালো খেতে তো! এ যে দোকানের জেলিকে হার মানায়।আমগুলো যে দিন দুই ভাই মিলে পাড়ছিলো, সেদিন শিবু বলছিলো বটে, ওর বৌ নাকি, কি সব স্বনির্ভর গোষ্ঠিতে গিয়ে, জেলি, আাচার, সহ আরো কি, কি সব বানানো শিখছে। জেলি দিয়ে রুটি খেতে খেতে অফিসার মেসের দিকে তাকিয়ে কিছুটা স্বগক্তিই যেন করলো..”যতোই তোরা খাবারের গন্ধ ছড়াস না কেনো,নিজের বাড়ীর গাছের জিনিস পাবি কি? খাওয়া দাওয়া সেরে দুলাল যখন একটু বিশ্রাম নিতে যাচ্ছে তখনই শহিদুল এসে ওর হাতে দুটো আপেল ধরিয়ে দিয়ে বললো..”দাদা এদুটো খা। এখনে ভালো, মিষ্টি হয় নি রে। দুদিন আগে কিনেছিলাম, তুই আসবি বলে এদুটো রেখে দিয়েছিলাম।” এখানে সবাই “ভাইয়া” বা নাম ধরে ডাকলেও শহিদুল দাদাই ডাকে। আসলে শহিদুল বাঙ্গালী, তাই ওর সাথে বাংলায় কথা বলা যায় বলে প্রথম থেকেই ওর সাথে ভাবটা বেশী দুলালের। ক্ষণিকে শিবুর মুখটা মনে পরে যায়। শিবুও তো এই ভাবেই এটা ওটা ওর জন্য গুছিয়ে রেখে দেয়। এর মধ্যেই অফিসারের তলব। তাড়াতাড়ি ওরা অফিসের দিকে পা বাড়ায়।
ওদের অফিসারটি বাঙ্গালী হলেও নিজেকে কখনোই বাঙ্গালী বলে পরিচয় দেন না। তার মতো,নাক উঁচু, সুবিধাবাদি ,দাম্ভীক ও চতুর মানুষ খুব কমই দেখা যায়। ওরা গেলে ওদের হিন্দীতে বললো ওনার কাছে খবর আছে জঙ্গিরা নাকি ওদের ক্যম্পকে টার্গেট করেছে। তাই আজ থেকে নাইটে খুব সজাগ থাকতে হবে। ১৫ই আগষ্ট অবধি ওরা যেনো খুব সচেতন ভাবে ডিউটি করে। কোন রকম গন্ডগোলের আভাস পেলে যেনো ওকে জানানো হয়। তারপর ওরা কে কোথায় ডিউটি করবে তা বলে দেয়। আর ক্যাম্পের মধ্যে সব থেকে নিরাপদ জায়গাটা নিজের জন্য বেছে নেয়। নিশীথ রাতে পাহাড়ের চূড়ায় চন্দ্রলোকের বিচ্ছুরণ দেখা যায়। সেই আলো বরফের উপর প্রতিফলিত হয়ে বিশ্বচরাচরে ছড়িয়ে পরেছে। নিস্তদ্ধ বনানী যেনো চুপিচুপি চন্দ্রালোকের শোভা উপভোগ করছে। বিশ্বচরাচরের অপরূপ সৌন্দর্য্যে প্রকৃতি যেনো নিজেই মুগ্ধ হয়ে আছে। দুলাল শহিদুল সহ আরো দুই জওয়ান ডিউটি করতে করতে অস্ত্রাগারের পিছন দিকটায় যায়। অস্ত্রাগারের ঠিক পিছনেই খাড়াই পাহাড় উঠে গেছে। ঘন বনে ছাওয়া এই দিকটা অন্যদিকের থেকে বেশ দুর্গম। তাই সচরাচর ডিউটি ছাড়া কেউ এদিকটায় আসে না। হঠাৎ ঘন বনে স্বল্প চন্দ্রালোকিত রাতে কাদের যেনো নাড়াচাড়া দেখতে পায় ওরা। আর চারদিন পরেই ১৫ই আগষ্ট। তাহলে ওরা কি কোন বদ মতলবে এসেছে??পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় ওরা। দুলাল সবার আগে বনের ভিতর লুকিয়ে দেখে প্রায় সাত আট জনের একটা দল কিছুটা দূরে কতোগুলো বন্দুক আরো কি কি সব নিয়ে অস্ত্রাগারের দিকে যাচ্ছে। সময় নষ্ট না করে শহিদুল আর অন্য একজন জওয়ান যায় অফিসারকে ডেকে আনতে। অন্ধকারে পায়ের শব্দ বাঁচিয়ে ওরা দ্রুত পায়ে চলে যায়। দুলাল আর অন্য একজন জওয়ান অপেক্ষা করতে থাকে অফিসারের জন্য।
নিশীথ রাতে সময় যেনো থমকে দাড়ায় উপত্যকার বনানীতে। অফিসারের আসতে দেরী দেখে দুলাল আর একটু এগিয়ে যায়। গাছের ফাঁক দিয়ে ওদের অস্ফুট কথা যা শোনে তাতে ওর গায়ের রোম খাঁড়া হয়ে যায়। অস্ত্রাগারে বিস্ফোরণ ঘটানার জন্য ওরা রেডি। ওদের নেতা এক হাতে বন্দুক আর এক হাতের জিনিসটা অতো দূর থেকে সঠিক বোঝা না গেলেও ওটা যে বিস্ফোরক কিছু একটা সেটা বুঝতে দুলালের অভিজ্ঞ চোখ বেশী সময় নেয় না। ওরা এগিয়ে যাচ্ছে অস্ত্রাগারের দিকেই। কিন্তু এখনও তো কেউ এলো না!! অথচ এরা তো মনে হচ্ছে ঘটিয়েই ফেলবে অঘটনটা! কি করবে দুলাল?? পালিয়ে যাবে?? এমন সময় বহুদিন বাদে তার চোখের সামনে একটা দৃশ্য ভেসে আসে। তার গর্ভধারীনি মা দাউ দাউ করে জ্বলছে, আর দুলালকে পালিয়ে যেতে বলছে! দুচোখ চেপে ধরে দুলাল। তাতেও চোখের সামনে থেকে দৃশ্যটা যায় না! এবার দুলাল তার কর্তব্যটা বুঝে যায়। একবার তার মাকে পুড়তে দিয়েছে। আর না! দেশ মাতৃকাকে আর সে পুড়তে দেবে না। যা থাকে কপালে – বলে হাতের বন্দুকটা নিয়ে অফিসারের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা না করেই গুলি চালাতে থাকে। হঠাৎ করে গুলি আসাতে ওরা হকচকিয়ে যায়। ওদের নেতা বিস্ফোরকটা সরিয়ে রেখেই পিছিয়ে আসে অস্ত্রাগারের দিক থেকে। সেও বন্দুক হাতে তুলে নেয়। তারপর অন্য জঙ্গীদের উদ্দেশ্য বলে “ফায়ার!”। উল্টোদিক থেকে এবার গুলি বৃষ্টি শুরু হয়। দুলাল একা আর পারে না। ওদের ছোঁড়া বুলেট তার শরীর ভেদ করে যায়। এই সময় একটু দূর থেকে মিলিটারিদের গুলি আওয়াজ শুনে ওরা দৌড় দেয়। দুলাল শেষ বারের মতো বন্দুকটা তুলে নেয়। রক্তাক্ত হাতে প্রাণপনে চেপে শেষ ফায়ারটা করে। না, তার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। ওর ছোঁড়া বুলেট জঙ্গীনেতার পিঠ দিয়ে ঢুকে বুক ফুঁড়ে বার হয়ে যায়। কুখ্যাত জঙ্গীনেতা সারাজীবনের মতো মাটিতে লুটিয়ে পরে। অফিসার যখন সবাইকে নিয়ে আসে, তখন দুলালের প্রাণহীন দেহটা অস্ত্রাগারের অনতি দূরে পরে রয়েছে।
আজ ১৫ই আগষ্ট। বহুদিন বাদে দুলাল আজ তার ক্লাবে। না, সশরীরে নয়। তার সহকর্মীদের কাঁধে চেপে তেরঙ্গায় মুড়ে শেষবারের জন্য সে তার গ্রামে এসেছে। শহীদ দুলালকে দেখতে আশে পাশের গ্রাম ঝেঁটিয়ে লোক এসেছে। অনেক নেতা, মাতব্বর ,পঞ্চায়েত সদস্য সবাই আছে। এমন কি দুলালের অফিসারটিও এসেছে। দুলালকে শেষ সন্মান জানানোর অনুষ্টানে সে সবাইকে জানায় যে কিভাবে সে আর দুলাল দুজন মিলে জঙ্গী দমন করেছে। যে গুলিটা দুলালের বুকে লেগেছে সেটা নাকি ওরই বুকে লাগার কথা ছিলো। অন্ধকারে জঙ্গীরা ঠিক বুঝতে পারেনি তাই। ওর কান্নাভেজা গলায় বীরগাথা শুনতে শুনতে সবাই এক বাক্যে স্বীকার করলো যদি শহীদ দুলাল বীর হয় তো এও কম যায় না!
ওদিকে দুলালের বাড়ীতে আজ অনেক গণ্য মাণ্য লোকজন। শহীদ দুলালের স্মৃতির উদ্দেশ্যে কি কি করা হবে তার ছোট খাটো একটা ফর্দ ও শ্যামাকে তারা দিচ্ছিলো। শ্যামা আজ শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার বোধশক্তি আজ রোধ হয়ে গেছে। বড়ছেলেকে হারানোর দুঃখে চোখের জলেও খরা এসেছে। কান্নাও আসছে না আজ তার। এমন সময় গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য মাধব ঘোষাল চুপিচুপি এসে বললো,..” তোর তো ভাগ্য খুলে গেলো রে শ্যামা!! সৎ ছেলেটা গেলো। এখন এই বাড়ীঘর সব তোর নিজের ছেলে পাবে! এমন কি তোর সৎ ছেলের চাকরীটাও। আর ক্ষতিপূরণের যে টাকাটা পাবি তা দিয়ে তো তুই রাজার হালে থাকবি রে! এখন তো তোরই দিন!! ” রাগে, ঘৃণায় শ্যামা মুখের ভাষা হারায়।
গভীর রাতে শ্যামা তার ঘর থেকে হাত রিয়ে, হাত রিয়ে দুলালের ঘরে আসে। দরজাটা খুলতেই দুলাল যেনো “মা” বলে ডেকে ওঠে। পরম যত্নে বিছানাটার উপর হাত বোলাতে থাকে সে। মনে পরে, এই বিছানাতেই সে দুই ছেলেকে দুই পাশে নিয়ে ঘুমোতো। দুলালের বুকের উপর সে হাত না রাখলে ঘুমাতে পারতো না ছেলেটা। আজ তার সেই ছেলেই চির ঘুমের দেশে!! এবার শ্যামা কান্নায় ভেঙ্গে পরে।অস্ফুট গোঙানির মতো স্বরে বিলাপ করতে করতে বলে.. “বাবু মুঁই মুখ্যু মেয়ে মানুষ! তোদের মতো অতো বুদ্ধি নাই রে! তবুও এইডা বুঝি মায়ের কোল কুনোদিন সৎ হয় না রে! ও ছাওডার থিক্যাই মুঁই প্যারথম বার মা ডাক শোনছিলাম। মুঁই ছ্যাওডা রে দ্যাশের কামে পাঠাই ছিলাম। ছাওয়ালের প্রানডা বেচার টাকায় মুঁই রাজা হই কি কইরা..এইডা বুঝাইয়া দিবি বাবু??”…
লেখিকা অনামিকা মন্ডল (সেনগুপ্ত) এর কলম থেকে “আমি স্বাধীনতা সংগ্রাম দেখিনি…. কিন্তু স্বাধীন ভারতকে রক্ষা করতে যে সব বীর জওয়ানরা প্রতিনিয়ত নিজেদের প্রাণ বাজি রেখে আমাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে, তাদের সন্মান জানিয়েই এই গল্প” .
লেখিকার আরো লেখা পড়তে ক্লিক করুন "ক্ষনিকের -অতিথি " ...
[…] আরো লেখা পড়তে ক্লিক করুন "মা তুঝে সালাম " […]